Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বঙ্গবন্ধু ও মানবাধিকার এক সূত্রে গাঁথা

আবির হাসান সুজন
২৫ আগস্ট ২০২১ ১২:৪০

বিশ্বসন্মোহনী নেতাদের নামের তালিকায় বাঙালি জাতিসত্তার ধারক এবং স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার নায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম সবার আগে। তিনি তাঁর অসামান্য নেতৃত্ব, সাংগঠনিক দক্ষতা, সাহস, দেশপ্রেম ও ত্যাগ তিতিক্ষার মাধ্যমে বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে একটি নতুন মানচিত্র উপহার দিয়েছেন। বাঙালিদের মানবাধিকার রক্ষায় তিনিই ছিলেন পথ প্রদর্শক।

বঙ্গবন্ধু ও মানবাধিকার- এই দুটি শব্দ একই সূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধুর জন্মই হয়েছিল মানুষের অধিকার সুরক্ষার জন্য। শৈশব থেকে আমৃত্যু তিনি মানবাধিকারের প্রতি নিবেদিত ছিলেন। শিশুকাল থেকেই তিনি মানবদরদী ছিলেন। তাঁর জীবনের লক্ষ্য ছিল, দুঃখী মানুষের মুখে যেন হাসি থাকে। কিউবার মহান বিপ্লবী নেতা ফিদের কাস্ত্রো ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাতের পর বলেছিলেন- “আমি হিমালয় দেখিনি কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যাক্তিত্ব এবং সাহসিকতায় তিনিই হিমালয়।”

বিজ্ঞাপন

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারক-বাহক, উদ্দীপক ও মহানায়ক ছিলেন তিনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রে স্পষ্টভাবে বর্ণিত রয়েছে, বাংলাদেশের জনগণের জন্য সমতা, মানবসত্ত্বার মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। আর এগুলোর সমষ্টিই হলো মানবাধিকার। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগরের গঠিত ও গৃহীত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অনবদ্য দলিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে (Proclamation of Independence) স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয় মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য সম্পর্কে- বাংলাদেশের জনগণের জন্য সমতা, মানবসত্ত্বার মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধুর কাছে গণতন্ত্র ছিলো উদার, জাতীয়তাবাদ হচ্ছে বাঙালিয়ানা নির্ভর, সমাজতন্ত্র হচ্ছে চির উন্নত মম শির আর ধর্মনিরপেক্ষতা হলো ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। এ উদারনৈতিক, প্রগতিশীল দর্শন তাঁকে আত্মশক্তিতে বলীয়ান করে তোলে। তাই তিনি নির্দ্বিধায় বলেছেন, ‘ন্যায় আমাদের কর্মনীতি, আমাদের আদর্শ। জয় আমাদের অনিবার্য।’

মানব মুক্তির সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন অগ্রদূত। সহস্র বছরের নিপীড়িত, লাঞ্ছিত জনতার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন মুক্তির মহান ব্রত নিয়ে। উচ্চারণ করেছিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ নিজ জন্মভূমির অবহেলিত, বঞ্চিত মানুষকে তিনি ধীরে ধীরে সংগঠিত করেছিলেন মুক্তির মন্ত্র শুনিয়ে। ঔপনিবেশিক শোষণের নিগড়ে বাঁধা একটি পশ্চাত্পদ জাতিকে তিনি বিদ্রোহের, বিপ্লবের দীক্ষা দিয়ে স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করেছিলেন। জাতিকে তিনি সাহসের অভয়ারণ্যে তুলে এনেছিলেন সংগ্রামী চেতনায়। তাই প্রশিক্ষিত হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁরই অঙ্গুলি হেলনে জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রণাঙ্গনে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে প্রতিষ্ঠা করেছিল স্বাধীন দেশ। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি বিশ্ব মানচিত্রে জ্বলজ্বল করে উঠেছিল সেই ১৯৭১ সালে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ব পর্যায়ের নেতায় পরিণত হলেন। জন্মেছিলেন এ বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আর হূদয়ে ধারণ করেছিলেন পুরো বাংলাকে।

বাঙালি জাতিসত্তা সম্পর্কে সচেতনতার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল দরিদ্র, নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এই ভেবে যে এ নতুন রাষ্ট্রে দরিদ্র মুসলমান কৃষক জমিদার শ্রেণীর নির্যাতন থেকে মুক্তি পাবেন। তিনি সবসময় স্বাধীনতার আন্দোলনকে শুধু ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীন হওয়ার সংগ্রাম হিসেবে দেখেননি, তিনি এটাকে দেখেছেন নির্যাতিত দরিদ্র মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম হিসেবে। তাঁর জাতীয়তাবাদের ধ্যানধারণার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও সুষম সমাজ ব্যবস্থার চিন্তা। বাঙালির জাতিসত্তার স্বীকৃতির আন্দোলনকে তিনি সবসময় দেখেছেন একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে, শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির আন্দোলন হিসেবে।

আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পর মাত্র ১০ মাসের মাথায় বঙ্গবন্ধু যে সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন, সেই সংবিধানে ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ ঘোষিত ৩০টি অনুচ্ছেদ সংবলিত সর্বজনীন মানবাধিকার দর্শনের পুরোপুরি প্রতিফলন রয়েছে।

প্রথম সংবিধানেও মানবাধিকারের উপস্থিতি ছিল ‘সমতা’, ‘মানব মর্যাদা’ ও ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ রূপে। এগুলোই বিস্তৃতরূপে বর্ণিত হয়েছে বাহাত্তরের সংবিধানে, ২য় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে, ৩য় ভাগে মৌলিক অধিকার হিসেবে। ২য় ভাগের মানবাধিকার হলো অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান প্রভৃতি লাভের অধিকার। বঙ্গবন্ধু যদি উক্ত সংবিধান প্রণয়ন কমিটি না করে দিতেন কিংবা কোনও চক্রে বাহাত্তরে সংবিধান তৈরি না হতো তাহলে পাকিস্তানী প্রেতাত্মারা আর কখনও এ সংবিধান তৈরি হতে দিত না।

বাংলাদেশের সংবিধান মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার এক অনন্য দলিল। আর তার মুলে ছিলেন জাতির জনক। মানুষের মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষিত রয়েছে এই সংবিধানে। বেঁচে থাকার অধিকার, আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, নারী-পুরুষ সমানাধিকার, শিশুদের অধিকার, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকার, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি এবং কৃষক-শ্রমিকের উন্নয়নসহ সবকিছুই সন্নিবেশিত আছে বাংলাদেশের সংবিধানে। বঙ্গবন্ধুই আমাদের এই সংবিধান উপহার দিয়েছেন।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী চিন্তায় দ্রুততম সময়ে বাহাত্তরের সংবিধান প্রণীত হয়। এ সংবিধান জাতিকে উপহার দেয়ার পরই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট পাকিস্তানী চক্রের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হন। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন অন্যের অধিকার সুরক্ষা করতে গিয়ে ব্যক্তিগত জীবনের, নিজের আরাম-আয়েশের কথা ভাবেননি। অথচ তাঁর জীবন কেড়ে নেওয়া হয় মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনের মাধ্যমে। পাকিস্তানিরা যেখানে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সাহস করেনি, সেখানে এ দেশেরই একদল বিপথগামী সেনাসদস্য কল্পনাকেও হার মানিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

স্বাধীনতার পর তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায় তিনি কোনো বৈষম্য দেখতে চাননি। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে তিনি বলেন: ‘বাংলাদেশে মানুষে মানুষে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদের বণ্টনব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে এবং উচ্চতর আয় ও নিম্নতম উপার্জনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বী বৈষম্য এত দিন ধরে বিরাজ করছিল, সেটা দূর করতে হবে।’

মানবাধিকারের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকার ছিল অবিচল। বাংলাদেশের জনগণের ওপর তাঁর সন্দেহাতীত আস্থার কারণে তিনি বিশ্বাস করতেন এ দেশের জনগণের মূলমন্ত্র ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’পরিষ্কার ভাষায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘যারা সাম্প্রদায়িক তারা হীন, নীচ, তাদের আত্মা ছোট। যে মানুষকে ভালোবাসে সে কখনো সাম্প্রদায়িক হতে পারে না।’ বিজয় পতাকা ওড়াবেন বলে তিনি সেই ১৯৪৭-পরবর্তী সময় থেকেই ধীরে ধীরে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠেন। পরাধীনতার শিকলে বাঁধা জাতিকে করে তোলেন সংগ্রামী। সেই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঘোষণা করেছিলেন মুক্তির দিকনির্দেশনা। সেই ভাষণ বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণগুলোর অন্যতম আজও। বাঙালি জাতির অমূল্য সম্পদ শুধু নয়, এ ভাষণ বিশ্ববাসীরও সম্পদে পরিণত হয়েছে। বিশ্ববাসী চিনত বাংলাদেশ মুজিবের দেশ। বঙ্গবন্ধু ছিলেন লাখো বাঙালির দুর্বার কাণ্ডারি, মহীরুহের রূপকথার মহানায়ক। তিনি বিশাল হূদয়ের মানুষ ছিলেন, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকেও আপন জ্ঞান করতেন। সারাটা জীবন মানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

আবির হাসান সুজন বঙ্গবন্ধু ও মানবাধিকার এক সূত্রে গাঁথা মুক্তমত

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

উর্মিলার সংসার ভেঙে যাওয়ার কারণ
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২১:০২

নতুন পরিচয়ে কুসুম সিকদার
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ২০:৫৭

সম্পর্কিত খবর