করোনা পরিস্থিতিতে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা
২৪ আগস্ট ২০২১ ১০:৩০
গত ২০ আগস্ট ছিল, বিশ্ব মশক (মশা) দিবস। ১৯৩০ সাল থেকে প্রতি বছরের এই দিনে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে কোভিড-১৯ এ সারা দেশের মানুষ শঙ্কিত। এর মধ্যেই বেড়েছে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা। ঠিক সেই পার হয়ে গেলো বিশ্ব মশা দিবস। প্রায় প্রতিবছরই মশাবাহিত ভাইরাস থেকে জ্বরে কাবু হয় ঢাকার মানুষ। এবারে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুজ্বর আরো ভয়াবহ আকার ধারন করেছে। এই মশা দিবসের কথা প্রথম বলেন ‘স্যার ডোনাল্ড রস’। ১৮৯৭ সালের ২০ আগস্ট, যেদিন প্রমানিত হয়েছিল মশাবাহিত রোগে স্ত্রী এনোফিলিস জাতীয় মশাই দায়ী। এ আবিষ্কার তাকে ১৯০২ সালে নোবেল পুরস্কার এনে দেয়।
বাংলাদেশে ২৯ প্রজাতির মশা থাকলেও এডিস প্রজাতির মশা দ্বারা সংক্রমিত ডেঙ্গু এ বছর মহামারী আকার ধারণ করেছে। এডিস মশা হলো ডেঙ্গু জ্বরের বাহক। বিদ্যমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতির ভেতরেই এডিস মশা বাহিত ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে। এর মধ্যে চলতি মাসেই গতবছরের মোট সংখ্যাকে ছাড়িয়ে অন্তত ১ হাজার ৪৩৯ জন ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, এ বছর জানুয়ারীতে ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে- ৯ জন, মার্চে ১৩ জন, এপ্রিলে ৩ জনসহ মে মাসে ডেঙ্গু শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৩ জনে। এরপর জুন, জুলাই ও চলতি আগস্ট মাসে সংখ্যা বেড়ে মারাত্মক আকার ধারণ করে। চলতি বছরে ১লা জানুয়ারী থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে মোট ৬ হাজার ৬৫০ জন। একই সময়ে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে ৫ হাজার ৫১০ জন। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২৬ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সরকারী হিসেবে দেশের হাসপাতালগুলোয় বর্তমানে ১ হাজার ১১৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়ে আছে। তাদের মধ্যে ঢাকার ৪১টি সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ১ হাজার ৪৮ জন এবং অন্যান্য বিভাগের হাসপাতালগুলোয় আরও ৬৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। সম্প্রতি ১৭ আগস্ট ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৩২৯ জন।এরমধ্যে রাজধানী ঢাকায় নতুন ভর্তি রোগী ৩০৬ জন এবং অন্যান্য জেলা ও বিভাগে নতুন ভর্তি হয়েছে ২৩ জন। ১৭ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল থেকে পাঠানো ডেঙ্গু ও সন্দেহজনক ডেঙ্গু রোগীর বিবৃতিতে এ তথ্য জানা যায়।
অসচেতনতা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাবের কারনেও ছড়ায় ডেঙ্গু ভাইরাস। এই ডেঙ্গু ভাইরাসের মাধ্যমে ছড়ায় ডেঙ্গু জ্বর। এডিস ইজিপ্টাই নামক এক ধরনের মশা এ ভাইরাস বহন করে। এ মশা কাউকে কামড়ালে তিনি চার থেকে ছয়দিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। এরপর ওই আক্রান্ত ব্যক্তিকে কোনো জীবাণুবিহীন এডিস মশা কামড়ালে সেই মশাটি ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণুবাহী মশায় পরিণত হয়। এভাবে একজন থেকে অন্যজনে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ছড়িয়ে থাকে। মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ জ্বর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রকট। বিশেষ করে গরম এবং বর্ষার সময়ে ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেশি থাকে। শীতকালে সাধারণত এই জ্বর হয় না বললেই চলে। সাধারণত শহর, নগর ও বন্দর এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব বেশি। কারণ ওইসব অঞ্চলের অভিজাত এলাকার নালা নর্দমা ও বড় বড় দালান কোঠা ও স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশার প্রকোপ বেশি থাকে। তবে বস্তি বা গ্রামের বাসিন্দাদেরও অপরিচ্ছন্নতার কারণে ঝুঁকি থেকেই যায়।
ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার অতি ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি পাওয়া গেছে রাজধানীর ১৯টি এলাকায়। যেখানে মশার ঘনত্ব ৫০ শতাংশের বেশি পাওয়া গেছে। এরমধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ১০টি এবং উত্তর সিটির ৯টি এলাকা রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চলমান জরিপে এই চিত্র উঠে আসে।মশার ঘনত্ব পরিমাপক সূচক হলো ব্রুটো ইনডেক্স (বিআই)।এর মাধ্যমে মশার লার্ভার উপস্থিতি হিসাব করা হয়। এই সূচক ২০ এর বেশি হলে পরিস্থিতি শর্তসাপেক্ষে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ ১০০ প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০টি বা তার বেশি যদি এডিসের লার্ভা পাওয়া যায় তবে সেটি ঝুঁকিপূর্ন উপস্থিতি হিসেবে গণ্য করা হয়।
করোনা পরিস্থিতিতে ডেঙ্গু পরিস্থিতিও বিপদজনক। সাম্প্রতিক সময়ে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ঢাকাতেই বেশি। এমন অবস্থায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এডিস মশা নিয়ন্ত্রনে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন এবারের ডেঙ্গুর মিউটেশন পূর্বের চেয়ে বেশি এটি ডেঙ্গুর নতুন কোন ভেরিয়েন্টও হতে পারে।এই ডেঙ্গু ভাইরাস শিশুদের বেশি আক্রমণ করে। ফলে তীব্র প্রকোপে শিশুরা মৃত্যুযন্ত্রনা ভোগ করে। আবার অনেকেই ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে।তবে একটু সচেতন হলেই ভয়াবহ ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে নিজেকে ও শিশুকে রক্ষা করা সম্ভব।
ডেঙ্গু জ্বর প্রতিরোধী টিকা কয়েকটি দেশে অনুমোদিত হয়েছে। তবে এই টিকা শুধু একবার সংক্রমিত হয়েছে এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কার্যকর। মূলত এডিস মশার কামড় এড়িয়ে চলাই ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায়। তাই মশার আবাসস্থল ধ্বংস করে মশার বংশবিস্তার প্রতিরোধ করতে হবে।এজন্য করণীয় হবে মশার বংশবিস্তারের উপযোগী বিভিন্ন আধার যেমন- ফুলের টব, বাসার ছাদ, পানির ট্যাপের আশেপাশে, ডাবের খোসা, গর্ত, টায়ার, নর্দমা প্রভতির পানি অপসারণ করতে হবে। শরীরের বেশিরভাগ অংশ ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরিধান করতে হবে। ডেঙ্গু জ্বর হলে পরিপূর্ণ বিশ্রাম নিতে হবে ও তরল খাদ্য গ্রহন করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলেন- হালকা জ্বর হলেই অনেকে পাত্তা দেয় না। কিন্ত এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের দিনেও এখন মশারি টানিয়ে ঘুমানো উচিৎ। কেননা এডিস মশা সকাল, সন্ধ্যায় কামড়ায়। এডিস মশা ভোরে সূর্যোদয়ের আধাঘন্টার মধ্যে ও সন্ধায় সূর্যাস্তের আধাঘন্টা পূর্বে কামড়াতে পছন্দ করে। তাই দিনে ঘুমানোর সময়ও মশারি ব্যবহার করুন ও ডেঙ্গুর কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করুন।
সরকারের উচিৎ করোনাকালীন এই মহামারির সময়ে ডেঙ্গু সম্পর্কে আরও বেশি জনসচেতনতা তৈরি করা ও কীটনাশক প্রয়োগ করা। তবে,কীটনাশক দিয়ে এদের আর সহজে দমন করা যায় না। সুতরাং মাত্রাতিরিক্ত ডোজ ভয়ানক হতে পারে। তাই কীটনাশকের ভুল প্রয়োগ বা অতি প্রয়োগ করা যাবে না। এ ব্যাপারে আরও সচতেন হতে হবে। কীটনাশক (এডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড) নির্বাচন করার আগে তা প্রথমে ল্যাব টেস্ট (টক্সিসিটি বায়োঅ্যাসে) করা। কোন কীটনাশক (এডাল্টিসাইড/লার্ভিসাইড) কোন পরিণত মশা বা লার্ভাকে সফলভাবে দমন করতে পারে তাও ল্যাবে টেস্ট করে (টক্সিসিটি বায়োঅ্যাসে) জেনে নিতে হবে এবং পরবর্তী সময়ে প্রয়োগ করতে হবে। লার্ভা দমন হচ্ছে মশা দমনের মূল কার্যক্রম। একে মশা দমনের প্রধান হাতিয়ার বলা হয়ে থাকে। তাই বেশি পরিমাণে লার্ভিসাইডিং করতে হবে এবং সঠিক, নিরাপদ ও কার্যকর লার্ভিসাইড ব্যবহারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। মাঠ পর্যায়ে কীটনাশক প্রয়োগের জন্য যারা কাজ করবে অর্থাৎ স্প্রে-ম্যানদের বিভিন্ন গ্রুপের কীটনাশক সম্পর্কে সম্যক ধারণা ও মশার জীবন সম্পর্কেও তাদের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। তাই ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ টেকনেশিয়ানে রূপান্তর করতে হবে। স্প্রেম্যানরা যেন শুধু শ্রমিক শ্রেণির না হয়, তাদেরও ট্রেনিং দিয়ে সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে সকলের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ এডিস মশাকে কোনোভাবেই আবাস গড়তে না দেওয়া। ডেঙ্গুর উপসর্গ দেখা দিলে অবহেলা না করে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ শাখা জানায়- সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর, উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার এন্টিজেন কিটের পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে। তাই উপসর্গ দেখা দিলে দেরী না করে দ্রুত পরিক্ষা করে নেওয়া উচিৎ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন – বর্তমানে দেশে অনেকেই ভাবছেন জ্বর মানেই কোভিড-১৯। তাই তারা ডেঙ্গু পরীক্ষা না করে অপেক্ষা করেন। কেউ কেউ কোভিড-১৯ পরীক্ষা করলেও ডেঙ্গু পরীক্ষা করছেন না। অনেকে কোভিড-১৯ ভেবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ঔষধ খাচ্ছেন। ফলে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে জ্বর হলেই যেন কোভিডের পাশাপাশি ডেঙ্গু পরীক্ষা করিয়ে নেন- সবার প্রতি এই আহ্বান। এছাড়া সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো সফল করার পাশাপাশি দেশের প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব নিজ নিজ বাড়ির চারপাশগুলো যেন এডিস মশার অভয়ারণ্য না হয়ে থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখা।
লেখক: শিক্ষার্থী, দ্বিতীয় বর্ষ, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই