করোনাকালে শিক্ষক দিবস ও কিছু যৌক্তিক আলোচনা
৫ অক্টোবর ২০২১ ১২:৪৩
সর্বগ্রাসী করোনার অভাবিত চরম প্রতিকূল পরিস্থিতি চারপাশে। এর মধ্যেই খুলে দেওয়া হয়েছে স্কুল-কলেজ তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি সাধারণ পরামর্শ ছিল-শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে নেমে এলেই যেন সবকিছু খুলে দেওয়া হয়। গেল সপ্তাহজুড়ে আমাদের গড় শনাক্তের হার ১০ শতাংশের নিচে ছিল; তবে তা ৫ শতাংশের কাছাকাছি নয়। তারপরও অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই, সাধারণ শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়েই সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের দেশে এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। তবে বিশেষজ্ঞরা আগামী কয়েক মাসে তৃতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কাও করছেন। তারপরও সরকারকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিতে হলো শিক্ষার্থীদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে। তাছাড়া গত দেড় বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা যা উপলব্ধি করেছি তা হলো, করোনাকে ভয় করে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না বরং তা মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়ার নীতি-কৌশল শিখতে হবে; জানতে হবে করোনার সঙ্গে বাস করার জীবন পদ্ধতি।
স্কুল-কলেজগুলো খুলে দেওয়া হলেও উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলতে একটু সময় লাগবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত হওয়ায় স্ব-স্ব বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সিদ্ধান্ত নেবে স্ব-স্ব কর্তৃপক্ষ। দেশে সরকারি ও বেসরকারি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-বিশ্ববিদ্যালয় আছে প্রায় দেড়শ এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৮ লাখ। এর মধ্যে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে ৪৪টি এবং এগুলোর শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার। স্কুলের শিশুদের বেলায় যেসব সমস্যা রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরিণত হওয়ায় সেসব সমস্যার অনেকগুলোই তাদের ক্ষেত্রে দেখা যাবে না। তারা নিজেদের বিবেচনা দিয়েই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে পারবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সংবেদনশীল অংশ হলো আবাসিক হলগুলো। সেক্ষেত্রে হল প্রশাসনকে অতিরিক্ত দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। পরীক্ষাগুলো এমনিতেই শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে নেওয়া হয়। কিন্তু ক্লাসের ক্ষেত্রে সে দূরত্ব বজায় রাখা যায় না। তাই পরীক্ষামূলকভাবে ৫০ শতাংশ করে দুই শিফটে ক্লাস চালুর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রয়োজনে ক্লাসের সংখ্যা কমে গেলেও এর সঙ্গে ক্ষতির ঝুঁকিও কমবে। তবে সবচেয়ে ভালো হয় প্রথমে মাস্টার্স ও অনার্সের চূড়ান্ত পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা হলে। সেই সঙ্গে সবাইকে টিকার আওতায় নিয়ে আসতে পারলে অনেকটা স্বস্তি পাওয়া যাবে। চেষ্টা থাকলে সে কাজটি অল্প সময়ের মধ্যেই করা সম্ভব। মাত্র ৮ লাখ শিক্ষার্থীর টিকা নিশ্চিত করা কোনো অসাধ্য কাজ নয়।
সমস্যা কোনো সমস্যা নয়, সমস্যার সমাধানটাই সমস্যা। গতকালের সমস্যার সঙ্গে আজকের সমস্যার ভিন্নতা থাকতে পারে। কিন্তু সমাধানের পথ খোঁজার আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকতে হবে। যেহেতু করোনাভাইরাস একটি সামগ্রিক সমস্যা, তাই এর মোকাবিলায় চাই সার্বিক প্রচেষ্টা। এই সার্বিক প্রচেষ্টার কাজটি সমন্বয় করার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।
এ তো গেলো করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাব্যবস্থা প্রসঙ্গ। এরই মধ্যে এসেছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস এবং প্রতিবার এই দিবসটি আসলে কিছু যৌক্তিক আলোচনা সামনে চলেই আসে। দেশে প্রাথমিক স্তর ও মাধ্যমিকে নারী শিক্ষকদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকের সংখ্যা তেমনটি নয়। তবে বাড়ছে; নারী শিক্ষকদের কেউ কেউ উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য পদেও দায়িত্ব পালন করছেন। যদিও কারিগরি শিক্ষায় মেয়ে শিক্ষার্থী ও নারী শিক্ষক অনুল্লেখযোগ্য। তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষক কোথাও কর্মরত আছে- তেমনটি জানা নেই। ভারতে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হিসেবে একজনের দায়িত্ব পালনের কথা শোনা গেলেও পরে জানা যায়, সহকর্মীদের অসহযোগিতার কারণে তাকে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হয়েছে।
বাংলাদেশে প্রাথমিক বাদ দিলে পরবর্তী শিক্ষাস্তরগুলোর ৯০ শতাংশের বেশি বেসরকারি। সেখানে পাঠরত শিক্ষার্থী ও কর্মরত শিক্ষক উভয়ই বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার। তারপরও একথা স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যেটুকু ইতিবাচক অর্জন, তার সিংহভাগই শেখ হাসিনার হাত দিয়ে হয়েছে। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী বিধ্বস্ত বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু স্বাধীন দেশের উপযোগী শিক্ষানীতি কুদরাত-ই-খুদা রিপোর্ট দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি। তা বাস্তবায়নের পরিকল্পনা-নির্দেশনাও দিয়ে যান। কিন্তু তাকে হত্যার পর ক্ষমতাসীন সরকারগুলো শিক্ষায় মৌলিক কোনো পরিবর্তনে হাত দেয়নি। সেজন্য প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারীকরণের পুরোটাই হয়েছে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার হাত দিয়ে। যেমন- শিক্ষা কারিকুলামে পরিবর্তন, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার, মূল্যায়ন ব্যবস্থায় পরিবর্তন, সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে সঙ্গে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মূল বেতন বৃদ্ধি ইত্যাদি।
তারপরও কথা থাকে। বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে বড় পদোন্নতি হলেও বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের পদোন্নতির হাল আগে যে তিমিরে ছিল, এখনও সে তিমিরেই। সহকারী অধ্যাপকের পদই সেখানে শেষকথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষা উপদেষ্টার নেতৃত্বে গঠিত এমপিও নীতিমালা প্রণয়ন কমিটিসহ একাধিক কমিটির সুপারিশ সত্ত্বেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে রশি টানাটানির কারণে সহযোগী অধ্যাপক ও অধ্যাপক পদ সৃষ্টি হয়নি। এমনকি এমপিওভুক্ত বেসরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষরা যথাক্রমে সরকারি কলেজের অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপকের মূল বেতন পেয়ে এলেও তাদের পর্যন্ত অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যথাযথ পদায়ন করা হয়নি।
১৯৯৪ সালে জমিরুদ্দিন সরকার শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালে বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের বেতন অন্যায়ভাবে সরকারি প্রধান শিক্ষকদের এক ধাপ নিচে মূল বেতন নির্ধারণ করা হয়। এ বঞ্চনার এখনও অবসান হয়নি। অথচ প্রাথমিক-পরবর্তী বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষকরাই দেশে শিক্ষার ৯০ ভাগের বেশি দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বেসরকারি স্কুল, ডিগ্রি কলেজ, অনার্স-মাস্টার্স কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা কর্মরত, তাদের মধ্যে অনেকে হয় প্রতিষ্ঠান থেকে, না হয় সরকার থেকে অথবা দুটো উৎস থেকেই বেতনভাতা ও পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত।
সরকারি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকরা বেতন বৈষম্যের অবসান, টাইম স্কেল বাস্তবায়ন ও পদোন্নতির দাবিতে সোচ্চার। এ দিকে ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, বেসরকারি স্কুলের প্রাথমিক শ্রেণিগুলোর সঙ্গে সরকারি প্রাথমিক স্কুলের আর্থিক ও ব্যবস্থাপনাগত দুস্তর ব্যবধান দূর করতে কার্যকর পদক্ষেপ এখনও দৃষ্টিগোচর নয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গবেষণা কার্যক্রমের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। ৬৬ হাজার কিন্ডারগার্টেনে কর্মরত ১০ লাখের কাছাকাছি শিক্ষক করোনাকালে প্রতিষ্ঠান ও পেশার অস্তিত্ব রক্ষার সংকটে ব্যস্ত। পদোন্নতির প্রশ্ন সেখানে বাস্তবেই অপ্রাসঙ্গিক।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় স্থায়ী শিক্ষক জনবল নেই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সুপারিশ দেয়ার বিধান আছে। সুপারিশ কার্যকরের ক্ষমতা নেই। অন্যদিকে শিক্ষার্থী সংখ্যার দিক থেকে সর্বোচ্চ এবং দেশজুড়ে অবস্থান হলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এখনও উপেক্ষার পাত্র। তবে এ কথা স্বীকার করতে হবে, ইউজিসির বর্তমান চেয়ারম্যানের সময়কালে প্রতিষ্ঠানটি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি সক্রিয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শর্তানুযায়ী অধিভুক্ত বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স কলেজগুলোয় নিয়োগপ্রাপ্ত ও বছরের পর বছর ধরে এক প্রকার বিনা বেতনে কর্মরত শিক্ষকরা এখনও সরকারের শিক্ষক বিভাগের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা ও মূলত অনুরাগ, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এমপিও থেকে বঞ্চিত।
এদিকে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে যারা অবসর নিয়েছেন, তারা অবসর ভাতার জন্য এখন অন্তহীন অপেক্ষায়। ব্যানবেইসের দুয়ারে মাথা ঠুকছেন তেতাল্লিশ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী। জানা গেছে, অবসর ভাতা প্রদানকারী বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের পক্ষে আর্থিক সংকটের কারণে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আবেদনকারীদের চেক তৈরি করা হয়েছে। অন্যদিকে, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট-২০১৮ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রাপ্ত আবেদনগুলো নিষ্পত্তি করেছে। অর্থসংকটের কারণে অবসর গ্রহণকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রাপ্য আর্থিক সুবিধা বিতরণে সমস্যা এখন বিপুল। করোনাকালে এই সংকট আরো বেড়েছে। এ সমস্যা উত্তরণে অবিলম্বে বিশেষ ব্যবস্থায় সরকারের দিক থেকে আর্থিক আনুকূল্যের মাধ্যমে শিক্ষকদের সমস্যা নিরসন করতে হবে। একই সঙ্গে পরিকল্পিতভাবে বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা নিয়ে অবসর গ্রহণকারী শিক্ষকদের সংকট মোকাবেলা করতে হবে। কমিউনিটি সেন্টার জেলায় জেলায় প্রতিষ্ঠা, শিক্ষকদের শিক্ষা ব্যাংক স্থাপন ও জমিতে বিনিয়োগসহ বিভিন্ন দেশের আদলে অবসর গ্রহণকারী শিক্ষক-কর্মচারীদের সংকট নিরসনে উদ্যোগ নেয়া দরকার।
বর্ণিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ২০ লাখ শিক্ষকের কাছে বিশ্ব শিক্ষক দিবস-২০২১ কী বার্তা এনেছে? দিবসটি উপলক্ষে ইউনেস্কোর প্যারিসের প্রধান কার্যালয় থেকে যে ধারণাপত্র প্রকাশ করা হয়েছে, তা বাংলাদেশে কতটা প্রাসঙ্গিক? তারা কি করোনার মতো সংকটকালে নেতৃত্ব দিতে ও শিক্ষার ভিত্তি তৈরিতে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টির পাশাপাশি যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারছেন? তাদের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের বাস্তবতা নিয়ে কোনো মতবিনিময় হচ্ছে? বিশেষ করে তৃণমূলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কথা, তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা ও অপ্রাপ্তির বেদনা আমলে নিয়ে মূল্যায়ন ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস জরুরি। যে কোনো সংকটকালে সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে দক্ষতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অব্যাহতভাবে দেখিয়ে চলেছেন, সে দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আমাদের শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয় যত বেশি অভ্যস্ত হতে পারবে, বিশ্ব শিক্ষক দিবস বিষয়টি এবং এর প্রতিপাদ্য ঠিক ততটাই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে।
লেখক: শিক্ষাবিদ
সারাবাংলা/এসবিডিআই