জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে। স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় স্বাধীনতার মহান স্থপতিকে নির্মম নৃশংসভাবে হত্যা করা কোন সাধারণ হত্যাকাণ্ড ছিল না। দেশি বিদেশি অনেক বড় ষড়যন্ত্র ছিল এর পেছনে। যে মানুষটি মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য চৌদ্দটি বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়ে দিলেন। নিপীড়ন নির্যাতন ছিলো যার নিত্যসঙ্গী। আর তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর ফাঁসির দড়ি যাকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডেকেছে তাকেই কিনা তারই স্বাধীন দেশে সপরিবারে হত্যা করা হলো! সেদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশকেই একেবারে শেষ করে দেয়া হয়েছিল। চক্রান্তকারী আর খুনিদের উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গবন্ধু পরিবারের আর কেউ যেন কোনদিন নেতৃত্ব দিতে না পারে। কিন্তু এক বুক বেদনা নিয়ে সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান তার দু’কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। যে কারণে সেদিন খুনিদের অভিসন্ধি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয়নি।
বাঙালির ইতিহাসের জঘন্যতম এই হত্যাকাণ্ডের বঙ্গবন্ধুর খুনিদের মাস্টারমাইন্ডেরা রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। তারা ইনডিমিনিটি অধ্যাদেশ জারি করে এবং সংবিধানে তা পাস করিয়ে নিয়ে খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে রাখেন। তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিলেন পঁচাত্তরের এই বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রধান মাস্টারমাইন্ড অবৈধ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দখলদার জিয়াউর রহমান। অবৈধ শাসক খুনি মোশতাক ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করলেও একে স্থায়ী আইনে পরিণত করেছিল জিয়াউর রহমানের বিএনপি সরকার। অতএব পঁচাত্তরের খুনিদের ‘উজিরে আজম’ কে ছিলেন তা সহজেই বোঝা যায়। তারপরে খুনিদের বিদেশে চাকরি দিয়ে পুনর্বাসন করা এবং তাদের স্বীকৃতিতেই জিয়ার নাম আসায় তা আরও স্পষ্ট হয়।
কিন্তু পঁচাত্তরের ঐ খুনি ও মাস্টারমাইন্ডদের বংশধররা তো বেঁচেই ছিলো। তারা আরও দুইবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। এবার তাদের ইচ্ছে হয় পনেরই আগস্টের অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার। আওয়ামী লীগকে কোনভাবেই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে না পেরে তারা এবার তাদের পুরানো খেলা আবার শুরু করে। এবারের টার্গেট বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তাকে শেষ করতে পারলেই কেল্লাফতে! শেখ হাসিনার সাথে সাথে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদেরকেও শেষ করে দেয়ার চূড়ান্ত চক্রান্ত আটে পঁচাত্তরে পনেরই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের প্রধান হোতার উত্তরসূরিরা। কারণ তখন তারা ক্ষমতায়। এবং ক্ষমতায় থেকে হাওয়া ভবন খুলে তখন অপরাজনীতির নেতৃত্ব দিচ্ছেন ঐ অবৈধ ক্ষমতা দখলদারের সন্তান। তার মা তখন প্রধানমন্ত্রী আর ক্ষমতার অংশীদার স্বাধীনতা বিরোধী জামাত। এবারের টার্গেট শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। তাছাড়া কোনভাবেই আওয়ামী লীগের সাথে পেরে ওঠা যাবে না। যে কারণেই ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে তার সন্ত্রাসবিরোধী জনসভার উপর গ্রেনেড হামলা করা হয়। এবারও সৌভাগ্যক্রমে অল্পের জন্য বেঁচে যান বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। কিন্তু নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। মানবপ্রাচীর তৈরি করে নিজেদের জীবনকে তুচ্ছ করে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা শেখ হাসিনাকে আগলে রাখেন। আল্লাহর অশেষ রহমতে এবারও বেঁচে যান শেখ হাসিনা। যদিও তাকে হত্যা করার জন্য আরও অনেকবার গুলি চালানো হয়েছে কিন্তু প্রতিবারই তিনি সৌভাগ্যক্রমে আল্লাহর ইচ্ছায় বেঁচে যান।
২০০৪ সালের তৎকালীন বিএনপি সরকারের প্রত্যক্ষ মদদেই যে এই গ্রেনেড হামলা ও হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছিল তা দিবালোকের মতই স্পষ্ট। এবং আদালতের রায়ই তাই প্রমাণ করে। ২১ শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয় আদালত। তার আগে থেকেই অন্য মামলায় প্যারোলে বিদেশ থাকায় এখন পলাতক দণ্ডিত আসামি হিসেবে দেশের বাইরেই অবস্থান করছেন হাওয়া ভবনের সেই যুবরাজ। পিতার দেখানো পথেই সে হাঁটতে চেয়েছে। খুন করেই প্রতিদ্বন্দ্বীকে চিরতরে শেষ করে দেয়ার এই খেলা পিতার মতোই সুনিপুণ ভাবে শুরু করেছিলেন তিনি। এখন যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে বিদেশে পলাতক থেকে মিডিয়ায় মাঝে মাঝে হম্বিতম্বি করে বেড়াচ্ছেন। আর ষড়যন্ত্রের জাল বুনছেন কিভাবে আবারো ১৫ আগস্ট ও ২১ আগস্টের মত ঘটনা ঘটানো যায়। সপরিবারে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে থাকা হাওয়া ভবনের এই নেতার বিরুদ্ধে শুধু এই রায়ই নয়; আরও দুটি দুর্নীতির মামলায় তার ১০ ও ৭ বছর কারাদণ্ডের রায় আছে।
২১ আগস্ট যে শেখ হাসিনাই প্রধান টার্গেট ছিলেন সে কথা এই ঘৃণিত হামলা বিশ্লেষণ করলেই বুঝা যায়। এই মামলায় ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের স্বীকৃতিতে জানা যায় তারেক রহমানের নির্দেশ ও প্রত্যক্ষ মদদেই এই গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এটা রাষ্ট্রীয় মদদে একটা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। খুনি ও খুনিদের নির্দেশদাতারা মনে করেছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পারলেই আওয়ামী লীগকে দমানো সম্ভব। যা পঁচাত্তরে তাদের পূর্বসূরিরা শুরু করেছিল। কিন্তু ওরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। ঘাতকেরা জানে না হত্যা করে ব্যক্তিকে শেষ করে দেয়া যায়, কোন আদর্শকে না। আওয়ামীলীগ জনগণের ভালোবাসায় সমৃদ্ধ একটি আদর্শিক দল। যে দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে দলের নেতৃত্বে আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। যার স্থপতি বঙ্গবন্ধু। যার নেতৃত্বে ত্রিশ লক্ষ মানুষ নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়ে শহীদ হয়েছেন। দুই লক্ষ মা-বোন ইজ্জত হারিয়েছেন। রক্তে ভেজা এই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর কারণেই পৃথিবীর বুকে স্বাধীন বাংলাদেশের পরিচিতি। আর তার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই আজকের এই সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ।
তাই বারবার বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাই টার্গেট। এখনো এই শক্তিদের প্রধান টার্গেট শেখ হাসিনা ও তার পরিবার। বিদেশে বসে এখনো প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে তারা। ক্ষমতায় থাকতে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করে সেই টাকা দিয়ে দেশি বিদেশি মিডিয়া ও লবিস্ট নিয়োগ করে শেখ হাসিনাকে ও তার সরকারকে শেষ করে দিতে। পলাতক দণ্ডিত এই ভুঁইফোড় নেতা দিনরাত ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন। এবার তিনি যোগ করেছেন দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে,পুলিশ বাহিনী ও বিচার বিভাগকে বিতর্কিত করতে। তার যত রাগ এখন দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও প্রশাসনযন্ত্রের উপর। তাই বিদেশে বসে অঢেল টাকা খরচ করে দেশপ্রেমিক এইসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও অপপ্রচার চালাচ্ছেন। উদ্দেশ্য ওই একই ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা।
রাজনীতিকে রাজনীতি দিয়েই মোকাবেলা করতে হয়। হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি করে হয়তো সাময়িক ভাবে সফল হওয়া যায়। কিন্তু তাতে দেশের ও দেশের মানুষের মঙ্গল হয় না। বঙ্গবন্ধু, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বারবার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। তারই অংশ হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। তা করে দেশের মহা সর্বনাশ করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে অনেক আগেই দেশ উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছে যেত। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশের অনেক মর্যাদা বৃদ্ধি পেত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে সেই পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছিল। হয়তো সেকারণেই আল্লাহপাক শেখ হাসিনাকে বারবার মৃত্যু দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনছেন। তার হাত ধরেই এদেশে তার পিতা এবং ত্রিশ লক্ষ শহীদের স্বপ্ন পূরণ করাবেন। বাংলাদেশের আজ যে অভূতপূর্ব উন্নতি তা হয়তো হতো না যদি শেখ হাসিনা ২১ আগস্ট বেঁচে না যেতেন। তাই যারা শেখ হাসিনাকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে চায়,তারা আসলে বাংলাদেশকেই চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে চায়। কিন্তু তা কোনদিন হবে না। আল্লাহর অশেষ রহমতে এবং ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও একসাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই দেশ পৃথিবীর বুকে আধুনিক, উন্নত, সমৃদ্ধশালী, মর্যাদাসম্পন্ন মানবিক দেশ হিসেবে বেঁচে থাকবে এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাও দেশের কল্যাণে কাজ করতে আল্লাহ পাকের রহমতের ছায়ায় বেঁচে থাকবেন। আর খুনিদের, ষড়যন্ত্রকারীদের ফেরারি আসামি হিসেবে, দুর্নীতিবাজ হিসেবে, কারাগারে না হয় ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবে সমাজে কোনমতে বেঁচে থাকতে হবে ।
এখন ২০০৪ সালের একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলাকারী সব খুনিদের বিচারের আওতায় এনে রায় কার্যকর করতে হবে। যেসব দণ্ডিত পলাতক আসামি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন তাদের চিহ্নিত করে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। বর্বর এই ঘৃণিত হত্যাকাণ্ডের খুনিদের সাজাভোগ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। এ ছাড়া নারী নেত্রী আইভি রহমানসহ সেদিন যারা শহীদ হয়েছিলেন তাদের আত্মা শান্তি পাবে না। একইভাবে পঁচাত্তরের পনেরই আগস্টের বাকি পলাতক খুনিদেরও ফিরিয়ে এনে ফাঁসির রায় কার্যকর করতে হবে। খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে তারা এই চক্রান্ত করতেই থাকবে। দেশের স্বার্থে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থেই সব দণ্ডিত আসামির সাজা নিশ্চিত করতে হবে। একুশে আগস্ট খুনিরা শুধু চব্বিশ জন মানুষকে হত্যাই করেনি, অনেক মানুষ এখন গ্রেনেডের স্প্লিন্টার নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় জীবন পার করেছেন। এই যন্ত্রণা নিয়ে আবার কেউ কেউ ইহলোক ত্যাগ করেছেন। যারা বেঁচে আছেন এবং যারা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা অন্তত দেখে শান্তি পাক এই বর্বর হামলা ও খুনের বিচারে প্রভাবশালীরা শাস্তি ভোগ করছে। তবুও কিছুটা হলেও তারা শান্তি পাবেন। এটাই এখন চাওয়া।
লেখক: কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ