পাকাচুল
১৯ নভেম্বর ২০২১ ১৯:১০
আমার এক চাচাতো বোনের গায়ের রঙ চাপা ছিল। আমার বাবা তাকে ডাকতো ‘কালি’ বলে। ঘটনাটি খুব স্বাভাবিক ছিল। আমরা এটি নিয়ে হাসতাম। চাচা চাচী এই নিয়ে একটুও রাগ করত না। চাচীও দেবরকে কম ভালোবাসতো না। কিন্তু আমার বোনটা যখন ছোট ছিল, তখন সে আল্লাহর কাছে হাত তুলে দোয়া করত যেন তার ছোট চাচার একটা সন্তান কালো হয়।
আমার বোনটা শ্যামলা হলেও মনটা ছিল পরিষ্কার। আমরা দুই বোনের কেউই কালো হলাম না। আমার বাবা কালো হলেও উত্তরাধিকার বিবেচনায় ফর্সা মেয়ে বিয়ে করেছিল। তাই ‘ভাগ্যিস!’ আমরা কালো হইনি।
আমার বোনটা আমাদের অনেক আদর করত। আমরা প্রতিবছর খুলনায় বড় চাচার বাসায় ঈদ করতাম। আর আমার বোনটা চাচীর সঙ্গে বিশ্ব সেরা স্বাদের সব রান্না করতো। তার যখন বিয়ের কথাবার্তা চলছিল, তার একটাই শর্ত ছিল ‘পাত্র যেন ফর্সা হয়’। একটা ফর্সা পাত্রের জন্য তার প্রতীক্ষা সার্থক হয়েছিল শেষমেশ।
আমার মায়েরও কালো অপছন্দ ছিল। ব্রেস্ট ক্যানসার ধরা পড়ার পর ‘ম্যাস্টেকটমি’র সময় তার রক্তের প্রয়োজন ছিল। তার জন্য নন-স্মোকার, নন-অ্যালকোহলিক মোটামুটি সুস্থ সবল রক্তদাতা যোগাড় করা হলো। কিন্তু তার গায়ের রঙ ছিল কালো। মুখ ভরা দাঁড়ি। আমার মা খুবই মন খারাপ করলেন। খুবই অনিচ্ছায় অবজ্ঞায় আমার মা সেই লোকের রক্ত নিলেন। আমার ব্যথায় কাতর মরণঘাতি রোগে আক্রান্ত মাও চায় না, কালো মানুষের লাল রক্ত। ভূপেন হাজারিকার সেই বিখ্যাত গান—
‘আমায় একজন কালো মানুষ দাও যার রক্ত কালো
আমায় একজন সাদা মানুষ দাও যার রক্ত সাদা
যদি দিতে পার
প্রতিদান যা কিছু চাও হোক অমূল্য পেতে পারো’
আমি সেই অমূল্য কালো রক্তদাতাকে কোনো প্রতিদান দিতে পারিনি। আমাকে মা দিয়ে, আমার মাকে জীবন দিয়ে সে কোথাও চলে গেল অনেকের ভিড়ে।
আমার জন্মের সময় আমার মায়ের রক্ত লেগেছিল। সেই রক্তদাতাও কালো ছিল। এই জন্য নাকি ‘আমি ঠিক মায়ের রঙ পাই নাই’। মা নাকি আমাকে শিশু অবস্থায় কাঁচা হলুদ গায়ে মাখাত। তাই নাকি বড় হতে হতে আমার গায়ের রঙ ‘কিঞ্চিৎ ময়লা’ থেকে ‘পরিষ্কার’ হয়েছিল।
একবার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফিরে দেখি আমার মা বাবার বিয়ের ঘটক এসেছেন। গ্রীষ্মের গরমে ক্যাম্পাস থেকে রোদ চুম্বন (Sunkissed) মেখে ফিরেছি। ঘটক আমাকে দেখে খুব হতাশ হলেন। কোনোদিন আর বাড়ি মাড়ায় নাই। বুঝে গেছে এই বাড়িতে বাণিজ্যের লক্ষ্মী ভিড়বে না।
আমিও সাদা ভালোবাসি। আমার সব ছবি আমি একটা একটা করে ‘ব্রাইট’ করি। মুখ নিখুঁত করি। কালো দাগ দূর করি। কারণ কালো মানে অন্ধকার। ছবি একটা স্মৃতি। এই স্মৃতি ‘পরিষ্কার’ রাখা জরুরি।
কলেজে পড়ার সময় কেমিস্ট্রি ল্যাব থাকলে বাড়ি ফেরার পথে আমি অ্যাপ্রোন খুলতাম না। আমার মনে হতো সবাই আমাকে দেখে ভাবছে আমি মেডিক্যালের ছাত্রী। বায়োলজি না থাকা সত্ত্বেও আমি সেই অহংকারের সুযোগটা নিতে ভালোবাসতাম। সেই অভ্যাস এখনও রয়ে গেছে। আমি আমার এডিটেড চাঁছা থুতনি, নিখুঁত মুখ, ঝলসানো সাদা মুখ ভালোবাসি।
‘চাঁদের নিজস্ব কোনো আলো নেই, তবু তো নজরুল লিখেছেন,
‘সেই মধু এক বিন্দু পিয়ে
সিন্ধু ওঠে ঝিলমিলিয়ে রে
সেই চাঁদেরই আধখানা কি তোমার মুখে হাসে?
একাদশীর চাঁদ রে ঐ রাঙা মেঘের পাশে’
আমার মতো, আমার মেয়েও ফর্সা ভালোবাসে। তার ধারণা সে আমার চেয়ে শ্যামলা। এইটা তার অপছন্দ। স্রষ্টার উপর এই নিয়ে তার অভিযোগ। আমার খুব ভাল্লাগে যখন পনেরো বছরের একটি মেয়ে মধ্যবয়সী একটা নারীকে দেখে ‘ইনফেরিয়র’ বোধ করে কিংবা যখন বেশিরভাগ সময়ে আয়নায় দেখে তার মনে হয় তাকে মোটা লাগছে, তাকে শ্যামলা লাগছে, তার মুখের ‘জলাইনপ্রমিনেন্ট’ না। “A flower doesn’t competing to the flower next to it. It just blooms”. ফুলের এই আত্মবিশ্বাস, আমাদের স্পর্শ করুক।
আমি যখন নার্সারিতে পড়ি, আমাকে ক্লাসের ফার্স্ট বেঞ্চে বসিয়ে মা চলে এসেছিল। ছুটির সময় দেখে আমি শেষের সারিতে। মা জিজ্ঞেস করতেই আমি বলেছিলাম, ‘একটা কালো ছেলে পাশে বসেছিল’। একসময় আমরা বাবা আর চাচার পরিবার এক সঙ্গে কুরবানি দিতাম। আমার কথা মাথায় রেখে বাজেট সমন্বয় করে হলেও আমার চাচাতো ভাইয়েরা লাল কিংবা সাদা গরু কেনার চেষ্টা করত।
অনেক বছর আগে একদিন এক পত্রিকা অফিসে বসে আছি। হঠাৎ এক ভদ্রলোক ঢুকলেন। তাকে দেখে একজন বললেন, ‘ভাই আমি মা কালি দেখেছি কিন্তু আপনি তো পুরা বাবা কালি হয়ে গেছেন’। উনার ‘সেন্স অফ হিউমার’ দেখে বাবা কালিও হেসে ফেললেন। মাঝে মাঝে মনে হয়, জীবনটা কেঁদে ভাসিয়ে দেওয়ার চেয়ে হেসে উড়িয়ে দেওয়া সমীচীন।
১৩৫ বছর আগে কবিগুরু লিখেছেন, ‘কালো? তা সে যতই কালো হোক। দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ’। কালো মন, কালো টাকা, ব্ল্যাকমেইল, কালরাত্রি, কালা আইনের রঙ এত বছর পরেও বদলায়নি এতটুকু। শুধু আয়নায় সাদা চুল উঁকি দিলেই সাদার আরাধন সাঙ্গ হয়। তাইতো কবি লিখেছেন,
‘পাকা চুল মোর চেয়ে এত মান্য পায়
কাঁচা চুল সেই দুঃখে করে ‘হায় হায়’।
পাকা চুল বলে, ‘মান সব লও, বাছা
আমারে কেবল তুমি করে দাও কাঁচা।’
সারাবাংলা/আইই