একটি পারুল বোন আমাদের
২১ আগস্ট ২০২১ ১৮:৪০
আজ ভয়াল ২১ আগস্ট। শোকের মাস আগস্টের আরেকটি শোকাবহ কলঙ্কিত দিন। মৃত্যু-ধ্বংস-রক্তস্রোতের নারকীয় গ্রেনেড হামলার সতের বছর।
২১ আগস্ট,২০০৪। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তখন প্রধান বিরোধীদল হিসেবে বিএনপি-জামাত জোটের নির্মম-নৃশংস-বর্বরতার সামনে টিকে থাকার জন্য প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছিল।
এর আগে ২০০১ সালে দেশি-বিদেশি তৎপরতায় ষড়যন্ত্রমূলক নীল নকশার নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে পরাজিত করা হয়। এরপরেই শুরু হয় বিএনপি-জামাত জোটের নির্লজ্জ-নির্মম তাণ্ডবলীলা আর হত্যাযজ্ঞ। সারাদেশে সন্ত্রাস, সংখ্যালঘু নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর আর লুটের মহোৎসব। দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক ছাড়াও নির্বিচার হত্যা করা হয় সাধারণ মানুষকে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর চলে অত্যাচারের স্ট্রিমরোলার। আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে এমন কোনো পন্থা নেই যা দানবেরা সেসময় বেছে নেয়নি।
এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালে ২১ আগস্ট পরিচালিত হয় ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য, অমানবিক, সভ্যাতাবিবর্জিত এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। সংঘটিত হয় সভ্যতার ইতিহাসে অকল্পনীয় রাজনৈতিক হত্যাযজ্ঞ। যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত মরণঘাতী, ভয়ংকর গ্রেনেড চার্জ হয় রাজনৈতিক সমাবেশের উপর। গ্রেনেডের হিংস্র দানবীয় ধ্বংসযজ্ঞ আক্রান্ত করে মানবতাকে। রক্ত-ঝড়ের প্রচণ্ডতায় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মানব সভ্যতা, আর ধ্বংসের প্রচণ্ডতায় মলিন হয়ে যায় বাংলা ও বাঙালির মুখ। জীবন্ত বঙ্গবন্ধু এভিনিউ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণ এদিন মুহূর্তেই পরিণত হয়েছিলে মৃত্যুপুরীতে।
হামলার যাবতীয় তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে এটা এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা, দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে হত্যা করতেই মূলত এ হামলা পরিচালিত হয়।
১৯৮১ সালের ১৭ মে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী (আমরা যাকে ভালবাসে ‘আপা’ ডাকি) ৬ বছরের নির্বাসন জীবন শেষে সামরিক রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে যখন দেশে ফিরে আসেন তখন আমার জন্ম হয়নি। তবে বিভিন্ন লেখা থেকে এবং রাজনৈতিক অগ্রজদের কাছ থেকে শুনেছি— তখন চারদিকে লাখো কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল—
“শেখ হাসিনা ভয় নাই,
আমরা আছি লাখো ভাই।”
কিংবা
“ঝড়-বৃষ্টি-আঁধার রাতে
আমরা আছি তোমার সাথে।”
আপনজনকে বুক দিয়ে আগলে রাখার বা রক্ষা করার প্রতিজ্ঞা-প্রতিশ্রুতির সে স্লোগান নিজ চক্ষে অবলোকনের সৌভাগ্য আমার হয়নি।
কিন্তু ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট দেখেছি কিভাবে নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত শক্তিশালী গ্রেনেড আর গুলির সামনে দাঁড়িয়ে মানববর্ম তৈরি করে বুক দিয়ে আগলে রেখে আপার সেই লাখো ভাইয়েরা তাকে রক্ষা করেছিলেন।
একটিবারের জন্য সেই মুহূর্তে তাদের নিজের জীবনের কথা, পরিবারের কথা কিংবা অতি আদরের সন্তানের কথা মাথায় আসেনি। সেই মুহূর্ত তাদের একটাই লক্ষ্য ছিল ভয়াবহ সেই গ্রেনেডের, গুলির আঘাত থেকে আপাকে রক্ষা করা। নিজের জীবনে বিপন্ন করে তারা সেই কাজটিই তখন করেছিলেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন মানববর্ম কোনো নেতার জন্য তৈরি হয়েছিল কি না আমার জানা নেই। আপার প্রতি তার দলীয় নেতাকর্মী-সমর্থকবৃন্দের ভালোবাসা এর আগেও অনেকবার প্রমাণিত হয়েছে। এ যেন রূপকথার গল্পের সেই ভাইদের মতো, যারা মরিয়া তাদের পারুল বোনকে রক্ষা করার জন্য।
মানববর্মের ওই ছবিটির দিকে যতবার তাকাই শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-কৃতজ্ঞতায় মাথা নুয়ে যায় তাদের প্রতি—যারা সেদিন তাদের জীবনের মায়া ত্যাগ করে ‘পারুল বোন’কে বাঁচিয়েছিলেন। ছবিটি দেখলে এক অপার্থিব-স্বর্গীয় ভালোবাসার রেশ জড়িয়ে পড়ে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে। অবাক হয়ে ভাবি, সত্যি এমন করেও কি কাউকে ভালোবাসা যায়! আমার মতে, একজীবনে বঙ্গবন্ধুকন্যার সবচেয়ে বড় অর্জন মানুষের ভালোবাসা, আমাদের আপাও নিশ্চয় এমনটিই ভাবেন।
যুগ যুগ ধরে আওয়ামী লীগকে, বঙ্গবন্ধুকন্যাকে, বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরসূরিদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য নানা দিক থেকে মরণঘাতী আঘাত এসেছে। বারবার ঘাতকরা মরণকামড় দিয়েছে, তারপরও আল্লাহতায়ালা নিজে সুরক্ষিত করেছেন আমাদের আপাকে। আমি বলব, এখনও আপাকে জীবন দিয়ে রক্ষা করার জন্য শুধু লাখো নয়, কোটি ভাই সদাপ্রস্তুত আছেন। আর এভাবেই কোটি ভাইয়ের ভালোবাসায় সুরক্ষিত থাকবেন ‘আমাদের একটি পারুল বোন’, আমাদের প্রাণপ্রিয় আপা।
সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই