মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও
৩০ অক্টোবর ২০২১ ২২:২২
এক. অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের আলোচিত-সমালোচিত ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ তখন একটি দৈনিকে বের হয়েছে। পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়। লেখাটি নিষিদ্ধও হয়েছিল—‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’—বেশ হইচই পড়ে। কেউ কেউ তখন এ উপন্যাসের উপাদানগুলোকে কাল্পনিক বলে বাতিল করে দিতে চেয়েছেন।
লেখাটি পড়ে আমি ভীষণ শিহরিত হয়েছি। আজকাল যা ঘটছে, এ উপন্যাস তারই বর্ণনা। তারই ইঙ্গিত। এর প্রতিটি ঘটনা তখনই মানুষ হিসেবে আমাদের গভীরতর দুর্ভাবনা এবং লজ্জার দিকে ঠেলে দেয়। হুমায়ুন আজাদের ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ ধর্মান্ধ বাংলাদেশের এক সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এ ইতিহাস সুকৌশলে একটু একটু করে ‘আমার সোনার বাংলা’কে ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’-এ রূপান্তরের প্রক্রিয়ার ইতিহাস। আর এ রূপান্তর রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনরায় এক হওয়ার অর্থে নয়, কেবল মন-মানসিকতা আর চিন্তা-চেতনায় রূপান্তর। এ ইতিহাসে নেই কোনো সন-তারিখ। নেই আহত-নিহতের কোনো পরিসংখ্যান। সরাসরি কোনো ঘটনাও নেই। আছে শুধু কয়েকটি ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত। এখানে অনুভূতি উন্মোচিত হয় সরলভাবে। যখন স্বাধীনতা বিরোধীরা বাংলাদেশের ক্ষমতার মসনদে বসেছিল, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে নেমে এসেছিল অন্ধকার। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারের গভীরতা, সেই প্রতিক্রিয়াশিলতার জয়-জয়কার, সংখ্যালঘুদের উপর সীমাহীন নির্যাতন-হত্যা-ধর্ষণ-লুটপাট, সেই ভয়াবহ সময়ের নিষ্ঠুরতার উপাখ্যান রয়েছে উপন্যাসটির সারাটা শরীরজুড়ে।
ছাত্র রাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনে থাকার কারণে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার আস্ফালন কেমন, তখনই তা দেখেছি। দিন দিন সেটি বেড়েছে। ‘সামাজিক মনস্তত্ত্ব’ গিয়ে ঠেকে আছে। আজ তার প্রতিফলন ঘটছে। বহুদিন আমি ঘুমাতে পারিনি। বার বার মনে হতো সত্যি কী এমন বাংলাদেশ! পাকিস্তান আদলটাই স্বরূপে ফিরছে। আমি স্বপ্নে দেখতাম, কতোগুলো ঘটনা বা দৃশ্য আমার স্বপ্নের ভেতর দেখতে পেতাম। আমি ভয় পেতাম, আঁতকে উঠতাম, আমার বোনের সঙ্গে তখন শেয়ার করতাম। তিনি আমাকে সাহস যোগাতেন। অনুপ্রাণিত করতেন। বলতেন, লড়াই করতে হবে। প্রতিনিয়ত আমাদের অনেক ধরনের ভীতিকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। নিপীড়নের শিকার হয়েছি। সেগুলো উপেক্ষা করেই বুক ফুলিয়ে আমাদের লড়াই চালিয়ে গেছি। কিন্তু আজকাল অবাক হই, আমার বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেয়, যাদের সঙ্গে আন্দোলন করেছি, আজ তারা কেমন যেন মিইয়ে যাচ্ছে। কেন? কিসের বদল এটা? সবুজের মাঝে লাল সূর্য নিয়ে স্বপ্ন দেখা যুবকের সাম্প্রদায়িকতার বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। আমার সেই বোনটাও এখন আমাকে নিয়ে চিন্তিত, তার ভেতরেও হারানোর ভয় কাজ করে। একসময় ধ্বংসে যে বিজয় খুঁজে পেত, আজ সে ধ্বংসে দেখতে পায় পরাজয়ের গ্লানি। ধ্বংসে আজ আর কোনো অভিনবত্ব নেই তার কাছে।
হুমায়ুন আজাদ স্যারের আরেকটা লেখা, ‘এ বাংলাদেশ কি আমরা চেয়েছিলাম?’ বারেবারে আমাদের মনেও এই প্রশ্নটি উদয় হচ্ছে। প্রশ্নটি এতোটাই উগ্রে দিচ্ছে—এ-বাংলাদেশ আমাদের চেনা বাংলাদেশ নয়। সমস্যাটা আমাদের, আমাদের দুর্বলতার এবং ভীরুতার।
দুই. সঞ্জীব আর আমি দু’’টি দেশে বাস করি। কিন্তু কথা বলি একই ভাষায়। আমরা দু’টি ধর্মে জন্মেছি। একই স্কুলে পড়ালেখা করেছি। একসময়ে কাউকে কিছু না বলে তারা কলকাতায় চলে যায়। কিন্তু প্রতিবেশী মানুষ আক্রান্ত হলে আমাদের হৃদয় একইভাবে রক্তাক্ত হয়। আমরা কথায় কথায় রাত-ভোর করি, একটা স্বপ্ন দেখে, যে স্বপ্নের দেশে দ্বিজাতিতত্ত্ব নেই, ভালোবাসা আছে। এগুলো আমাদের রক্তাক্ত হৃদয়ের কথা। এই কথাগুলো অনেকটা বর্ণচোরার মতো। মুখ লুকিয়ে রাখার মতো। কিন্তু সম্পূর্ণের সন্ধান ছাড়া এই কালরাত্রি থেকে আমাদের পরিত্রাণ নেই। এখানকার মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের দ্বিজাতিতত্ত্ব দেখতে পাওয়া যায়। আমি জানি না, প্রতিদিনের এই দ্বিজাতিতত্ত্বের শেষ কোথায়! সাতচল্লিশের পরবর্তীকাল থেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ছিল রাষ্ট্রের কাছে সন্দেহভাজন, দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক এবং রাষ্ট্রীয় নানা চাপ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের শিকার, তখনো মাঝে-মধ্যে ১৯৫০ ও ১৯৬৪ সালে হয়তো রাষ্ট্রীয় উস্কানিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ব্যাপক দাঙ্গা-হাঙ্গামার শিকার হয়েছিল তারা। স্বাধীন বাংলাদেশেও এই দুর্ভোগ থামেনি। সমাজে নানা মাত্রা সাম্প্রদায়িক চর্চা চলছে, সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে বৃহত্তর সামাজিক পর্যায়ে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ও ক্রমবৃদ্ধি নজরে আসবে। সঞ্জীব আমাকে প্রায়ই বলে, দ্বিতীয় শ্রেণি নয়, উদ্বাস্তু নাগরিক, এ দেশ কী ও দেশ! এটা সীমান্তহীন দীর্ঘশ্বাস, কান্না।
সর্বাঙ্গে ব্যথা হলে ওষুধ কোথায় লাগাতে হয়—আমার জানা নেই। আমার রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক চরিত্র মানে তো আমারই সাম্প্রদায়িক চরিত্র, ফ্যাক্ট—প্রতিনিয়ত একটু একটু লম্বা হচ্ছে। যতই তত্ত্ব আওড়াই, এ কথা তো অস্বীকার করা যাবে না। প্রশ্ন উঠতে পারে, রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক চরিত্র কী? তাহলে এ প্রশ্নটিও থাকে, রাষ্ট্রের আবার ধর্ম কী? এই সবকিছু হয় আমাদেরই নীতিহীনতা, রাজনৈতিক মেরুদণ্ডহীনতা আর প্রশাসনের উদাসীনতার জন্য।
তিন. কুমিল্লা থেকে শুরু হয়ে এটা শুধু কুমিল্লাতে থেমে থাকেনি, নোয়াখালী, চাঁদপুর, রংপুর—বলতে গেলে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যার অর্থ সারা দেশের প্রতিটা আনাচে-কানাচে ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক মানুষ রয়েছে, তারা লুকিয়ে নেই, তারা প্রকাশ্যে আছে, বুক ফুলিয়ে আছে। স্ফুলিঙ্গের আঁচ থেকে দাবানলের ভয়াবহতার দিকে এগিয়ে যেতে পারে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস। আগে অনেকবার আমরা তা দেখেছি এবং এবারও ঠিক সেটাই হয়েছে, হচ্ছে। বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে একে না দেখে বরং সুপরিকল্পিত সহিংসতা হিসেবেই দেখতে চাইব। খুব হতাশ ও অসহায় লাগে যখন দেখি রাষ্ট্রের ধর্মীয় সংখ্যাগুরুরা সহজেই বিস্মৃত হন যে, সে দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি সহিষ্ণু থাকার একরকম দায় তাদের আছে।
এই ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস এখানে বহুদিন থেকে শেকড় গেড়েছে, আমরা কেউ কেউ দলকানা দৃষ্টিভঙ্গিতে এর অস্তিত্ব অস্বীকার করার চেষ্টা করছি। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শেকড় ‘রাজনীতি’। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ডাল-পালা, লতা-পাতা সবই রাজনীতি। কেবল এর মাশুল গুনতে হয় সাধারণ মানুষকে। আর ফলাফল যায় রাজনীতিবিদদের ঘরে। সমাজে সাম্প্রদায়িক বিভাজন তৈরির বহু উপাদান আমাদের সংবিধান, রাষ্ট্রকাঠামো, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, অগণতান্ত্রিক শাসন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিক শিক্ষা, মনস্তত্ত্ব ইত্যাদির মধ্যে রয়ে গেছে।
চার. এ লেখার শিরোনামটা আমার নয়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা থেকে ধার করে নেওয়া। ছোট্ট একটি বাক্য। কী বিশাল তার ব্যাপ্তি! কী মারাত্মক বার্তা লুকিয়ে আছে। মানুষ বড় অসহায়। দুঃখী। একলা। এদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নিরাপদ বোধ করে না। নীরবে তাদের দেশত্যাগ যে ঘটছে, এটা মিথ্যা নয়। আমাদের রাষ্ট্রে বলতে গেলে কোনো নাগরিকেরই জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা নেই। সনাতন ধর্মাবলম্বী মানুষরা বিশেষভাবে বিপন্ন। মূল কারণ হলো রাষ্ট্রের চরিত্র। যে চারটি মৌলনীতির রাষ্ট্রের স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম, যার জন্য সংগ্রাম করেছি, সেই রাষ্ট্র আমরা পাইনি। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এখানে মানুষে মানুষে বৈষম্য রয়েছে। ধনী-দরিদ্র বৈষম্যই প্রধান, সেই সঙ্গে নারী-পুরুষের বৈষম্যও স্পষ্ট এবং সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর মধ্যকার পুরনো বৈষম্য শেষ হয়ে যায়নি।
পাঁচ. মাথাপিছু জিডিপি সমাজের প্রান্তিক ও দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর জীবনধারণের কঠিন সংগ্রামকে ঠিক তুলে ধরতে পারে না। জনগণের আয়বৈষম্য বাড়তে থাকলে তার সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক অভিঘাত এসে পড়ে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের জীবন-জীবিকায়।
এই লেখাটির সময় একটি খবর—বাড্ডায় এক তরুণের আত্মহত্যা। আমার এক খুব পরিচিত। কেন এই আত্মহত্যা? একটি অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। সাম্প্রতিক সময়ে তার পরিবারের আর্থিক খরচ মেটাতে গিয়ে সে নানান মানসিক চাপে ছিল। রাতে সে আর কুলিয়ে উঠতে না পেরে আত্মহত্যা করে। এরকম ঘটনা দেশে প্রায় ঘটছে।
বাজার গেলে, ফুটপাতে হাঁটলে, চারিপাশ তাকালে, কান পেতে শোনা যায়, দেশের মানুষ কাঁদছে। প্রতিদিন মানুষের কান্নার প্রতিধ্বনি। তবে, আমরা মানুষ হবো কবে?
লেখক: সহ-সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন
সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই