চালের গায়ে আগুন কেন?
৩১ আগস্ট ২০২১ ১১:০১
করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে সারা বিশ্বের দুই শতাধিক দেশের মতো বাংলাদেশও এই ভয়াল থাবায় আক্রান্ত। পাল্টে গেছে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের গতিধারা। করোনার ভয়াবহ অবস্থার কারণে সমাজের মানুষ যখন আতঙ্কিত এবং হতাশাগ্রস্ত, এরমধ্যেও বেড়ে চলেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা জিনিসের দাম। যার প্রভাব পড়ছে সমাজের খেটে খাওয়া ও মেহনতি মানুষদের ওপর। একের পর এক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমাদের।
করোনাকালে সবারই আয় কমেছে। লোকসানের ধাক্কা সামলাতে না পেরে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।বর্তমানে সীমিত ও নিম্ন-আয়ের মানুষ একপ্রকার দিশাহারা। লকডাউন খুলে দিলেও নিত্যদিনের কাজের সংকটে দিন মজুরেরা। এর মাঝে কখনও পেঁয়াজের দাম, কখনও আলু, কখনও আবার সবজি এসব নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়তেই আছে। এখন আবার দ্রুত গতিতে বেড়েছে চালের দাম। বলা হয়ে থাকে, ক্ষুধা থাকলে নুন দিয়েও ভাত খাওয়া যায়। কিন্তু ভাতই যদি না থাকে তবে এই খেটে খাওয়া মানুষগুলো খাবে কি? উচ্চহারে চালের দাম যদি বেড়ে যায়, তাহলে সীমিত আয়ের শ্রমজীবী কী পরিমান দুর্ভোগের শিকার হবে, তা সহজেই বোঝা যায়।
বাজারে হঠাৎ করেই যখন দ্রব্যের দাম বেড়ে যায় স্বাভাবিকভাবেই বিপাকে পড়ে স্বল্প আয়ের মানুষ। কারণ দ্রব্যের দাম বাড়লেও বাড়ে না তাদের আয় রোজগার। ফলে আগের সেই নির্দিষ্ট আয় থেকেই তাকে কেনাকাটা করতে হয়। যে কারণে চরম বিপাকে পড়তে হয় সাধারণ মানুষদের।
সাধারণত কোনো দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পায় তখনই যখন বাজারে ক্রেতাদের চাহিদার তুলনায় দ্রব্যের উৎপাদন বা যোগান কম থাকে। কিন্তু এবারে রেকর্ড পরিমান আমন ধান হওয়ার পরেও চালের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই শুরু থেকে দফায় দফায়।
চাউলের দামের ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে কয়েকদিন ধরে দেশের জাতীয় পত্রিকাগুলোতে অনেক প্রতিবেদন আসছে। প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, চালের দাম বাড়তেই আছে, দাম কমাতে সরকার শুল্ক কমিয়ে বেসরকারি খাতে আমদানির সুযোগ দিয়েছে। গত ছয় মাসে বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় আট লাখ টন চাল আমদানি হয়েছে। সরকার নিজে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টন আমদানি করে গত বছরের তুলনায় খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) কার্যক্রমসহ অন্যান্য খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি বাড়িয়েছে। কিন্তু এসব উদ্যোগের কোনো প্রভাব নেই বাজারে। চালের দাম কমছে না বরং মাঝেমধ্যে বাড়ছে। চড়া দামেই চাল কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। বাড়তি দামের কারণে করোনার মধ্যে গরিব মানুষের কষ্ট বেড়েছে।
চাল ব্যবসায়ী, সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চালের চড়া দামের কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, প্রকৃত উৎপাদন ও চাহিদার সঠিক তথ্য নেই। যে কারণে নীতি-উদ্যোগ ঠিকমতো কাজ করছে না। সরকারের হাতে যে মজুদ আছে, তা বাজারে হস্তক্ষেপ করার জন্য যথেষ্ট নয়। দেশের বাজারের সিংহভাগ সরবরাহ বড় ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়া এবং ধানের দাম বাড়ার কারণে চালের দাম কমছে না।
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের বাজারগুলোতে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা কেজি দরে মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে। মাঝারি মানের চালের দাম ৫০ থেকে ৫৬ টাকা। সরু চালের কেজি ৬০ থেকে ৬৮ টাকা। এই দর গত কয়েক বছরের মধ্যে বেশি। গত বছরের তুলনায় মোটা চাল ৩.২৬ শতাংশ, মাঝারি মানের চাল ৩.৯২ শতাংশ এবং সরু চাল ৮.৪৭ শতাংশ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
অথচ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে গত বছরের তুলনায় চালের দাম কমেছে। সেক্ষেত্রে আমাদের সংকট মূলত কোন জায়গায় তা ক্ষতিয়ে দেখতে হবে এবং সমাধান করতে হবে।
আমরা এর আগে দেখেছি যে, চালের বাজার স্থিতিশীল রাখতে গত ৭ জানুয়ারি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ এক প্রজ্ঞাপনে চালের আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমিয়ে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করে। পাশাপাশি আমদানিতে সব ধরনের নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়। সরকার চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে দেশের সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস) কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ১৯ আগস্ট পর্যন্ত ওএমএসের মাধ্যমে দুই লাখ ৫৯ হাজার টন চাল বিতরণ করেছে খাদ্য অধিদপ্তর।
উৎপাদন ও আমদানি পরিস্থিতি হিসাবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে আউশ ও আমন মিলিয়ে এক কোটি ৭৭ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়েছে, যা আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরের তুলনায় সাড়ে সাত লাখ টন বেশি। আবার বোরোর ফলনও ভালো হবে বলে আশা করছে সংস্থাটি।
অন্যদিকে, খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ১৩ লাখ ৫১ হাজার টন চাল আমদানি হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এ কয়দিনে সরকার দুই লাখ ২৭ হাজার টন আমদানি করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে চাল আমদানি বাবদ গত অর্থবছরে মূল্য পরিশোধ হয়েছে আগের অর্থবছরের তুলনায় ৪০ গুণ বেশি। বাজার পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার পুনরায় কম শুল্কে আমদানির অনুমোদন দিয়েছে। ইতোমধ্যে ৩১৬টি প্রতিষ্ঠানকে ১১ লাখ ৮২ হাজার টন সেদ্ধ ও আতপ চাল আমদানির অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এতকিছুর পরেও যখন আমরা দেখি যে দিনের পর দিন চাউলের দাম বাড়তেই আছে তখন আমাদেরকে ভাবায় যে, আসলে কেনো চালের দাম এভাবে বাড়তেই আছে?
সাধারণত চাউলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে বড় বড় মিল মালিকেরা। এর মধ্যে কিছু কুচক্রি আছে যারা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় ইচ্ছাকৃতভাবে বাজারে পণ্যের সংকট সৃষ্টি করে এবং সংকট দেখিয়ে বাজারে পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করে নেয়। আর যার যাতাকলে পড়ে নিষ্পেষিত হয় স্বল্প আয়ের মানুষেরা। দু’মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য তাদের পরিকল্পনার কাছে জিম্মি আমরা। জনসাধারণের কথা চিন্তা করে, সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের কথা চিন্তা করে চালের বাজার খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। বাজারের চালের দাম নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনকে আরও বেশি তদারকি করতে হবে। অদৃশ্য এই কালো হাতকে রুখতে হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়