বেদনার বেলাভূমি আগস্ট
১৫ আগস্ট ২০২১ ১৬:৫২
বেদনার পর্বতরাজ ও বাংলার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে মর্মাঘাতের পাণ্ডুলিপি কিংবা জাতির আর্তনাদের মহাকাব্য বলে যদি কোনো উপাখ্যানকে আখ্যায়িত করা হয়— তবে আগস্ট বেদনার মহাকাব্য ইতিহাসের সকল তটকে ছাড়িয়ে শ্রাবণের বারিধারায় অশ্রুজলে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। আগস্ট শোকের প্রতীয়মান অভিব্যক্তি বাঙালির হৃদয় নিঃসৃত যে অগ্নিদাহ তাকে বারবার প্রবল প্রতাপে দাহ্য করেছে। স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এই আগস্ট মাসের ১৫ তারিখ নারকীয়ভাবে হত্যা করা হয়। হন্তারকের কলুষতা যেন বাঙালির অধিকার আদায়ের বাতায়নকে চিরকালের জন্য অন্ধকারে নিমজ্জিত করবার পায়তারা করেছিল বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে। কিন্তু সে নৈরাশ্যের অমূলক চিন্তা যেন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া আদর্শের প্রখরতা আর ব্যাপ্তিতে। বঙ্গবন্ধু যেন তার আদর্শের মধ্য দিয়ে বাংলায় কোটি কোটি মুজিবের জন্ম দিয়ে গিয়েছিলেন। বাংলার বায়ু গিরি কিংবা দূরদূরান্তের হিমালয় সম স্পর্ধার অতলে বঙ্গবন্ধু জিইয়ে রেখেছিলেন বাঙালির অন্তর্নিহিত জীবনীশক্তি।
ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটি যদি হয় ১৫ আগস্ট, তবে মনে পড়ে যাবে সেই দিনের কথা। শ্রাবণের অন্তিম দিনে সেদিন বৃষ্টি নয়, ঝরেছিল বুকের তাজা রক্ত। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বিশাল বুক থেকে তাজা রক্ত ঝরেছিল ঘাতকের বুলেটের আঘাতে। সেদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডে এই বাংলাদেশেরই কতিপয় লোভী, বিশ্বাসঘাতক কুলাঙ্গার ও পথভ্রষ্ট সেনা সদস্য বাঙালি জাতির অসংবাদিত নেতা সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে বাঙালি জাতির ললাটে এঁকে দেয় কলঙ্কের তিলক। জনগণের মুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করা এই মানুষটির বৈষয়িক কোনো কিছুর প্রতি কোনো আকর্ষণ ছিল না। জনগণের ভালোবাসাই ছিল তার একমাত্র সম্পদ।
পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সুবেহ সাদিকের সময় যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে নিজ বাসভবনে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে বুলেটের বৃষ্টিতে ঘাতকরা ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল, তখন যে বৃষ্টি ঝরছিল, তা যেন ছিল প্রকৃতিরই অশ্রুপাত। ভেজা বাতাস কেঁদেছে সমগ্র বাংলায়। ঘাতকদের উদ্যত অস্ত্রের সামনে ভীতসন্ত্রস্ত বাংলাদেশ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল শোকে আর অভাবিত ঘটনার আকস্মিকতায়। কাল থেকে কালান্তরে জ্বলবে এ শোকের আগুন। ১৯৪৭ সালে ভ্রান্ত দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান নামক অসম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলেও স্বাধীন সত্তা নিয়ে সেদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি বাঙালি জাতি। বাঙালি জাতি ও তাদের ভূখণ্ডকে করা হয় পাকিস্তান রাষ্ট্রের অধীনস্থ। বাঙালির ওপর চেপে বসে পাকিস্তান রাষ্ট্রযন্ত্রের শাসন, শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতন আর নিপীড়ন। সেই নির্যাতিত বাঙালিকে সংগঠিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে ধাবিত হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার পর দেশ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী পদক্ষেপে বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে থাকে। দীর্ঘদিনের শোষিত-বঞ্চিত এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই সময়ও তিনি দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হন। সব ষড়যন্ত্রকে পাশ কাটিয়ে তিনি সম্মুখপানে দৃঢ়চেতা ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর এই সফলতা ও দেশকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নেওয়ার গতি বুঝতে পেরেই স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা তাকে হত্যার ছক কষে। বঙ্গবন্ধু একবার বলেছিলেন, তিনি শোষিত বঞ্চিত মানুষের পক্ষে সর্বদা কাজ করে যাবেন আর সেদিনই কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আজ থেকে একটি বুলেট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাড়া করবে’। এরই ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে আমরা দেখতে পাই বঙ্গবন্ধুকে ১৮টি বুলেটের মাধ্যমে হত্যা করা হয়। পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যার সময় বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র শেখ রাসেলও সেদিন ঘাতকের নির্মমতার হাত থেকে রেহাই পায়নি। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় সেদিন তারা প্রাণে বেঁচে যান।
বঙ্গবন্ধুর অগ্রণী ও দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কোচিত নেতৃত্বের উদাহরণ দিতে গেলে তিনটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করা যায়। প্রথমত, ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু ভূমি ও সমুদ্রের খনিজ সম্পদের উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা নিশ্চিত করে আইন প্রণয়ন করেন। কিন্তু পৃথিবীর অনেক দেশে তখনো এই আইনের কোনো ধারণাই ছিল না। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী রাষ্ট্রনীতির ফলস্বরূপ এই আইনের কালাকানুন ছিল বিশ্ববাসীর নিকট অতি শিক্ষণীয় একটি দৃষ্টান্ত। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধু তৎকালীন প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী তিনটি প্রতিষ্ঠান—আমিন অয়েল, দাউদ অয়েল এবং এসসো কোম্পানির নাম বদল করে যথাক্রমে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা করেন। এ ক্ষেত্রে স্বাধীনতা আন্দোলনের স্লোগান ‘তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা, মেঘনা, যমুনা’ তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। দেশের অর্থনৈতিক খাতগুলোকে প্রবল জাতীয়তাবাদের চাদরে সন্নিবেশিত করার এমন নজির সেসময়ে বিশ্বের আর অন্য কোনো দেশ বা তাদের নেতৃত্ব দেখাতে পারেনি। আর এতেই বঙ্গবন্ধুর স্বকীয় ও দিগ্বিজয়ী নেতৃত্বের স্তুতিগাথা বিশ্ববুকে মেঘের গর্জন হয়ে আছড়ে পড়ে। শেষ ধারাপাতের দিকে আলোকপাত করলে দেখা যায়— বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার ছয় দিন আগে, শেল ইন্টারন্যাশনালের কাছ থেকে তৎকালীন ৫টি গ্যাসক্ষেত্র কিনে নিয়ে এগুলোর উপর রাষ্ট্রীয় মালিকানা নিশ্চিত করেছিলেন। যা ছিল দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির সোপানে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
কালো চশমার আর দীর্ঘদেহের আতিশয্যে নিহিত শৌর্যবীর্যে যে বাংলাদেশের গৌরব নিহিত ছিল তা সেই স্বাধীনতা বিরোধীরা ঠিকই টের পেয়েছিলেন। তাইতো দেশে লুটপাট আর নৈরাশ্য কায়েমের ব্যর্থতায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করে তারা। কাল থেকে কালান্তরে এসেও আমরা এই স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিদের মাথাচাড়া দিতে দেখি। তাদের শিরদাঁড়া ভেঙে দিয়েই বাংলার মর্যাদা অনন্ত আকাশে প্রতিষ্ঠিত করা হবে বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাত ধরে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই