Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পাকিস্তানিদের কেন আমরা ঘৃণা করি?

আরিফ ইশতিয়াক রাহুল
২১ নভেম্বর ২০২১ ২২:০৩

আমাদের দেশের পাসপোর্টের আন্তর্জাতিক মান বাড়ানোর জন্য যখন সব নিয়ম অপরিবর্তিত রেখে শুধু ফ্রন্ট পেজ থেকে ‘একসেপ্ট ইসরাইল’  শব্দটা বাদ দেওয়া হলো তখন কতজনের কত প্রতিবাদ, কত দেশাত্মবোধ, কত জাতীয়তাবাদ দেখেছি। যারা কি না আজ মিরপুরে দেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পতাকা উড়তে দেখেও নীরব। এখন তাদের যদি প্রশ্ন করা হয়, ইসরাইল জ্ঞান-বিজ্ঞানে খুবই উন্নতি করেছে, সেখানে গবেষণার প্রচুর সুযোগ, তাদের শিক্ষার মান ভালো, নাগরিক সুবিধা বিশ্বমানের, ট্যুরিজম ও বিজনেস ফ্রেন্ডলি, বহু নবী-রাসুল জন্মেছে ইসরাইলে; তাহলে কেউ ইসরাইলে গেলে ক্ষতিটা কোথায়? তারা প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত কোনো উত্তরই দিতে পারবে না। নৈতিক ক্ষতি বা ধর্মীয় চেতনা ছাড়া অন্য কোনো কারণ কেউই দেখাতে পারবে না। ইসরাইলে গিয়ে কেউ লাভবান হলে তাতে আপাত দৃষ্টিতে কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু অন্যদিকে ক্ষতি আছে এবং তা খুবই গুরুতর ক্ষতি। কী সেই ক্ষতি? ইসরাইল মানবতার ঘাতক ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র। তাদের সাথে আমাদের আমাদের সম্পর্ক স্থাপন মানেই রাষ্ট্র হিসেবে তাদের সাথে বন্ধুত্ব করা ও তাদের সকল কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করা। যা আমরা করতে পারি না। লক্ষ-লক্ষ মানুষকে তারা হত্যা করেছে, হত্যাযজ্ঞ চলছেই। পবিত্র ভূমিকে তারা করেছে রক্তাক্ত ও কলুষিত। তাই তাদের প্রতি আমাদের আকাশসম ঘৃণা।

বিজ্ঞাপন

কথাটা একইভাবে দেখলে কেবল সত্যই নয় বহুগুণ বড় সত্য পাকিস্তানের বেলায়ও। পাকিস্তানও আমাদের দেশের লক্ষ-লক্ষ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে। সংখ্যায় যা ৩০ লাখ। ইসরাইল এতো নিকৃষ্ট হয়েও যা করেনি পাকিস্তান তা গণহারে করেছে; আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রমহানি করেছে। স্বামীর সামনে স্ত্রীকে, ছেলের সামনে মাকে, ভাইয়ের সামনে বোনকে ধর্ষণ করেছে; ধর্ষণের পর স্তন উপড়ে নিয়েছে, যৌনাঙ্গ চিড়ে ফেলে হত্যা করেছে নারীদের। পৈশাচিকতার সকল পর্যায় ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের ওরা আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে, মৃত্যুর পর চোখ উপড়ে ফেলেছে, ধারালো বেয়নেট দিয়ে মুখ থেঁতলে দিয়েছে। একজন মুসলমানের জন্য যা আবশ্যক (দাফন, কাফন ও কবর) তা পর্যন্ত দেয়নি। উল্টো মাটি চাপা দিয়েছে গণকবরে। নির্মমতা, নৃশংসতা ও পাশবিকতায় ইসরাইলকে হার মানিয়েছে প্রতিটি ক্ষেত্রে। ইসরাইলে ৭০ বছরে যা করেনি পাকিস্তান ৯ মাসে তা করেছে। সুদূর মধ্যপ্রাচ্যের একটা মুসলমান দেশের মানুষের ওপর নির্যাতনের কারণে যদি ইসরাইলকে আমরা এতো ঘৃণা করি তাহলে নিজের দেশের, নিজের জাতির মানুষের ওপর এতো অন্যায় ও নৃশংসতার পরও পাকিস্তানকে কিভাবে ঘৃণা না করে থাকতে পারি?

বিজ্ঞাপন

অবাক হয়ে যাই যখন দেখি, আমাদের প্রজন্মের মধ্যে এতো বেশি পাকিস্তানপ্রেমী তৈরি হয়েছে। নিশ্চিত করে বলা চলে, এরাই তো তারা যারা তালেবানের উত্থানে আনন্দ প্রকাশ করেছিলো। বিশ্বাস না হলে খোঁজ নিয়ে দেখেন। একটাও এই ক্যাটাগরির বাইরের নয়। দেশের এই অংশটাই বিষফোঁড়া। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে এদের দেখা পাবেন। প্রতিবারই এদের অবস্থান থাকবে দেশের বিরুদ্ধে। কখনও পাকিস্তানের পক্ষে, কখনও আফগানিস্তানের পক্ষে। কখনও মৌলবাদের পক্ষে, আবার কখনও যুদ্ধাপরাধের পক্ষে। আজ না হোক কাল, এরা দেশের বিরুদ্ধে যাবেই। এই কথাটা আপনার কাছে অতিরঞ্জিত মনে হতেই পারে, তবে এটাই বাস্তবতা। এরা থাকে এদেশে, খায় এদেশের, কিন্তু ভালোবাসা পাকিস্তানের জন্য। এদের একাংশ জৈবিকভাবে রাজাকারের উত্তরসূরি, অপরাংশ চারিত্রিকভাবে। এতে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই।

এই কথাগুলো শোনার পর কেউ হয়তো ধর্মের প্রসঙ্গ আনবেন, বলতে চাইবেন, পাকিস্তানকে মুসলমান হিসেবে সমর্থন করি! তাদের জেনে রাখা ভালো, ইসলাম কখনও অন্যায়, অবিচার, হত্যা ও ধর্ষণকে বৈধতা দেয়নি। ইসলাম কখনও দাফন, কাফন ও জানাজা ছাড়া গণকবরের কথা বলেনি। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের ২০ বছর যে অন্যায় ও বৈষম্য আমাদের সাথে হয়েছে সেটাও ইসলাম সমর্থন করে না। আর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসেও কম নেই, এতো জঘন্য ইতিহাস কোথাও পাবেন না। ধর্মকে সবাই ভালোবাসে। আমাদের ধর্মটা ইসলাম, পাকিস্তানপ্রেম আমাদের ধর্ম নয়। পাকিস্তানকে ভালোবাসা মানে ইসলামকে ভালোবাসা নয়। ইসলাম এবং পাকিস্তান সম্পূর্ণ আলাদা দুটি টার্ম। ধর্মকে অবশ্যই ভালোবাসবেন, কিন্তু তার পাশাপাশি নিজের দেশকেও ভালোবাসতে হবে। কেননা দেশপ্রেম ধর্মেরই একটা অংশ। হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক আমরা কেউই নই। তিনি নিজের মাতৃভূমির চেয়ে অন্য দেশকে বেশি ভালোবেসেছেন – এমন উদাহরণ কেউ কখনও দেখাতে পারবেন না।

গত দুইদিন মিরপুরের মাঠে যারা পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়েছেন এবং মাঠের বাইরে যারা পাকিস্তানের সাপোর্ট করেছে তারা কেন এমন করেছেন আমি জানি না। তবে ইসরাইলি বা পাকিস্তানিদের চেয়ে আমি ওদের অনেক বেশি ঘৃণা করি। ওরা এদেশে জন্মেছে, কেবল এটুকুই সত্য। কিন্তু এদেশে জন্ম নিলেই এদেশি হওয়া যায় না। ১৯৭১ সালেও একদল লোক ছিলো যারা নিজের দেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। হত্যা, ধর্ষণ ও লুটতরাজে শামিল হয়েছিলো। ওরা তাদেরই উত্তরসূরি। জৈবিকভাবে না হলেও চারিত্রিকভাবে, আদর্শিকভাবে। ওরা এদেশকে ভালোবাসতে পারেনি কখনওই। এদেশ ওদের নয়। ওদের জন্য পাকিস্তানই শ্রেয়। আর কিছু আহাম্মক আছে যারা পুরো বিষয়টাকে রাজনৈতিক মোড়ক দেওয়ার চেষ্টা করছে। পুরো বিষয়টাকে রাজনৈতিক বিষয় বলে চালাচ্ছে। প্রথমত, এটা কোনো রাজনৈতিক বিষয় নয়, এটা আমাদের আবেগ, অস্তিত্ব ও দেশপ্রেমের বিষয়। নিজ দেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যখন কিছু লোক শত্রু দেশের পতাকা উড়ায় তখন তা নিশ্চিতভাবেই রাষ্ট্রের জন্য সুখকর কোনো ঘটনা থাকে না। এই দৃশ্য দেখার জন্য আমেরিকার স্কলারশিপ ছেড়ে রুমিরা জীবন দেয় নি, লক্ষ-লক্ষ তরুণ জীবন দানের ব্রত নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যায়নি। এই দেশটা পাকিস্তানের মতো আলোচনা ও ধর্মের ভিত্তিতে স্বাধীনতা লাভ করে নি। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা আমাদের অর্জন করতে হয়েছে। তাই যারা এই বিষয়টাকে রাজনৈতিক বিষয় বলে চালানোর চেষ্টা করছেন তারা এর পেছনের রাজনৈতিক ইতিহাসটাও অনুসন্ধান করেন। পাকিস্তানকে ঘৃণা করা রাজনৈতিক ইস্যু কেন হয়েছে তাও চিন্তা করেন।

বছর ৫০ আগে যা হয়েছে তা ভুলে যান, এখন তো পাকিস্তান এ রকম কিছু করছে না- এমন মনোভাব নিয়ে যারা বসে আছেন আজকে যদি আপনার সামনে আপনার মাকে কেউ ধর্ষণ করে তাহলে আপনি কিন্তু ৫০ বছর পরও তাকে ক্ষমা করবেন না। আমরাও পাকিস্তানীদের ক্ষমা করিনি, ঘৃণা করি। কারণ তাদের হাতে জীবন দেওয়া প্রত্যেকে আমাদের ভাই, ওদের হাতে সম্ভ্রম হারানো প্রত্যেকে আমাদের মা। মায়ের সম্ভ্রমহানির কোনো ক্ষমা নেই, ভাই হত্যার কোনো ক্ষমা নেই।

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর