সুনীল অর্থনীতির দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ
২৬ আগস্ট ২০২১ ১১:৩০
বেলজিয়ামের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক গুন্টার পাউলি ১৯৯৪ সালে ভবিষ্যতের অর্থনীতির রূপরেখা প্রণয়নের জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক আমন্ত্রিত হন। বিস্তারিত আলোচনা, গবেষণা আর নিজের অধীত জ্ঞানের মিশ্রণ ঘটিয়ে পাউলি একটি টেকসই এবং পরিবেশবান্ধব মডেল হিসেবে ব্লু ইকোনমির ধারণা দেন। বর্তমান বিশ্বে ব্লু ইকোনমি বা নীল অর্থনীতি বা সমুদ্র অর্থনীতিকে সম্ভাবনাময় বিকল্প অর্থনীতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ব্লু ইকোনমি এর আধুনিক সংজ্ঞায় বলা হয়েছে,সমুদ্রে যে পানি আছে এবং এর তলদেশে যে পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, সেসব সম্পদ যদি আমরা টেকসই উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করি তবে তাকে ব্লু ইকোনমি বা নীল অর্থনীতি বলে। মোট কথা ব্লু ইকোনমি বলতে সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতি কে বোঝায়। ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি দেশ।
ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে ২০১২ সালে টেকসই উন্নয়ন শীর্ষক জাতিসংঘ সম্মেলনে প্রথম উত্থাপিত হয় ‘ব্লু-ইকোনমি’। যার মুল উদ্দেশ্য ছিল জীবন মানের উন্নয়ন এবং সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। দেশের স্থলভাগে যে পরিমাণ সম্পদ বিদ্যমান, তার প্রায় সমপরিমাণ (৮১ শতাংশ) সম্পদ সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে।
বঙ্গোপসাগরের সীমানা নিয়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ চলে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে মিয়ানমারের সাথে ও ২০১৪ সালে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। যার ফলে ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমপরিমাণ টেরিটোরিয়াল সমুদ্র এলাকায় বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব, অধিকার ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার আয়তন প্রায় আরেকটি বাংলাদেশের সমান। আরও আছে ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল। আর চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে সব ধরনের সম্পদের ওপর রয়েছে বাংলাদেশের পুরো অধিকার।
বঙ্গোপসাগরের তলদেশে যে খনিজ সম্পদ রয়েছে তা পৃথিবীর আর কোনও সাগর, উপসাগরে নেই বলেও ধারণা করা হয়। এই সাগরের তলদেশে খনিজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে প্রায় ১৭ ধরনের খনিজ বালি। এর মধ্যে বেশি পরিমাণে পাওয়া যায় জিরকন, রুটাইল, সিলিমানাইট, ইলমেনাইট, ম্যাগনেটাইট, গ্যানেট, কায়ানাইট, মোনাজাইট, লিকোক্সিন ইত্যাদি। যার প্রত্যেকটি পদার্থই মূল্যবান, তবে মোনাজাইট অতিমূল্যবান পদার্থ। এই তেজস্ক্রিয় পদার্থ পারমাণবিক বোমা তৈরিতে ও পারমাণবিক চুল্লিতে শক্তি উৎপাদক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এই সাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছসহ ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ২০ প্রজাতির কাঁকড়া ও ৩৩৬ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক রয়েছে। এছাড়া রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সম্পদ। সমুদ্র জয়ের ফলে বঙ্গোপসাগরে ভারতের হাতে থাকা ১০টি গ্যাস ব্লকের মধ্যে আটটি এবং মিয়ানমারের অধীনে থাকা ১৩টির মালিকানা বাংলাদেশ পেয়েছে। এসব ব্লক থেকে প্রায় ৪০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া সম্ভব।
বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় রয়েছে ৪টি মৎস্যক্ষেত্র। মৎস্য সম্পদ ছাড়াও সামুদ্রিক প্রাণী, সামুদ্রিক আগাছা, লতা-গুল্মতেও ভরপুর বঙ্গোপসাগর। বঙ্গোপসাগরে আছে বিপুল পরিমাণ সামুদ্রিক আগাছা। এসব আগাছা প্রক্রিয়াজাতকরণ করে বিভিন্ন রোগের ওষুধ তৈরি করা যায়। এসব আগাছার মধ্যে স্পিরুলিনা সবচেয়ে মূল্যবান। চীন, জাপান, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মানুষ এগুলোকে খাদ্য হিসেবে খেয়ে থাকে।
তেল-গ্যাস ছাড়াও বঙ্গোপসাগরের তলদেশে ১৩টি জায়গায় সোনার চেয়ে অধিক মূল্যবান বালু অর্থাৎ ইউরেনিয়াম-থোরিয়াম রয়েছে যাতে মিশে আছে ইলমেনাইট, গানেট, সেলিমেনাইট, জিরকন, রুনটাইল ও ম্যাগনেটাইট।
গবেষণা সূত্রগুলো বলছে, ২০৫০ সালে পৃথিবীর জনসংখ্যা হবে প্রায় ৯০০ কোটি। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাবার যোগান দিতে তখন সমুদ্রের মুখাপেক্ষী হতে হবে। তাই আমাদের আগে থেকেই সতর্ক অবস্থানে থাকতে হবে। জোর দিতে হবে ব্লু ইকোনমি নীতিমালাতে।
ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোর গৃহিত পদক্ষেপগুলো পর্যালোচনা করতে হবে। এ কাজে বিদেশিদের সাহায্য ও পরামর্শ নেবার সাথে সাথে দেশের বাইরে যেসব বাংলাদেশী এইখাতে গবেষণায় ও কাজে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
সুনীল অর্থনীতির সুদূরপ্রসারী অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশকে কিছু পদক্ষেপ নিতেই হবে। নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত ও সঠিক পরিসংখ্যান করা যাতে বিনিয়োগকারীদের এই খাতে আকৃষ্ট করা যায় এবং এই খাতের উন্নয়ন করা যায়। প্রযুক্তি নির্ভরতা ও দক্ষ জনশক্তি নিয়োগ, ব্লু ইকোনমি সম্পর্কে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ণ করা। মাছ ও যেসব অনাবিষ্কৃত সমুদ্র সম্পদ আছে সেগুলোর বিজ্ঞানভিত্তিক অনুসন্ধান, পরিবেশবান্ধব সংগ্রহ ও টেকসই ব্যবহার নিশ্চিত করা। সমুদ্রভিত্তিক মাছ চাষ, সী-উইড চাষ, ঝিনুক চাষ এর পদ্ধতি অবলম্বন করতে উৎসাহিত করা।
বঙ্গোপসাগরের জৈব ও অজৈব সম্পদ রপ্তানি চুক্তি করা। প্রতিবেশী দেশ যেমন- নেপাল আর ভুটানকে পোর্ট সুবিধা দেওয়া। ব্লু-ইকোনমিতে এগিয়ে থাকা দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা ও পরামর্শ গ্রহণ যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সমুদ্র বিষয়ে মহাপরিকল্পনা, জাতীয় নিরাপত্তা ও সম্পদ উত্তোলনে জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের জন্য উদোগ নেওয়া। মৎস্যসম্পদ সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নের জন্য কর্মপন্থা প্রণয়ন, জাহাজ নির্মাণ শিল্প ও বন্দরসুবিধা বৃদ্ধি এবং পর্যটন ব্যবসা সম্প্রসারণ করা। আন্তর্জাতিক সীমা লঙ্ঘন আইন, ‘এফ এ ও কোড অফ কন্ডাক্ট ফর রেস্পন্সিবল ফিশারিজ (সি,সি,আর,এফ)’ এর ধারাসমূহের সর্বোচ্চ বাস্তবায়ন করা।
সামগ্রিক বিষয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যারিটাইম রিসার্চ এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিমরাড), বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ভূমিকা রাখা। সমুদ্র নির্ভর শিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারে কার্যকরী সকল ধরনের পদক্ষেপ ও পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। মেরিন সায়েন্সের বিকাশে ও স্থানীয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে হবে আর এ লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়ণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ভুমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগ; জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
আবির হাসান সুজন মুক্তমত সুনীল অর্থনীতির দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ