আত্মহত্যা নয়— স্বপ্ন দেখতে হবে, দেখাতে হবে
১ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৯:২৯
একটি দুঃখজনক, বেদনাদায়ক কিন্তু বর্তমান সময়ে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ ‘আত্মহত্যা’। প্রতিদিনই পত্রিকার পাতা মেললেই মিলছে আত্মহত্যার খবর। তরুণ, যুবা, বৃদ্ধ— আত্মহত্যার তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছে না কেউ। আত্মহত্যার নেই শ্রেণিপেশার বাছবিচারও। নিজের জীবন নিজে শেষ করে দেওয়ার এই প্রবণতা বর্তমানে দেশের একটি বড় ধরনের সামাজিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেবল দেশেই অবশ্য নয়, আত্মহত্যা বিশ্বব্যাপীই একটি বড় সমস্যা।
আত্মহত্যা বা আত্মহনন (ইংরেজি: Suicide) হচ্ছে কোনো ব্যক্তির স্বেচ্ছায় নিজের জীবন বিসর্জন দেওয়া বা স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণনাশের প্রক্রিয়া ঘটানো। ল্যাটিন ভাষায় ‘সুই সেইডেয়ার’ থেকে আত্মহত্যা শব্দটি এসেছে, যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে হত্যা করা।
করোনাভাইরাস মহামারি চলাকালে এক বছরে সারাদেশে ১৪ হাজারেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে। তরুণদের সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এক তথ্যমতে, করোনাকালে বাংলাদেশে ১৪ হাজার ৪৩৬ নারী-পুরুষ আত্নহত্যা করেছে। আচল ফাউন্ডেশনের আরেক তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে দেশে আত্মহত্যার পরিমাণ ছিল ১০ হাজার। সে হিসাবে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে আত্মহত্যার পরিমাণ ৪৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেড়েছে।
করোনা সংক্রকমণের এই সময়ে পুরুষদের চেয়ে নারীদের আত্মহত্যার পরিমাণ বেড়েছে। বিভিন্ন ধরনের পারিবারিক সমস্যার কারণে ৫৭ শতাংশ নারী ও ৩৫ শতাংশ পুরুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। পারিবারিক জটিলতা, সম্পর্কের অবনতি, পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, আর্থিক সংকট— এসব আত্মহত্যার ঘটনার মূল কারণ।
আবার করোনা সংক্রমণের সময়ে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যাও লাগামহীনভাবে বেড়েছে। আর্থিক ও লেখাপড়ার কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৪১ শতাংশ। তাই শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে। মা-বাবার উচিত করোর এই সময়ে ছেলেমেয়েদের পাশে বন্ধুর মতো থাকা। তাদের একটু বেশি খেয়াল রাখা। মানসিকভাবে সহায়তা করা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, সারাবিশ্বে বর্তমানে প্রতি বছর গড়ে ১০ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করছেন। আর যারা আত্মহত্যার চেষ্টা করে কোনো-না-কোনো কারণে ব্যর্থ হয়েছেন, তাদের সংখ্যা আত্মহত্যাকারীদের ২০ গুণ। আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি পূর্ব-ইউরোপের দেশগুলোতে এবং সবচেয়ে কম ল্যাটিন আমেরিকায়।
জন্ম থেকেই মানুষ নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বড় হয়। মানবজীবনে স্বাভাবিকভাবেই রয়েছে সুখ ও দুঃখ। এই দুইটা নিয়েই মানবজীবন রচিত। মানুষের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা সবসময় পূরণ হয় না। আত্মহত্যার অনেক কারণ রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— কিছু অর্জন করার আশা করে তা অর্জন করতে না পারার ব্যর্থতা, মা-বাবাসহ আপনজনের অকাল মৃত্যুজনিত বেদনা বা শোক, হৃদয় দিয়ে ভালোবেসে সেই ভালবাসার মানুষটিকে কাছে না পাওয়ার মনোকষ্ট, পড়ালেখা নিয়ে হতাশা, উচ্চ শিক্ষা অর্জন করেও কর্মসংস্থান না হওয়ায় বেকারত্বজনিত হতাশা, ঋণের বোঝা, মেয়েদের প্রতি বখাটেদের উৎপাত, মা-বাবার সামান্য বকুনি, নারী নির্যাতন, যৌতুক, ধর্ষণ ও ব্ল্যাকমেইল কিংবা অভিমান— এই কারণগুলোতে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে। আত্মহত্যার এ প্রবণতা একদিকে যেমন আমাদের সামাজিক সমস্যাকে প্রকট করে তুলছে, তেমনি উদ্বিগ্ন করে তুলছে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রকে।
বাংলাদেশের কোনো আইনে আত্মহত্যার কোনো সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। কেবল দণ্ডবিধি আইনে অন্যকে খুন করা এবং নিজেকে খুন করা (আত্মহত্যা) উভয়কেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে দেখানো হয়েছে। দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারা অনুযায়ী, যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করার উদ্যোগ করে এবং এরকম অপরাধ করার উদ্দেশ্যে কোনো কাজ করে, সে ব্যক্তি বিনাশ্রমে কারাদণ্ড ভোগ করবে, যার মেয়াদ এক বছর পর্যন্ত সাজা হতে পারে বা অর্থদণ্ড হতে পারে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। আর আত্মহত্যায় সহায়তা বা প্ররোচনাকারীর জন্য দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারা অনুযায়ী ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে সমাজের নীতিনির্ধারকদের সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে। আর ছেলেমেয়েদের ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। প্রতিটি ধর্মেই আত্মহত্যাকে গর্হিত কাজ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আত্মহত্যা একটি সামাজিক ব্যাধি। আমরা চাইলেই আত্মহত্যাকে হার মানাতে পারি।
আত্মহত্যা নামক সমাজের আবর্জনাকে আমরাই পারি উৎখাত করতে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সমাজ ও পরিবারে আত্মহত্যার কুফল ও ভয়াবহতা এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক নানা সভা-সেমিনার চালুর মাধ্যমে আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তিকে দোষারোপ না করে তাদের মানসিকভাবে সহযোগিতা বা অবলম্বন দেওয়ার জন্য প্রতিটি সচেতন নাগরিককে এগিয়ে আসতে হবে।
একইসঙ্গে সিনেমা-নাটক, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় জীবন সম্পর্কে সচেতন হওয়া ও আত্মহত্যার কুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তুলতে পারলে তবেই আত্মহত্যা প্রবণতা অনেকটা কমে আসবে।
সামাজিক সমস্যা আত্মহত্যার বিরুদ্ধে আমাদের উচিত যুদ্ধ ঘোষণা করা। সামাজিক এ মহাব্যাধি থেকে মানবতাকে মুক্ত করা আমাদের সবারই দায়িত্ব।
মনে রাখতে হবে, জীবনে অভাব বা অপ্রাপ্তি থাকবে— এগুলো জীবনেরই অংশ। তাই বলে ভেঙে পড়লে চলবে না। অভাব পূরণ করতে আমাদের ঘুমিয়ে নয়, জেগে জেগে স্বপ্ন দেখতে হবে। আকস্মিক দুর্যোগ বা বিপদে ভেঙে না পড়ে সমস্ত প্রতিকূলতা মোকাবিলায় ধৈর্য ধরতে হবে দৃঢ় চিত্তে। এগুলোকে জয় করার জন্য চালাতে হবে দৃঢ় প্রচেষ্টা। দুঃখ, কষ্ট, বিপদ দেখে শঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। অন্ধকারই কেবল মানুষের জীবনে অনিবার্য সত্য নয়, আঁধারের মাঝেই আবার উদিত হবে স্নিগ্ধ চাঁদ। দূরীভূত হবে জীবনের সব অন্ধকার।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই/টিআর