Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাখিবন্ধন—পরস্পরের হাতে হরিদ্রা বর্ণের সূত্র

হাবীব ইমন
২৩ আগস্ট ২০২১ ১৭:১১

এক.

আমার মধ্যে একটা পাগলামো আছে। এ পাগলামোর মাথাচাড়ার ব্যাপারটা বেশ পুরোনো, এটা ‘তুই’ জানিস। এ পাগলামোর জন্যে ‘তোর’ কাছে কম বকা খাইনি। বেশ মানানসই। আনন্দের সাথে আমি উপভোগ করি তোর বকা দেয়ার ভঙ্গি দ্যাখে। বকা দিতে দিতে মাঝে মাঝে বলে ফেলিস—‘আস্ত একটা বলদ হয়েছিস’। এসব আমাদের পাগলামো। আমাদের বোঝাপড়া। পাগলামোর মধ্যে কারো কারোর দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য হতে পারে। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে। জানিস তো আমি একটু অন্যধাতুতে গড়া। এসবের ধার কখনও ধারিনি। জানিস তো আমার মধ্যে এতোটুকু পঙ্কিলতা নেই। সঙ্কোচ কিংবা সংশয় নেই। আছে সরলতম রেখা। সরলতম বিশ্বাস। একদমই ‘নিট অ্যান্ড ক্লিন’। ক্রিস্টালের মতো স্বচ্ছ।

বিজ্ঞাপন

তুই যদি ‘কাজলা দিদি’ হতি, এ পাগলামীটা আমার থেমে থাকতো না। হয়তো বা বৃষ্টির মতোন অঝোরে অনবরত আরো চলতো। আমি উল্টো স্রোতে চলি না। ওই যে বললাম বাউণ্ডুলে ঝাঁজ থাকায় এসব ধার ধারি-না। চারপাশও এটাকে আমার পাগলামো হিসেবে ঠাঁই দিয়েছে। কিন্তু এ পাগলামোটাকে তারা মোটেও সরলভাবে দেখেনি, দেখেছে ত্রিনয়ন উঁচুতে বাঁকা করে। দোষ খোঁজার চেষ্টা করেছে। ওদেরও দোষ দিবো কীসে, এ তো আমাদের উপনিবেশিক-সাম্রাজ্যবাদের সমস্যা।

দুই.

‘ভাই-ফোঁটা’ নিয়ে রয়েছে অনেক লোককাহিনি। যমরাজ আর যমুনা ছিলেন যমজ ভাই-বোন। দুজনে আলাদা জায়গায় থাকতো। বহুদিন পরে যমুনার ইচ্ছা হলো ভাইকে দেখতে, খবরও পাঠালেন, অগত্যা বোনের অনুরোধে যমরাজকে আসতেই হলো। যমুনা ভাইকে আশির্বাদ করে টিকা পরিয়ে দিলেন। যমুনা এইদিন যমরাজের কপালে তিলক কেটে তার মঙ্গল কামনা করেছিলেন, সেই থেকে এই দিনে বোনেরা ভাইদের কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে মঙ্গল কামনা করে। মুখে বলে ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা, যমুনা দেন যমকে ফোঁটা, আমি দি আমায় ভাইকে ফোঁটা’। তবে ইদানিং ব্যাপারটার মধ্যে একটু মজাও তৈরি হয়েছে। ভাই বোনের সম্পর্কটা তো মজারই। তাই অনেক বোন মজা করে বলেন, ‘ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা, ভাই যেন হয় বিড়লা টাটা’।

বিজ্ঞাপন

তিন.

১৯০৫ সালে ব্রিটিশ রাজত্বকালে বাংলা ভাগ হয়। তার প্রতিবাদে রাখিবন্ধন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় ‘রাখিবন্ধনের দিন পরস্পরের হাতে ‘হরিদ্রা বর্ণের সূত্র’ বাধার আহ্বান জানালেন। লিখলেন রাখি-সংগীত। এ উৎসবের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলমানকে একসূত্রে গেঁথেছিলেন তিনি। অবাঙালিদের কাছে রাখি বন্ধন রক্ষা বন্ধন নামেও পরিচিত। কিন্তু বাঙালিদের কাছে রাখি কেবলই ভাই-বোনের মধ্যে আবদ্ধ নয়। সামাজিক গণ্ডি পেরিয়ে রাখিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও জায়গা দিয়েছে বাঙালিই।

চার.

রাখিবন্ধন উৎসবের দিন। বোনেরা তাদের ভাইয়ের হাতের মুঠায় রাখি নামে একটি হলুদ রঙের পবিত্র সুতো বেঁধে দেয়। তার পরিবর্তে ভাই-বোনকে উপহার দেয়। এই রাখিটি ভাইয়ের প্রতি বোনের ভালবাসা ও ভাইয়ের মঙ্গলকামনা এবং বোনকে আজীবন রক্ষা করার ভাইয়ের শপথের প্রতীক। হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে, শ্রাবণ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে এই উৎসব উদযাপিত হয়। উত্তর ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ে সহোদর ভাই-বোন ছাড়াও জ্ঞাতি ভাই-বোন এবং অন্যান্য আত্মীয়দের মধ্যেও রাখিবন্ধন উৎসব প্রচলিত। অনাত্মীয় ছেলেকেও ভাই মনে করে রাখি পরানোর রেওয়াজ রয়েছে। বাংলাদেশে ধর্মান্ধ মানুষের কারণে সাধারণের মধ্যে রাখিবন্ধন নিয়ে নানান মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। ফলে এদেশে রাখিবন্ধন সার্বজনীনতা পাচ্ছে না। যেখানে বিভিন্নভাবে আমাদের সম্প্রীতির মূল্যবোধের সঙ্কট। পারস্পরিক সহনশীলতা হারাচ্ছে। সেখানে সার্বজনীন অর্থে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে রাখিবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা ও আবেদনের কথা আমাদের ভাবতে হবে। তবুও বিচ্ছিন্নভাবে বন্ধুদিবস, বাংলা নববর্ষসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রাখিবন্ধনের চল রয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের সেই সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধকে আত্মস্থ করে শতাব্দী পেরিয়েছে ঠিক। কিন্তু রাখিবন্ধন আজ কেবল বাঙালির নয়, বিশ্বের ভাই-বোনের মৈত্রীর বন্ধন নয় শুধু, বিশ্ব মানবতা ও সৌভ্রাতৃত্বের প্রতীক বৈকি। রাশিয়ায় পালিত হয় ঐতিহ্যবাহী গেরোইভস্কি বা বিজয়সূচক রাখিবন্ধন। এছাড়া ইউক্রেন, এস্তোনিয়া, জার্মানী, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে রাখিবন্ধন উদযাপন হয়। এই রাখি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহীদ রুশী জনগণের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্যই বাধা হয়ে থাকে। বিশ্বযুদ্ধের পর বিজয় বেশে রুশী বীরদেরকে এই রাখি পরিয়ে বরণ করে নেয়া হয়েছিল।

পাঁচ.

মধ্য-সপ্তদশ শতকের রাজস্থানী লোকগাঁথায় একটি গল্প উল্লেখ আছে। তাতে কোনো কোনো ঐতিহাসিক সন্দেহ পোষণ করেন। কিন্তু রাজস্থানে গল্পটি বেশ জনপ্রিয়। চিতোরের রাণি কর্ণবতী ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট হুমায়ূনকে একটি রাখি পাঠান। গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহ চিতোর আক্রমণ করলে বিধবা রাণী কর্ণবতী অসহায় বোধ করেন এবং তিনি হুমায়ুনকে একটি রাখি পাঠিয়ে তার সাহায্য প্রার্থনা করেন। কর্ণবতীর রাখি পেয়ে অভিভূত হয়ে হুমায়ুন চিতোর রক্ষা করার জন্য সৈন্য পাঠান। তবে হুমায়ুনের সেনা পাঠাতে দেরি হয়ে গিয়েছিল। বাহাদুর শাহ রাণীর দুর্গ জয় করে নিয়েছিলেন। শোনা যায়, বাহাদুর শাহের সেনাবাহিনীর হাত থেকে সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য ১৫৩৫ সালের ৮ মার্চ রাণী কর্ণবতী ১৩,০০০ পুরস্ত্রীকে নিয়ে জহর ব্রত পালন করে আগুনে আত্মাহুতি দেন। চিতোরে পৌঁছে হুমায়ুন বাহাদুর শাহকে দুর্গ থেকে উৎখাত করেন এবং কর্ণবতীর ছেলে বিক্রমজিৎ সিংকে সিংহাসনে বসান।

ছয়.

স্কুলে থাকতে যতীন্দ্রমোহন বাগচীর লেখা পড়েছি, রবীন্দ্রনাথ পড়েছি কিংবা শরতের লেখাগুলো। তখন থেকে বোনের জন্য আমার ভালোবাসা একটু একটু করে নিগূঢ় হয়েছে। কাছের লোকরা এ সম্পর্কটাকে গোবর দিয়ে লেপ্টে দিতে চেয়েছে—‘সম্পর্ক যেনো রক্তের আখরে লেখা থাকে’। গোমূর্ত থেকে গোবর তৈরি হলেও অশুভ তাড়ানোতে গোবরের একটা বিশাল মুন্সিয়ানা থাকে, তা কিন্তু ওরা জানে না। জানে না বলেই কী অসীম ধৈর্য্যে গোবর লাগানোর কাজেই ব্যস্ত ছিল! আমি তো ভাই হার মানা নই। সম্পর্ককে আমি শ্রদ্ধা করতে জানি। সম্মান করতে শিখেছি। আমার মা শিখিয়েছে। আমার বোন শিখিয়েছে। কোনো ভয় আমাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। হয়তো এটা আমার স্বভাবের তেজ। দোষটা আসলে তেজের নয়, এতো আবেগ কেন আমার।

ভাই-বোনের সম্পর্কের গভীরতা যে কতো মধুময়, এটা কি আমরা তলিয়ে দেখেছি? বোন মানে কী, বোন মানে শত বিপদ-আপদে আগলে রাখা, আবদার আর খুনসুটির অবিচ্ছেদ্য অংশ; বোনরা কখনো বন্ধুও হয়ে উঠে—যার সাথে কারণ-অকারণে ঝগড়া করা যায়।

চারিদিকে অবিশ্বাস—সম্পর্কের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে জটিল রাজনীতি। রাখিবন্ধনের চল আবার শুরু করতে হবে। সম্পর্কের বিশ্বাসটাকে টেনে লাগাতে হবে। পুরানো সমাজকে ভাঙতে হবে। একটা নতুন সমাজ গড়ে তুলতে হবে। সম্প্রীতির সমাজ। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদহীন সমাজ। এই রাখিবন্ধন উৎসবে সম্প্রীতি যেভাবে জায়গা করে নিয়েছিলো, তা আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথ এই রাখিবন্ধন উৎসব নিয়েই গান লিখেছিলেন—‘বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল। পুণ্য হউক, পুণ্য হউক, হে ভগবান।’

সারাবাংলা/এসবিডিই

মুক্তমত রাখিবন্ধন—পরস্পরের হাতে হরিদ্রা বর্ণের সূত্র হাবীব ইমন

বিজ্ঞাপন

মাদকের টাকার জন্য মা'কে খুন
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ০৮:৫৭

আরো

সম্পর্কিত খবর