Sunday 29 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নতুন শিক্ষাক্রম: কতটা আগাবে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ?

রায়হান রিয়াজ
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৩:১২

সময়ের সঙ্গে ‘অনেক বিষয় পরিবর্তন হওয়ায়’ শিক্ষানীতি সংশোধনের প্রয়োজন আছে কিন্তু তা হতে হবে যুগোপযোগী ও বাস্তবতা সম্পন্ন। পছন্দ, আগ্রহ ও পারদর্শীতার বিপরীত কাউকে জোর করে কিছু দিলে নিশ্চয় ফলাফল শোভনীয় হয় না। শিক্ষাক্ষেত্রে নিশ্চয় এই শব্দ তিনটি মাথায় রাখা উচিত। কেউ বিজ্ঞান এবং গণিতে ভালো আবার কিছু শতাংশ উভয়টাতেই ভালো। যে বিজ্ঞানে আগ্রহী তাকে বলা হলো তোমাকে এখন এইসব বিষয়ে এত জানার দরকার নাই। বরং জোর করে তাকে গণিত ও বিজ্ঞানের বিষয়গুলো স্থলে তার অপছন্দনীয় বিষয়গুলো শেখানো হলো। আবার যারা চারুকলা, সাহিত্য, ভূগোল, নাট্যকলা, নৃবিজ্ঞান, সংগীত, ব্যবসা সংক্রান্ত ইত্যাদি বিষয়ে আগ্রহী তাদেরকে এইসব কম শিখিয়ে বরং গণিত ও বিজ্ঞান একটু বেশি করে গেলানো হলো। অর্থাৎ সবাইকে একই কাতারে সামিল করার চেষ্টা করা হলো কিন্তু তা বাস্তবতার ফলাফল হবে উল্টো।

বিজ্ঞাপন

আপাতদৃষ্টিতে শুনতে অনেকটা ভালো শোনায় যে মাধ্যমিক (দশম শ্রেণী) পর্যন্ত কোন বিভাগ থাকবে না। সবাই একই বিষয় নিয়ে পড়ালেখা করে সমান পারদর্শী হবে। কিন্তু এসবের বিপরীতে সত্যিকারের একজন মোটামোটি পারদর্শীও সৃষ্টি সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তাহলে এরকম এভারেজ তথা গড় মানুষ তৈরী করব আমরা। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে এসে এরকম গড় মানুষ দিয়ে আগামী প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যৎ অপ্রত্যাশিতই থেকে যাবে।

বিজ্ঞাপন

কয়েকদিন যাবৎ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ সরগরম পূর্ণ এই প্রস্তাবিত নতুন শিক্ষা পদ্ধতি নিয়ে। সেখান থেকেই প্রতীয়মান যে, বিভাগ উঠিয়ে দেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে সবার জন্য অবশ্য পাঠ্য যেই বিষয়গুলো থাকবে সেগুলো হলো- ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি। বোঝাই যাচ্ছে প্রযুক্তি ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উপর বিশাল গুরুত্ব। বোঝাই যাচ্ছে গণিত ও বিজ্ঞানের উপর গুরুত্ব কমানো হলো।

বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার কথা থেকেই আসি, আমরা মাধ্যমিকে পড়ার সময়ে তুলনামূলক ভাবে যারা গণিত, বিজ্ঞানে ভালো ছিলাম, তারা প্রায় প্রত্যেকেই বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। কিন্তু উচ্চ মাধ্যমিকে ওই শিক্ষার্থী বন্ধু গুলোর মধ্যে অধিকাংশই বিজ্ঞান বিভাগ ছেড়ে মানবিক / ব্যবসায় শিক্ষা নিয়ে অধ্যয়ন করে। কেননা তাদের মধ্যে কেউ হয়ত নিজের প্রত্যাশিত ফলাফল পায়নি অথবা উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান পড়ার মত পূর্ব প্রস্তুতি তাদের ছিলনা। আমি মনে করি তারা ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

অপরপক্ষে যারা বিজ্ঞান নিয়েই উচ্চমাধ্যমিকে অধ্যয়ন শুরু করে তাদের মধ্যে অনেকের কাছে একটা জিনিস স্পষ্ট হয় যে মাধ্যমিকে পড়ানো বিজ্ঞান বিষয়গুলোর জ্ঞান অর্জন উচ্চমাধ্যমিকের ব্যাপকতার কাছ অনেকাংশেই অনুপযোগী। অথচ তারা কিন্তু একই বিষয় গুলো পড়ে আসছে মাধ্যমিকে। তাহলে যে শিক্ষার্থী পূর্বের শ্রেণীতে পঠিতব্য বিষয়ের জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও উচ্চ মাধ্যমিকে অনকেটা অপারগ তাহলে বর্তমানে প্রস্তাবিত নতুন শিক্ষা পদ্ধতিতে যদি শিক্ষার্থীর পছন্দের বিষয় না পড়তে পারে বা জোর করে তাদের আগ্রহের বিপরীত বিষয়গুলো দেওয়া হয় তাহলে আমাদের দেশের নিন্মগামী শিক্ষা ব্যবস্থায় আরো কত ভয়ানক অপ্রত্যাশিত ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে। কেননা বর্তমানে চলমান সৃজনশীল পদ্ধতির ফলাফল সম্পর্কে কারোরই অজানা নেই।

নবম দশম শ্রেণী থেকে বিভাগ উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত একটি যুগান্তকারী ভালো সিদ্ধান্ত কিন্তু আমরা যা করছি তা ভালোর চেয়ে বরং আমাদের নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎকে ধ্বংস করবে। এটি ভালো সিদ্ধান্ত তখনই হবে যখন বর্তমানে বিভিন্ন বিভাগে যেই যেই বিষয় আছে তার সাথে আরো অনেক বিষয় যোগ করে সকল বিষয়কে অপশনাল করলে। ধরা বাঁধা দশটি বিষয় সবাইকে পড়ালে ওই সৃজনশীল পদ্ধতির মতই ফল খুব খারাপ হবে।

প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে শিক্ষকের কোচিং, টিউশন ও নোট-গাইড বই নিষিদ্ধ করা হলেও শর্তসাপেক্ষে কোচিং-টিউশনকে বৈধ রাখা হয়েছে। শিক্ষকরা নিজেদের প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পড়াতে পারবেন। আমরা মনে করি, আইনে এমন বিধানও রাখা উচিত নয়। কারণ এতে এক স্কুলের শিক্ষকরা পারস্পরিক যোগসাজশে শিক্ষার্থীদের অন্য স্কুলের শিক্ষকদের কাছে পাঠাবেন এবং তারা নিজেদের ছাত্রদের বিনিময় পদ্ধতিতে রমরমা কোচিং বাণিজ্য ঠিকই চালিয়ে যাবেন। কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে না পারলে ক্লাসরুমে পড়া, শেখা ও পাঠ্যবইয়ের মজার জগতে শিক্ষার্থীদের ফেরানো যাবে না। পৃথিবীর কোনো দেশেই যেখানে কোচিং, প্রাইভেট বাণিজ্য নেই, সেখানে আমাদের কেন এটি রাখতেই হবে, তা বোধগম্য নয়।

প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনে অনুমতি ছাড়া কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করা যাবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি আগে থেকেই কেন ছিল না, তা বিস্ময়ের বৈকি! এখন আইন পাসের পর যেন অনুমতি ছাড়া, যথাযথ পরিবেশ ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করার রেওয়াজ চালু না থাকে, সেটি নিশ্চিত করতে হবে জোর পদক্ষেপে। শিক্ষাব্যবস্থাকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে না পারলে যে শৃঙ্খলাবদ্ধ জাতি নিশ্চিত করা যাবে না, তা শিক্ষা খাত সংশ্লিষ্টদের বুঝতে হবে এবং কোনো ধরনের অন্যায় আবদার-সুবিধার কাছে নিয়মের ব্যাপারে আপস করার রেওয়াজ বন্ধ করতে হবে। কারণ আমাদের শিক্ষা খাত অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত এবং নিয়ম মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদনের সংখ্যা খুবই কম।

প্রস্তাবিত শিক্ষা আইনের ইতিবাচক একটি দিক হল, এতে বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি নির্ধারণ করে দেবে সরকার, এমন নিয়ম রাখা হয়েছে। এতে করে শিক্ষার্থীদের গলা কেটে টাকা কামাইয়ের পথ বন্ধ করা যাবে বলে আশা করা যায়। এছাড়া নোট ও গাইড বইয়ের ব্যবসার ক্ষেত্রে তিন বছরের জেল বা ৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আইনটি কার্যকর হলে শিক্ষাব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আসবে বলে আশা করা যায়।

জাতির স্বার্থে জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকেই আমাদের শিক্ষানীতি প্রণীত হওয়া প্রয়োজন। এ লক্ষ্যে আমাদের অনেক আগেই কার্যকর উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। অবকাঠামো উন্নয়নসহ উপযুক্ত ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্য আলাদা বেতন স্কেল তৈরির উদ্যোগ নিলে উপযুক্ত শিক্ষক পাওয়া কষ্টকর হতো না। কিন্তু তা না করে আমরা শিক্ষানীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি কি না তা ভেবে দেখা দরকার। মনে রাখা দরকার, জাতীয় স্বার্থকে সবার ওপরে স্থান দিতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী

সারাবাংলা/এসবিডিই

নতুন শিক্ষাক্রম: কতটা আগাবে শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ? মুক্তমত রায়হান রিয়াজ

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

দেশে ফিরেছেন প্রধান উপদেষ্টা
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০:৫০

সম্পর্কিত খবর