হৃদয় ছেঁড়া আগস্ট, শেষ হয়েও দাগ রেখে যায়
২৭ আগস্ট ২০২১ ১০:৩০
কালজয়ী চিন্তানায়ক ও মানবতাবাদী সাহিত্যক অন্নদাশঙ্কর রায় বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে রচনা করেন তার অমর পংক্তিমালা-
“যতকাল রবে পদ্মা যমুনা, গৌরী মেঘনা বহমান
ততকাল রবে কীর্তি তোমার, শেখ মুজিবুর রহমান।
দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা, রক্তগঙ্গা বহমান
তবু নাই ভয় হবে হবে জয়, জয় মুজিবুর রহমান।”
১৫ আগস্ট ৭৫ সাল। রাতের অন্ধকারের শেষ রেশ টুকু ফিকে হয়ে আসতে শুরু করেছে। সেই কালরাতে ঘাতকের দল এগিয়ে এলো ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ড ঘটাবার জন্যে। এরপরের ইতিহাস বেদনার। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুতে সারা জাতি শোকে মুহ্যমান, বেদনায় নীরব, নিস্তব্ধ। ১৯৭৫ সালের এমনি এক অভিশপ্ত দিনের একদল খুনী, দুস্কৃতকারী, পাষন্ড রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের ঐতিহাসিক ‘বঙ্গবন্ধু ভবনে’ হানা দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে বাঙালি জাতির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান কাঙ্খিত পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং তার পুরো পরিবারকে। বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে সেদিন তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছিলেন না। বড় মেয়ে শেখ হাসিনা স্বামীর সঙ্গে ছিলেন জার্মানিতে। তাদের সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানাও। তাই বেঁচে যান তারা।
৭৫-এর ১৫ আগস্টের বাঙালির নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারের নির্মম হত্যাকান্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় ২৩ জুন, ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে পাতানো যুদ্ধের পরাজয়ের পর বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর চক্রের হাতে মুর্শিদাবাদে নির্মমভাবে শহীদ বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং তার পরিবারের বিয়োগান্তক ঘটনা।
আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, “Some people can be fooled for some time, But all people cannot be fooled for all time।” বঙ্গবন্ধুর হত্যার সকল দুরভিসন্ধির সাথে সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী ও পাকিস্তানী চক্র এবং তাদের এ দেশীয় দালালদের গোপন আঁতাতের কথা আজ দেশের মানুষের কাছে পরিস্কার হয়ে গেছে। আজ মানুষ বুঝতে পেরেছে বঙ্গবন্ধু হত্যার উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে বাংলাদেশের নাম চিরতরে মুছে ফেলবে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে। কিন্তু তাদের সেই বিশ্বাসঘাতকতা, উচ্চভিলাসী ধ্যানধারণা বাস্তব রূপ লাভ করেনি। সূর্য অস্তমিত হলেই তারপর জোনাকিরা জ্বলে। কিন্তু জোনাকিরা কখনোই সূর্যের বিকল্প হতে পারে না। যতোই দিন যাচ্ছে এ সত্য স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বদলা নিতে হলে তার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিকদের নতুন করে শপথ নিতে হবে। নূতন প্রত্যয়ে বলীয়ান হয়ে শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে এবং বঙ্গবন্ধুর কাঙ্খিত অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিতে পারলেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বিদেহী আত্মা শান্তি পাবে। বাংলার মানুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যার রায়ের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন চায়। আর তা ই হবে তার প্রতি কৃতজ্ঞ জাতির সর্বোৎকৃষ্ট সম্মান প্রদর্শন।
কেমন ছিলো পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট এবং এর পরবর্তী সময়? কি কি লেখা হয়েছিল সম্পাদকীয় পাতায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে? জানতে অনেক ইচ্ছা করে তাই না? আজ জানবো তারই কিছু কথা।
১৯৭৫ সালের ১৬ অগাস্ট ভোরে বাজারে আসা ওই সময়কার সর্বাধিক প্রচারিত বাংলা দৈনিক ইত্তেফাকের ৬ কলামের শিরোনাম ছিল- ‘খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনীর শাসনক্ষমতা গ্রহণ’। এই প্রতিবেদনের ‘ইন্ট্রো’ বা সংবাদ সূচনাতেও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের খবর ছাপিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও সেনাবাহিনীর ক্ষমতা ‘গ্রহণ’ই প্রাধান্য পেয়েছিল। সংবাদপত্রটির প্রতিবেদনের শুরুটা হয়েছিল এভাবে-
“রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী বৃহত্তর স্বার্থে গতকাল প্রত্যুষে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া দেশের শাসনভার গ্রহণ করিয়াছেন।” এরপর লেখা হয়েছিল, “শাসনভার গ্রহণকালে সাবেক রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বীয় বাসভবনে নিহত হইয়াছেন।” ছয় কলামের এই সংবাদটির পাশেই দৈনিক ইত্তেফাক দুই কলামে ‘ঐতিহাসিক’ নবযাত্রা’ নামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। ওই সময় পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন নুরুল ইসলাম পাটোয়ারী; বার্তা সম্পাদক ছিলেন আসাফউদ্দৌলা রেজা। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্পাদিত দৈনিক ইত্তেফাককে স্বাধীনতার আগে আওয়ামী লীগের মুখপত্র হিসেবেই মনে করতেন পাঠকরা।
১৯৭৫ সালের ১৬ অগাস্ট ‘দৈনিক বাংলা’ দৈনিকটির প্রথম পাতার অন্যান্য সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘দুর্নীতির সঙ্গে আপোস নেই’, ‘জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করা হবে: রাষ্ট্রপতি’, ‘দশজন মন্ত্রী ও ছয়জন প্রতিমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ’, ‘নয়া সরকারের সাথে যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যাবে’, ‘অচল শতকী নোটের ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত মূল্য ফেরত দেয়া হবে’, ‘পাকিস্তানের স্বীকৃতি দানের সিদ্ধান্ত’। মূল শিরোনামের নিচে পত্রিকাটির প্রথম কলামে ‘আওয়ার কমেন্টস’ নাম দিয়ে একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছিল; যার শিরোনাম ছিল, ‘অন দ্য থ্রেশলড অব দ্য নিউ এরা’।
সম্পাদকীয় পাতার শিরোনামগুলো লক্ষ্য করলে বুঝতে পারা যায় যে সম্পাদকীয় পাতায় বঙ্গবন্ধুকে হারানোর বেদনা তেমন ফুটে ওঠে নি। তবে বঙ্গবন্ধুকে হারানোর বেদনা আজ প্রতি ঘরে ঘরে দৃশ্যমান।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই
কবিতা রাণী মৃধা মুক্তমত হৃদয় ছেঁড়া আগস্ট- শেষ হয়েও দাগ রেখে যায়