নিরাপদ সড়ক চাই
১৩ ডিসেম্বর ২০২১ ১৫:৩৮
সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমান সময়ের আলোচিত মর্মস্পর্শী ঘটনা। এ দুর্ঘটনায় প্রতিদিন হারিয়ে যাচ্ছে হাজারো মানুষ, ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে হাজারো স্বপ্ন। পত্রিকার পাতা খুললেই এ সভ্যতার প্রমাণ মিলে। সড়ক দুর্ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ আমাদের নিরাপত্তার প্রধান হুমকি। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। ফলে অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করে পরিবার ও সমাজের বোঝা হয়ে দুর্বিষহ জীবন-যাপন করছে। দেশে যোগাযোগ ব্যবস্থার নাকি উন্নতি ঘটছে। কিন্তু কমছে না সড়ক দুর্ঘটনা। সড়ক পথ হয়ে উঠছে বিপজ্জনক। তাই স্বাভাবিকভাবেই সড়ক দুর্ঘটনা সম্পর্কে আলোচনা ও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া আজ সময়ের দাবি।
সড়ক দুর্ঘটনার অনেক কারণ বিদ্যমান। নিচে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কয়েকটি কারণ আলোচনা করা হলো :
অতিরিক্ত গতি এবং ওভারটেকিং : সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হচ্ছে গাড়িগুলোর অতিরিক্ত গতিসীমা। অসাবধানতার সঙ্গে অতিরিক্ত গতিতে অন্য একটি চলমান গাড়িকে ওভারটেকের চেষ্টাই সড়ক দুর্ঘটনার একটি অন্যতম কারণ। পুলিশ রিপোর্টেও বেশির ভাগ দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বলা হয়েছে অতিরিক্ত গতি এবং চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো।
অপ্রশস্ত পথ : অপ্রশস্ত পথ ব্যবস্থাও বাংলাদেশের অধিকাংশ সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। ঢাকা থেকে যাতায়াতের সবচেয়ে ব্যস্ত পথ ঢাকা-আরিচা এবং ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়ে। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমাণ প্রশস্ত না হওয়াতে এ দুটি পথেই দুর্ঘটনা এবং হতাহতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ঘটে।
ওভারলোডিং : ‘ওভারলোড’ মানে পরিমিতির বেশি মাল বহন করা। বেশি ওজনের মালামাল বহন করে গতি সীমা ছাড়িয়ে প্রতিটি ট্রাকই এক একটি যন্ত্রদানব হয়ে উঠে। এর ফলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চালকরা প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটায়।
আইন অমান্য : সড়ক দুর্ঘটন অন্যতম কারণ আইন অমান্য করে গাড়ি চালানো। জরিপে দেখা গেছে, ৯১ শতাংশ চালক জেব্রা ক্রসিংয়ে অবস্থানরত পথচারীদের অধিকার আমলই দেয় না। পাশাপাশি ৮৪ ভাগ পথচারী নিয়ম ভেঙে রাস্তা পার হয়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরে শতকরা ৯৪ জন রিকশাচালক ট্রাফিক আইন ও নিয়মের প্রাথমিক বিষয়গুলোও জানে না। তারা জানে না ডানে বা বাঁয়ে যেতে হলে কি সংকেত দিতে হবে। কোথায় কিভাবে মোড় নিতে হবে। ফলে দুর্ঘটনা ঘটছে অহরহ।
ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা : বাংলাদেশে সড়ক পথের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৫ হাজার কিলোমিটার। এসব সড়ক ও মহাসড়কে প্রতিদিন কয়েক লক্ষ যন্ত্রচালিত যানবাহন চলাচল করছে। কেবল রাজধানী ঢাকায় বাস, মিনিবাস, প্রাইভেটকার, জিপ, পিকআপ, ট্রাক, অটোরিক্সা ও মটর সাইকেল মিলিয়ে কয়েক লক্ষ যানবাহন চলাচল করে। এছাড়াও বৈধ-অবৈধ রিকশার সংখ্যা কয় লক্ষ তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু এই বিশাল যানবাহন বাহিনীকে সুশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে আনার মতো ট্রাফিক ব্যবস্থা এদেশে আজও গড়ে উঠেনি।
সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষয়ক্ষতি : সড়ক দুর্ঘটনার ফলাফল কেবল মানুষের মৃত্যুর ক্ষতি নয়, অপূরণীয় আরো অনেক ক্ষতির বোঝা চাপিয়ে দেয় সাধারণের জীবনে। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে অনেক মানুষ প্রাণে বেঁচে থাকে বটে, কিন্তু জীবনের স্বাভাবিক গতি তারা হারিয়ে ফেলে চিরকালের মতো। পঙ্গুত্ব, শারীরিক বৈকল্য আর যন্ত্রণা ও বেদনার ভার বহন করে বেঁচে থাকা সেই সব মানুষের সংখ্যা আমাদের দেশে কম নয়।
পুলিশের এফআইআর (FIR মানে First Information Report) অনুযায়ী ২০১৪ সালে শুধু মহাসড়কগুলোতেই ২ হাজার ২৭টি দুর্ঘটনা ঘটে এবং এতে ২ হাজার ৬৭ জন নিহত হয় এবং অন্তত ২ হাজার জন আহত হয়। এটা কেবল পুলিশের নিকট নথিভুক্ত মহাসড়কগুলোর দুর্ঘটনার হিসাব। মহাসড়ক ছাড়া অন্যান্য সড়কে, পুলিশের কাছে নথিভুক্তহীন অসংখ্য সড়ক দুর্ঘটনার মাধ্যমে বাংলাদেশে মহাসড়কসহ নিহতের সংখ্যা প্রতি বছর গড়ে ১২-২০ হাজার জন। সম্প্রতি এক জরিপ থেকে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ১৫% থেকে ৩০% শয্যায় দুর্ঘটনা কবলিত রোগীদের ভর্তি করতে হচ্ছে, যা স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে সৃষ্টি করছে অপ্রত্যাশিত চাপ। এর ফলে স্বাস্থ্যখাতে সীমিত সম্পদের অনেকখানিই চলে যায় সড়ক দুর্ঘটনার আহতদের সেবায়।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে দেখা গেছে, গত ২০১৫ সালে ৬ হাজার ৫৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত এবং ২১ হাজার ৮৫৫ জন আহত হয়েছেন। ২০১৬ সালে ৪ হাজার ৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৫ জন নিহত এবং ১৫ হাজার ৯১৪ জন আহত হয়েছেন। ২০১৭ সালে ৪ হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৩৯৭ জন নিহত এবং ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত হয়েছেন। ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জন নিহত এবং ১৫ হাজার ৪৬৬ জন আহত হয়েছে। ২০১৯ সালে ৫ হাজার ৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮৫৫ জন নিহত এবং ১৩ হাজার ৩৩০ জন আহত হয়েছে। ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণে বছর ব্যাপী লকডাউনে পরিবহন বন্ধ থাকা অবস্থায় ৪ হাজার ৮৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জন নিহত ও ৮ হাজার ৬০০ জন আহত হয়েছেন।
সব মিলিয়ে গত ৬ বছরে ৩১ হাজার ৭৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ হাজার ৮৫৬ জন নিহত এবং ৯১ হাজার ৩৫৮ জন আহত হয়েছেন। জাতিসংঘ ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সালকে সড়ক নিরাপত্তা দশক ঘোষণা করে সদস্য দেশগুলোর সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ঠিক করেছিল। অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সে অঙ্গীকার রক্ষা করতে পারেনি।
নিঃশব্দ আঁততায়ীর মতো প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনা আমাদের চার হাজার স্বজনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। কিন্তু এ মৃত্যুকে তো আমরা ঠেকাতে পারি। এজন্য প্রয়োজন একটু সচেতনতা, ধৈর্য, সতর্কতা আর ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ। যেসব কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে তার প্রত্যেকটি কারণই প্রতিরোধযোগ্য। তাই সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের জন্য করণীয় হলো:
১. বেপরোয়া গতি নিয়ন্ত্রণ : সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হলো গাড়িগুলোর বেপরোয়া গতি এবং ওভারটেকিং করার প্রবণতা। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর প্রবণতা বেশি দেখা যায় ট্রাক, মিনিবাস আর দূরপাল্লার বাস চালকদের মধ্যে। এসব গাড়ির চালকগণ ভুলে যায় বেশ কিছু মানুষের জীবন কিছু সময়ের জন্য তাদের জিম্মাদারিতে থাকে। চালকগণ একটু সহনশীল হলে, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোজনিত সড়ক দুর্ঘটনা সহজেই প্রতিরোধ করা যায়।
২. ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ : ট্রাফিক আইনের যদি যথাযথভাবে প্রয়োগ করা হয় এবং আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে যদি কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তাহলে সড়ক দুর্ঘটনার পরিমাণ অনেক কমে যাবে বলে বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন।
৩. লাইসেন্স প্রদানে জালিয়াতি প্রতিরোধ : সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করার জন্য গাড়ির লাইসেন্স ও চালকদের লাইসেন্স প্রদানের জালিয়াতি প্রতিরোধ করতে হবে। বর্তমানে দেখা যায় লাইসেন্স প্রদানে জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহণ করে কর্তৃপক্ষ অনভিজ্ঞ ড্রাইভারদের হাতে ছেড়ে দেন নিরীহ যাত্রীদের ভাগ্য। তাই গাড়িচালক ও গাড়ির লাইসেন্স প্রদানে সুষ্ঠু নীতিমালা প্রণয়ন করে তা কার্যকর করতে হবে।
৪. ফিটনেস সার্টিফিকেটবিহীন গাড়ি প্রতিরোধ করা : এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, দেশের বিভিন্ন সড়কে চলাচলকারী গাড়ির মধ্যে অর্ধেকের বেশি গাড়ি লাইসেন্স বিহীন। আবার লাইসেন্সবিহীন গাড়ির মধ্যে অধিকাংশেরই রাস্তায় চলাচলের উপযোগী ফিটনেস নেই। যার ফলে ঘটে দুর্ঘটনা। আবার যেসব গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট আছে তার মধ্যেও রয়েছে অনেক গাড়ি যেগুলো চলাচলের উপযোগী নয়। এগুলোর ফিটনেস যাতায়াত করার সময় নানাবিধ দুর্ঘটনার শিকার হয়। সুতরাং সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের জন্য অবৈধ উপায়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদান করা বন্ধ করে ফিটনেসবিহীন গাড়ির চলাচল কঠোরভাবে প্রতিরোধ করতে হবে।
৫. পথচারীকে সতর্ক হতে হবে: সড়ক দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে থাকার জন্য পথচারীদের পথ চলার নিয়ম সম্পর্কে অবহিত হতে হবে। পথচারীরা অনেক সময় প্রচলিত আইন অমান্য করে রাস্তা দিয়ে হাঁটেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ওভার ব্রিজ থাকা সত্ত্বেও তারা খুব কমই ব্যবহার করেন। তাছাড়া অনেক সময় পথচারীরা অসতর্কতার সাথে রাস্তা পার হন যার দরুন অনেক দুর্ঘটনা ঘটে। সুতরাং রাস্তায় চলাচলের সময় পথচারীদের আরও সতর্ক ও সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
৬. সড়ক দুর্ঘটনা রোধের জন্য বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ : সড়ক দুর্ঘটনার আর্থ-সামাজিক ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ অপরিসীম। তাই সরকার সড়ক দুর্ঘটনা রোধের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যেমন – সড়ক নিরাপত্তা ও সরকার : সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সময় সরকার দেশে সড়কসংশ্লিষ্ট কয়েকটি সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করে। সড়ক পরিবহন সেক্টরের সার্বিক তত্ত্বাবধান, ব্যবস্থাপনা ও সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে সরকার ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ-BRTA) গঠন করে। এ সংস্থা দেশের যান্ত্রিক যানবাহনের রেজিস্ট্রেশন, উপযুক্ততা সনদসহ মোটরযান অধ্যাদেশে বর্ণিত অন্যান্য রেগুলেটরি দায়িত্ব পালন করে আসছে। এর আগে দেশের সড়ক পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে ৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ সালে জারিকৃত এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে গঠিত হয় বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি-BRTC)। পরিবহন অবকাঠামো ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা ও সমন্বয় সাধন এবং পরিবহন সংক্রান্ত বিভিন্ন সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ও দীর্ঘমেয়াদি পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত হয়েছে ঢাকা যানবাহন সমন্বয় বোর্ড (ডিটিসিবি-DTCB)। এ ছাড়াও সরকার সড়ক নিরাপত্তার জন্য সড়ক নিরাপত্তা সেল গঠনের পাশাপাশি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট BUET) দুর্ঘটনা রিসার্চ সেন্টার স্থাপন করেছে। সড়ক ও মহাসড়কে অপরাধ এবং দুর্ঘটনা রোধকল্পে দেশের ৭২টি হাইওয়ে ফাঁড়িকে একক কমান্ডে এনে ১১ জুন ২০০৫ যাত্রা শুরু করে হাইওয়ে পুলিশ।
প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে ঝরে যায় কত প্ৰাণ। কত ঘরে জমে বুক চাপা কান্না। কত পরিবারের বেঁচে থাকার আলো যায় নিভে। স্বপ্ন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়, কিন্তু তবুও মানুষকে পথ চলতে হয়। মানুষের পথ চলা যতদিন থাকবে দুর্ঘটনাও ততোদিন থাকবে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধের কার্যক্রম জোরদার না করলে এ নিঃশব্দ ঘাতকদের রোধ করা যাবে না। তাই বাড়াতে হবে জনসচেতনতা। সচেতন হতে হবে যানবাহন চালক, হেলপার, যানবাহন মালিক, যাত্রী, পথচারী, ট্রাফিক পুলিশ সবাইকে।
লেখক : শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
সারাবাংলা/এসবিডিই