Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শোক দিনের কথা

সজীব ওয়াফি
১৫ আগস্ট ২০২১ ১৩:৪৯

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রচিত হলো বাংলাদেশের কলঙ্কিত অধ্যায়। বাঙালি জাতির স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে ঘাতকদের নির্মম বুলেটে নিহত হলেন। এরপর নানা ঘটনাপ্রবাহে ক্ষমতা দখল করল খন্দকার মোশতাক। দুঃসময়ের এই দিনগুলোতে ঘাতক-কুশীলবেরা অনেক অসত্য তথ্য ছড়িয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করেছেন তাদের নিজেদের প্রয়োজনে। ব্যবহার করে সরকারি সংস্থাগুলোকে। স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সম্পর্কেও তারা কার্পণ্য করেনি।

বিজ্ঞাপন

৪৭ এর দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে আসলেন মওলানা ভাসানী। তার পূর্বে তিনি আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। অন্যদিকে দেশভাগের পরপরই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের দরজা বন্ধ হয়ে মুসলিম লীগ আটকা পড়ল আহসান মঞ্জিলে। সাধারণ সদস্য গ্রহণ এক প্রকার নিষিদ্ধ। পাকিস্তানের নানা কার্যকলাপে দেশবাসী বিক্ষুব্ধ। পাকিস্তান আন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা ভূলুণ্ঠিত হয়ে শেখ মুজিবসহ যারা মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন সকলেই বিব্রত।

বিজ্ঞাপন

জনগণের মুক্তির দিশা দিতে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগের গোড়াপত্তন হয়। চল্লিশ সদস্যবিশিষ্ট কমিটিতে মওলানা ভাসানী হলেন সভাপতি আর জেলে থাকা অবস্থাতেই শেখ মুজিবুর রহমান হলেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ভাসানী তরুণ মুজিবকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরেছেন এ বাংলার পথে প্রান্তরে। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার পক্ষে আদায় করেছেন সমর্থন। সময়ের পরিক্রমায় এভাবেই ভাসানী-মুজিব গুরু-শিষ্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। শেখ মুজিবকে ভাসানী দেখতেন পুত্রসম অধিকারে। শেখ মুজিবও শ্রদ্ধা করতেন একেবারেই ভেতর থেকে।

স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের নানা কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন ভাসানী। আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন সম্প্রসারণবাদী আধিপত্যের বিরুদ্ধে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তিনি অনশন করেছেন এবং তাকে গ্রেফতার ও গৃহবন্দী অবস্থায় কাটাতে হয়েছে।

’৭৫ সালে বাকশাল গঠন হলে তৎকালীন সরকার মাত্র চারটি ছাড়া দেশের সকল দৈনিক বন্ধ করে দেন। চারটির মধ্যে আগে থেকেই সরকারি মালিকানাধীন ছিল দৈনিক বাংলা। বাকশাল গঠন হলে বাকি তিনটিও সরকারি মালিকানায় চলে আসে। হক কথা বন্ধ করে দেওয়া হয় তারও অনেক আগে। বড় দাগে গণমাধ্যম সরকারি মুখপত্রে পরিণত হয়।

১৫ আগস্টে সকালের খুব কাছাকাছি সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বাসঘাতক লোকদের ষড়যন্ত্রে শাহাদাত বরণ করলেন। সারাদেশে বেতারে প্রচারিত হল। বেতার এবং সংবাদমাধ্যমগুলো কাজে লাগালো ষড়যন্ত্রীরা। বুলেটের চেয়ে প্রচার যন্ত্রটা খুব দ্রুত কাজে লাগল তাদের পক্ষে। এই সময়ে মওলানা ভাসানী ছিলেন টাঙ্গাইলে তার সন্তোষের বাড়িতে। তার মজিবরকে কেউ মেরে ফেলেছে শুনেই তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। কখনো মসজিদের ভিতরে যাচ্ছেন, আবার কখনো বাইরে উঠোনে আসছেন। শেষ পর্যন্ত মওলানা ভাসানী মসজিদের ভিতরে অবস্থান নিয়ে ভেঙে পড়লেন কান্নায়। মোনাজাত করেছেন তার মজিবরের মঙ্গলের জন্য।

ক্ষমতায় আসলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ সরকারের অনেকে যোগ দিলেন খন্দকার মোশতাকের সরকারে। সারাদেশে কোথাও প্রতিবাদী আন্দোলন হলো না। এমনকি দুঃসময়ের এই দিনগুলোতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে লন্ডনে প্রতিবাদী একটি বিবৃতি দিতে অনুরোধ করলেন। তিনি রাজি হলেন না, এ মর্মে অভিযোগ আছে। ক্ষমতা পেয়ে খন্দকার মোশতাক ধর্না দিলেন মওলানা ভাসানীর। মওলানা ভাসানীর কাছে দোয়া এবং সমর্থন চাইতে সন্তোষে ভাসানীর দুয়ারে হাজির হলেন খন্দকার মোশতাক। উত্তেজিত ভাসানী জানিয়ে দিলেন, ওরা আমার এক পোলা মজিবরকে মেরে আবার আমার কাছেই আসছে সমর্থন নিতে! খন্দকার মোশতাক সেদিন সমর্থন পাননি, কিন্তু ক্ষমতার শেষ দিন পর্যন্ত ভাসানীর পিছু ধরে রেখেছে। কোনোদিন তাকে বাগে পাওয়া যায় এই আশায়।

১৫ আগস্টের পরপরই জাতীয় দৈনিকে মোশতাক সরকার সমর্থনে ভাসানীর নামে বিবৃতি প্রকাশ হয়। কয়েকদিন পরেই অসুস্থ হয়ে ঢাকার পিজি হাসপালে ভর্তি হলে চিকিৎসাধীন ভাসানীকে ২২ সেপ্টেম্বর দেখতে যায় প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক। পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়। খন্দকার মোশতাকের এই সাক্ষাৎ ‘প্রমাণ’ হিসেবে চাউর হতে থাকে যে, মওলানা ভাসানী মোশতাক সরকারকে সমর্থন জানিয়েছেন। খন্দকার মোশতাক ক্ষমতায় এসে ভাসানীকে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছেন এটা সত্য। তবে ভাসানী কখনোই প্রশ্রয় দেননি।

মোশতাক সরকারের সমর্থন প্রসঙ্গে মওলানা ভাসানীর বিবৃতি এবং সাক্ষাতের খবর যখন প্রকাশ হয় তখনো বাকশালের সেই চারটি পত্রিকাই বহাল। এমনকি ১৫ আগস্টের পরে মোশতাক সরকারকে ভাসানীর সমর্থন বিষয়ক আলোচ্য প্রতিবেদনে মওলানা ভাসানীর বিবৃতি উদ্ধৃত করা হয়েছে ‘বিশ্বস্ত সূত্রের’ বরাত দিয়ে। সরাসরি ভাসানীর কোনো বক্তব্য সেখানে নেই। সুতরাং খন্দকার মোশতাক তার স্বেচ্ছায় গণমাধ্যম ব্যবহার করেছে এটা স্পষ্ট এবং বাকশালের সংস্কৃতিতে কবজা করা সরকারি মুখপত্রের তখন গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। দ্বিতীয়ত পাকিস্তান আমল থেকে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং লিয়াকত আলী খানের পর এমন কোনো গভর্নর, জেনারেল, প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রাদেশিক গভর্নর নেই যিনি কোনো না কোনো সময়ে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি।

বর্তমান সময়ে অনেকে দাবি করেছেন ’৭৬ ফারাক্কা লংমার্চে নেতৃত্ব দেওয়া মওলানা ভাসানী মোশতাক সরকারকে যদি সমর্থন না করবেন ’৭৫ এ বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন না কেন? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের অনুসারীরা যখন পালিয়ে গেছেন, দেশের কোনো আড়ালেই যখন সামান্য প্রতিবাদী আন্দোলন হয় না, শেখ হাসিনার অনুরোধে লন্ডনে বসেও যখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামান্য প্রতিবাদ বিবৃতি পাঠাতে নারাজ, তেমন পরিস্থিতিতে জনমানুষের কাছে মুজিব বিরোধী হিসেবে পরিচিত এবং গোয়েন্দা নজরদারি-গৃহবন্দী মওলানা শেখ মুজিবের পক্ষে কিভাবে দাঁড়াবেন? ৯৫ বছরের বয়োবৃদ্ধ মানুষের পক্ষে আর কত সম্ভব? পরিস্থিতি এত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছিল যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌম পড়েছিল হুমকির মুখে। এই দৃষ্টিকোণ থেকেও হয়তো ভাসানী সেদিন চুপ থেকেছেন।

মওলানা ভাসানী সব সময় জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েছেন। দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ছিলেন আপসহীন। মওলানা ভাসানী কখনোই হত্যার ষড়যন্ত্রে বিশ্বাস করতেন না। বঙ্গবন্ধুকে সতর্কও করেছিলেন একবার। অথচ পুত্র শোকে বিহ্বল তার নামেই প্রচার হলো শোক দিনের কলঙ্কিত অধ্যায় সমর্থনের।

তথ্যসূত্র:
১. জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫, অলি আহাদ;
২. পাকিস্তান আন্দোলন, নাইমউদ্দিন আহমদ;
৩. ৭০ থেকে ৯০: বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, আবদুল ওয়াহেদ;
৪. মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন, হাজী মোহাম্মদ দানেশ;
৫. তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, লে. কর্নেল(অব.) এম.এ. হামিদ পিএসসি;
৬. মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, সৈয়দ আবুল মকসুদ;
৭. The Red Moulana, Nurul Kabir;
৮. অসমাপ্ত আত্মজীবনী, শেখ মুজিবুর রহমান;
৯. কারাগারে রোজনামচা, শেখ মুজিবুর রহমান;
১০.যুগে যুগে মওলানা ভাসানীর সংগ্রাম, শাহ আহমদ রেজা;
১১. মওলানা ভাসানীকে যেমন দেখেছি, আবদুল কাদের সিদ্দিকী;
১২. স্বাধীনতা ‘৭১, আবদুল কাদের সিদ্দিকী;
১৩. ভাসানীর অনশন, সৈয়দ ইরফানুল বারী;
১৪. আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, আবুল মনসুর আহমদ

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক , কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ভাসানী পরিষদ

সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর