করোনা পরবর্তী পর্যটনখাত
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৩:৫৭
গত বছর থেকে শুরু হওয়া একটি দুঃসময়ের নাম কোভিড-১৯ ভাইরাস। যা জীবন ও জীবিকাকে থামিয়ে দিয়েছে বারবার। একটু স্বাভাবিক অবস্থা আসতে না আসতেই ফের করোনার প্রভাবে সবকিছু বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম এবং দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যস্থ পৃথিবী। করোনা ভাইরাসের প্রভাব ঠেকাতে জনসমাগম নিষিদ্ধ করা হয়। অনেক খাতের সাথে আঘাত আসে পর্যটন খাতে। পর্যটনকেন্দ্রগুলো পর্যটকশূণ্য হয়ে পড়ে। পর্যটনভিত্তিক জীবনও কঠিন সময় পার করে।
করোনা ভাইরাসের কারণে পৃথিবীতে প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। মানুষের পেশা, জীবনধারণ পদ্ধতি, কর্মপদ্ধতি সবকিছুতেই নতুনত্ব এসেছে। করোনা ভাইরাস স্তব্ধ করে দিচ্ছে বিশ্বের অর্থনীতি, রাজনীতি, খেলাধূলা, শিল্পচর্চা সবকিছু। করোনা ভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে অর্থনীতির। আর সবচেয়ে বেশি সময় বন্ধ থাকা দুটি খাত হলো শিক্ষাখাত এবং পর্যটনখাত।
করোনার প্রথম ধাক্কার পর যখন পর্যটনখাত ক্রমেই স্বাভাবিক হচ্ছিল তখন করোনার দ্বিতীয় আঘাত শুরু হয়। আবার শূণ্য হতে থাকে পর্যটনকেন্দ্রগুলো। সেই সাথে হতাশ সময় পার করে পর্যটনের সাথে জড়িত মানুষগুলো। জীবিকা হারিয়ে তাদের জীবন দুঃসহ হয়ে ওঠে। হোটেল-মোটেল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সবকিছুর সাথে মানুষের বেঁচে থাকার শর্ত জড়িত। পরপর দুই বছর ঈদে শূণ্য থেকেছে কেন্দ্রগুলো। অথচ ঈদকে কেন্দ্র করে পর্যটন কেন্দ্রগুলো জমজমাট হয়ে ওঠে। যারা ঘুরতে পছন্দ করেন সেই তালিকা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে একটু সময় পেলেই পরিবার পরিজন নিয়ে চলে যায় ঘুরতে। এই অভ্যাস মানুষের মাঝে বাড়ছে। এতে নিজের মনের পরিবর্তন ঘটে সাথে সাথে পরিবারের সদস্যদের সাথেও কাজের চাপে তৈরি হওয়া দুরত্বের অবসান ঘটে। পৃথিবীতে পর্যটনশিল্প নির্ভর অর্থনীতির দেশও রয়েছে। অনেক দেশ এখন চাইছে তাদের দেশে পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাক। দেশি পর্যটকের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করতে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছে।
এখন প্রয়োজন দেশের পর্যটন শিল্পকে এগিয়ে নেওয়া এবং এই শিল্পের বিকাশ সাধন করা। করোনা ভাইরাসের কারণে জীবিকার ধরনে পরিবর্তন হয়েছে। কর্ম হারিয়ে বেকার হয়েছে অসংখ্য মানুষ। করোনা অতিমারির কারণে অন্যসব খাতের সাথে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে পর্যটন খাত। সারা বিশ্বেই এই খাত করোনার কারণে বিপর্যস্থ হয়। পর্যটনকেন্দ্র ঘিরে গড়ে ওঠা ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে ছিলো। ফলে এর সাথে জড়িত মানুষগুলো বেকার। পর্যটন অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। করোনার কারণে এই অংশ সচল রাখা সম্ভব হয়নি।
করোনার প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে প্রায় সব দেশই লক-ডাউনের পথে হাঁটে। সেই সময় পর্যটন কেন্দ্রগুলোও বন্ধ হয়ে যায়। কারণ যে পর্যটকদের জন্য পর্যটনকেন্দ্র সেই কেন্দ্রগুলো পর্যটকশূন্য থাকে। এর সাথে জড়িত সব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ থাকে। সেই সাথে বন্ধ হয়ে যায় পর্যটন কেন্দ্র ঘিরে গড়ে ওঠা ব্যবসা-বাণিজ্য। বিশেষ করে ঈদ ঘিরে দেশের পর্যটন কেন্দ্রগুলো সরগরম হয়ে ওঠে। সারা বছর অনেক পর্যটনকেন্দ্রে খুব বেশি লোকসমাগম না থাকলেও এই সময়ে সেসব পর্যটনকেন্দ্রও প্রাণ ফিরে পায়। জানা যায়, করোনার কারণে বিশ্বে পর্যটন খাতের ৭৩ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আর এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ক্ষতির পরিমাণ ৯৬ শতাংশ। জানা যায়, বর্তমানে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) পর্যটন খাতের অবদান ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। গত দেড় বছরের ধাক্কা সামলাতে অনেক ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে যায়। যারা এখনো টিকে আছে তারাও সংকটে রয়েছে।
করোনার প্রকোপ কমে আসায় পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন এই খাতের সাথে জড়িত লাখ লাখ কর্মী নিঃস্ব ছিল। ফলে করোনার ধাক্কা অনেকদিনই বহন করতে হবে এ খাতকে। গত বছরের মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ ধরা পরার পর মার্চের শেষ দিকে দেশের সব বিনোদন ও পর্যটনকেন্দ্রগুলো বন্ধ করা হয়। পরে আগষ্টের শেষ দিকে আবার পর্যটনকেন্দ্রগুলো খুলতে শুরু করলে আশার সঞ্চার হয়। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ বাড়ায় আবার বিধি নিষেধ জারি হয়। করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা ছিল আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এই খাতের সাথে জড়িত মানুষগুলোর কথা ভাবতে হবে। কারণ এর সাথে তাদের জীবন ও জীবিকা জড়িত। কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে থাকা করোনাকে হাতের বাইরে যেতে দেওয়া যাবে না। তাছাড়া মানুষের মধ্যে এখনও সচেতনাহেতু অনেকেই কোলাহলপূর্ণস্থানে ভ্রমণে নিরুৎসাহী। পৃথিবীজুড়েই পর্যটন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প এবং অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা পালন করছে। তাই বিভিন্ন দেশ তাদের পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে পর্যটন কেন্দ্রগুলোর সুযোগ সুবিধা বাড়াচ্ছে। পর্যটকদের আবাসন ব্যবস্থা, নিরাপত্তা, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা, শপিং, ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানানোর ব্যবস্থাসহ নানাবিধ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করছে। কোনো কোনো দেশের অর্থনীতি নির্ভর করে পর্যটনশিল্পের ওপর।
বিশ্ব ভ্রমণ ও পর্যটন কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) এর তথ্যানুযায়ী, বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পের অবদান ৮ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে পর্যটন শিল্প বিশ্বের জিডিপিতে অবদান রাখে ১১ দশমিক ৪ শতাংশ। তাই এই শিল্পের বিকাশ লাভ আবশ্যক। আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৃথিবী বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। যেসব স্থান ভ্রমণ করতে দেশ বিদেশের পর্যটকরা প্রতি বছর ভিড় করে। এসব পর্যটনকেন্দ্রের মধ্যে অন্যতম হলো কক্সবাজার। পৃথিবী বিখ্যাত সমুদ্র সৈকত ছাড়াও আরও ভ্রমণস্থান রয়েছে এখানে। রয়েছে সাগরকন্যা কুয়াকাটা। আমাদের পাহাড় সমৃদ্ধ পার্বত্য তিন অঞ্চল রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে অসংখ্য পর্যটনকেন্দ্র রয়েছে। সাজেক ভ্যালি, নিলাচল, নীলগিরি, বিছানাকান্দি, চা-বাগান, রাতারগুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে পর্যটকরা ছোটেন সেখানে। এসব ছাড়াও প্রতিটি জেলাতেই রয়েছে পর্যটনকেন্দ্র। এমনকি উপজেলাতেও যে দর্শনীয় স্থানসমূহ রয়েছে সেগুলোও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করলে পর্যটক আকর্ষণ করতে পারে। আবার নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা যায়। যাতে সেসব কেন্দ্রে পরিবার পরিজন নিয়ে ছুটিতে বেড়াতে যান ভ্রমণপিপাসুরা।
আমাদের দেশের প্রতিটি অঞ্চলের রয়েছে আলাদা সৌন্দর্য। রয়েছে আলাদা বিখ্যাত পর্যটনসমৃদ্ধ স্থান। যেসব স্থান ঘিরে গড়ে উঠেছে ব্যবসা বাণিজ্য। এসব পর্যটনকেন্দ্র ঘিরে প্রচুর কর্মসংস্থান গড়ে উঠেছে। নারী-পুরুষ তাদের কর্মসংস্থান খুঁজে নিয়েছে। করোনার কারণে দীর্ঘ কয়েক মাস এসব মানুষ দুর্ভোগে ছিল। এখন তারা আবার আগের জীবনে ফিরছেন। তবে তা ধীরগতিতে। এখন কর্তপক্ষের দায়িত্ব হলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে সেসব স্থান চলাচলের উপযোগী করে তুলতে হবে। দেশের পর্যটন শিল্পকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের ঘুরে দাড়ানোর জন্য এই খাতের পূর্ণ গতিতে চলা প্রয়োজন। কিন্তু এখনো করেনা মহামারীর প্রকোপ চলছে। এর মধ্যে পর্যটন শিল্পকে বিশ্বমানের করে তুলতে হবে যাতে আরও বেশি পর্যটক আকর্ষণ করা যায়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৫০ সালে বিশ্বে পর্যটকের সংখ্যা ছিল ২৫ মিলিয়ন যা বর্তমানে বেড়ে প্রায় ১৩৩৫ মিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। পর্যটন শিল্প বিকাশ লাভ করলে আমাদের দেশের কর্মসংস্থানের বড় অংশ সমাধান করা সম্ভব। মানুষের জীবনমান উন্নয়নে এবং দেশের অর্থনীতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হবে এই পর্যটনশিল্প। তাই করোনা মহামারীর পর যাতে তা দ্রুত গতিতে বিকাশমান হতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িত মানুষগুলোর জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। এই দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে যাতে তারা টিকে থাকতে পারেন। এরইমধ্যে অনেকে ভিন্ন পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন জীবনের তাগিদে। যারা এখনো কোনোভাবে টিকে আছেন তাদের ধরে রাখতে হবে। আর তাহলেই করোনা পরবর্তী সময়ে দেশের এই খাত পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে একটি শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছে যাবে।
লেখক: সংবাদকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই