ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভাবনা এবং আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৩:৩৯
তালেবান কাবুল দখলের প্রায় একমাস হয়ে গেলো। এর মধ্যেই আমরা কাবুল বিমানবন্দরে হতাশ আফগানদের ছুটে আসার ছবিগুলি দেখেছি, যা খুবই অপ্রত্যাশিত এবং যথেষ্ট হতাশাজনকও বটে। তবে সমবেত জনতার উপর মারাত্মক হামলা অবশ্যই ঘৃণিত একটি অপরাধ ছিল। শেষ উচ্ছেদে ফ্লাইটগুলি কাবুল ছাড়ার আগে, ইউরোপীয় নেতারা কৌশলগত স্বায়ত্তশাসনের জন্য নতুন আবেদন শুরু করেছিলেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক ও নিরাপত্তা নীতির উচ্চ প্রতিনিধি জোসেপ বোরেল বলেছিলেন, ‘সেনা প্রত্যাহার মানে নতুন করে জেগে ওঠার আহ্বান, যা ইউরোপীয় ইউনিয়নকে তার নিরাপত্তা ক্ষমতা আরো বিনিয়োগ করতে এবং কৌশলগত দিক থেকে চিন্তা করার এবং কাজ করার ক্ষমতা বিকাশে উদ্বুদ্ধ করবে’।
এ কথা বলাই যায় যে, আফগানিস্তানে যুদ্ধের বিশৃঙ্খল ও অবমাননাকর সমাপ্তির সাথে সাথে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ও ঘটলো। যা আমেরিকান নেতাদের উত্তরাধিকার সূত্রে ধারাবাহিক রাজনৈতিক ভুল হিসাবের ফলাফল। ইউরোপ তথা পশ্চিমা সমর্থিত আফগান সরকারের দ্রুত পতন এবং তালেবানদের ক্ষমতায় ফেরার ফলে ন্যাটোর ভবিষ্যৎ এবং ট্রান্স আটলান্টিক সম্পর্ককে আরও ব্যাপকভাবে নিরাপত্তাহীনতার সম্মুখীন করতে পারে। সেক্ষেত্রে, গত দুই দশক ধরে আফগান ইস্যু নিয়ে ইউরোপের দৃষ্টিভঙ্গি সংস্কারের জন্য ফ্রান্স জোরালো আহ্বান জানালেও, তা দ্রুত বিবর্ণ হয়ে গেছে। কারণ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে বৈষম্য এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ন্যাটো সদস্য দেশগুলির মধ্যে প্রতিরক্ষা ব্যয় নিয়ে দ্বন্দ। মুলত এটিই ছিল প্রধান বাধা।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য আফগানিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক তত্ত্ব অনুসন্ধান করা একটি দীর্ঘস্থায়ী পন্থা। যার উপর নির্ভর করবে কাবুলের অর্থনীতি, রাজনীতি কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন। অবশ্য ৯০’র দশক থেকেই পুরো বিশ্ব আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আফগানিস্তানের দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তালেবান কর্তৃক কাবুল দখলের মাধ্যমে এটি নতুন প্রাসঙ্গিকতা অর্জন করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কাবুল ত্যাগের এক সপ্তাহের মাথায় সরকার গঠন করে তালেবান। দুই দফা পিছিয়ে আফগানিস্তানে তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়। নতুন সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আছেন মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ এবং তার ডেপুটি হিসেবে আছেন মোল্লা আব্দুল গনি বারাদার ও সম্প্রতি দোহায় শান্তি আলোচনায় অংশ নেওয়া আব্দুল সালাম হানাফি। এই সরকারে জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের বিধিনিষেধ আরোপ করা অনেক তালেবান নেতা রয়েছেন। তা সত্ত্বেও সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক হাই রিপ্রেজেনটেটিভ জোসেফ বোরেল বলেছেন, ‘তালেবানের সাথে যোগাযোগ রক্ষার কোনো বিকল্প নেই। আফগানিস্তানের নতুন শাসকগোষ্ঠী তালেবানের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলার মাধ্যমেই কেবল দেশটির ভবিষ্যৎ উন্নয়নে প্রভাব রাখা সম্ভব’। এছাড়াও ইউরোপীয় ইউনিয়ন আফগানিস্তানকে ১০ কোটি ইউরো সহায়তা দেওয়ার অঙ্গিকার করেছে। কিন্তু তারা তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার প্রসঙ্গে এখনো পরিষ্কার করে কিছুই বলছে না। আর কোন বিভ্রম নেই, ইউরোপীয় ইউনিয়ন একটি স্বাধীন কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপনের চেষ্টা করছে। এই দুর্বল রাজনৈতিক সদিচ্ছা, যা অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি খুব কম আর্থিক সম্পদ বরাদ্দ করবে আফগানিস্তানের জন্য। সত্যিকারের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন অর্জনের জন্য, তালেবানকে আগামী বছরগুলিতে অনেক বেশি রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি সংগ্রহ করতে হবে। যাই হোক না কেন, সত্যিকারের কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন অর্জন সম্ভাব্য স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্যের চেয়ে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য হওয়া উচিত।
এখন প্রশ্ন হলো, তালেবান কাবুল দখলের প্রায় একমাস হয়ে গেলো কিন্তু কেমন আছে আফগানিস্তানের সাধারণ জনগণ? আফগানিস্তানের অর্থনীতির কেমন দশা? নারীর অধিকারে কতটা সোচ্চার হবে তালেবান? আপাত দৃষ্টিতে দেখলে আফগানিস্তানের সাধারণ জনগণ মোটেও সুখকর পরিস্থিতিতে নেই। সাধারণ নাগরিকদের জীবন বলা যায় এক ধরণের অনিশ্চয়তায় পর্যবসিত হয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তালেবানকে অবশ্যই জনগণের কাতারে নামতে হবে। যদিও তালেবানের পক্ষ থেকে বলা হয়, তালেবানের এই বিজয়ে আফগানিস্তানের সাধারণ জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে। কতটুকু ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে, তার নমুনা বিশ্ববাসী দেখেছে বিমানবন্দরে। এখন বিষয় হলো, তালেবানকে তাদের কট্টরপন্থা থেকে একটু হলেও নিচে নামতে হবে। তাছাড়া তালেবান কখনোই জনগণের সরকার হতে পারবে না। আর তা না হলে তালবান হবে দমন-পীড়নের সরকার। যার ভবিষ্যৎ নতুন আরও একটা গৃহযুদ্ধ।
আফগানিস্তান কেন্দ্রিক সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় হলো অর্থ সংকট ও খাদ্য সংকট। ইতোমধ্যে দেশটিতে ব্যাপক খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমের বরাতে দেখেছি, আফগান জনগণ খাদ্যের জন্য বাড়ির ঘটিবাটি পর্যন্ত বিক্রি করছে। এ থেকে খুব ভালোভাবে অনুমান করা যায় যে আফগানিস্তানে খাদ্য সংকট কত প্রকট আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। এ নিয়ে অবশ্য জাতিসংঘ আগে-ভাগেই শঙ্কা ব্যক্ত করেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখ আফগান নাগরিক অনাহারে থাকার সম্ভাবনা আছে। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভুক্তভোগী হবে লাখো শিশু ও বয়োবৃদ্ধরা। তাছাড়া অপুষ্টিতে মৃত্যুঝুঁকি তো আছেই।
আফগানিস্তানের অর্থনীতি যে বর্তমানে এক জরাজীর্ণ দশার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। পাশাপাশি দেশটিতে ক্ষমতায় পরিবর্তনের সাথে সাথে মুদ্রার রেকর্ড দরপতন হয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ডলারের বিপরীতে আফগান মুদ্রার দর কমেছে ১ দশমিক ৭ শতাংশ, সেখানে ১ ডলার সমান সাড়ে ৮৩ আফগান মুদ্রা হয়। চার কোটি মানুষের এ দেশটিতে মাথাপিছু দৈনিক আয় দুই ডলারের কম। বিশ্বব্যাংক বলছে, দেশটির মাথাপিছু জিডিপি ২৫ ডলার, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে অনেক নিচে।
আমরা জানি, আফগানিস্তানের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো কৃষি ও কৃষি থেকে উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা। আফগানিস্তান থেকে শুকনো ফল ও মসলাসহ নানা ধরনের কৃষিপণ্য রপ্তানি হয়ে থাকে। গত দুই দশক ধরে যুদ্ধবিদ্ধস্ত পরিস্থিতির কারণে, আফগানিস্তানের জনবল দেশটির কম উৎপাদনশীল কৃষিখাতে নিয়োজিত। তা সত্ত্বেও বলা যায়, কৃষিখাত ছাড়া নতুন তেমন কোনো উৎপাদনশীল খাত তৈরি হয় নি, যা আফগান অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী রাখবে। তাছাড়া, চলমান অস্থিরতায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেশটিতে নতুন করে বিনিয়োগ করতে কতোটা আগ্রহী হবে সে বিষয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। তাই বিদেশি বিনিয়োগ আদায় করতে তালেবানকে যথেষ্ট রাজনৈতিক সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। অবশ্য চীন, রাশিয়া ও পাকিস্তান বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে বলে তালেবানকে আশ্বস্ত করছে। তবে আফগানিস্তানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে উক্ত দেশগুলো নিজেদের স্বার্থ সর্বাগ্রে বিবেচনা করবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আফগানিস্তানের ইতিহাস পাঠ থেকে আমরা জানতে পারি, আফগান নারীরা তাদের দেশের ইতিহাস জুড়ে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ১৯১৯ সালে আফগান মহিলারা অন্যান্য অনেক দেশের আগেই ভোট দেওয়ার অধিকার পান। সেই সাথে ১৯২১ সালের নারী শিক্ষার জন্য প্রথম মেয়েদের স্কুল খোলা হয়েছিল এবং ১৯৬৪ এর সংবিধানে নারী-পুরুষ সকলের জন্য সমতার সূচনা করা হয়েছিল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে আফগান নারীদের এই অর্জনগুলো ম্লান হয়ে গেছে। সেই আফগানিস্তানে তালেবান আজ নারীদের উপেক্ষা করছে। তালেবান কট্টরপন্থা অবলম্বন করে তাদের সরকারে একজন নারীকেও রাখেনি। পাশাপাশি নারীদের পোষাক থেকে শুরু করে চলাফেরাতেও বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করেছে এবং করছে। ২০০১ সালে তালেবানরা নারীদের প্রতি নির্যাতন যতটা মর্মান্তিক ছিল, এখন আরো বেশি। বিশ্বজুড়ে নারীরা তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করেছে, অসম কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সাফল্যের সাথে। গত ২০ বছরে, আফগানিস্তানে নারীরা কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করলেও, এখন তা আর সম্ভব হচ্ছে না। তাই নারীর নিরাপত্তা এবং দেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে তাদের পূর্ণ ও অবাধ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। এই সংগ্রামে আফগান নারীদের পাশে দাঁড়ানো এবং তালেবানকে চাপ দেওয়ার জন্য পথ খুঁজে বের করতে হবে এবং তা করার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রয়োজন। যা কেবল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ই করতে পারে। এই বিষয়গুলো নিয়ে তালেবানকেও নতুন করে ভাবতে হবে। তাছাড়া তালেবান কর্তৃক আফগানিস্তানের ভবিষ্যতে নির্মাণ করা বড় মুশকিল হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগ
সারাবাংলা/এসবিডিই
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভাবনা এবং আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ তানভীর আহমেদ মুক্তমত