পঞ্চগড়ে সম্ভাবনাময় পাথর-চা শিল্প ও সংকটে সর্বনাশা মাদক
২৭ ডিসেম্বর ২০২১ ২০:২১
এক.
মানচিত্রের প্রথম জেলা পঞ্চগড়। স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রথম বিজয় অর্জন করে এই জেলাটিই। শীত ভীষণ তীব্র এবং একরোখা। একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাজে পঞ্চগড় গিয়েছিলাম। ওখানে যেতে অপরিহার্য বাহন ট্রেন অথবা বাস। সাধারণত আরামের জন্য রেলপথটাই মানুষ বেশি পছন্দ করে। আমিও রেলপথ বেছে নিয়েছিলাম। তার জন্য টিকেট পাওয়াটা ছিল ‘সোনার হরিণ’ পাওয়ার মতো। ট্রেনে যেতে যেতে অনেক মানুষের দেখা পেলাম, তারা সবাই অপরিচিত। এদের মধ্যে একজন আমার পাশের সিটে বসেছিলেন। ওর নাম ‘স্বচ্ছ’। সবে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। আলাপচারিতায় মনে হয়নি কম বয়স ওর। খুবই আন্তরিক ছেলে।
স্বচ্ছর বাড়ি বোদায়। কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের কথা বলতেই ওর চোখে-মুখে এক গৌরবের ছাপ দেখতে পেলাম। কথা প্রসঙ্গে এবং আমার পরিচয় পাওয়ার পর সে আমাকে তার বাবার কথা বলল— বোদা মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আশরাফুল আলম লিটন। একসময় তিনি কমরেড ফরহাদের সঙ্গে রাজনীতি করতেন। ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, কমিউনিস্ট পার্টি করতেন। এখন নিজেকে টিকে রাখা ও পাওয়ার প্র্যাকটিসের জন্য আওয়ামী লীগ করেন। বোদা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তিনি।
এগুলো স্বচ্ছের কথা। ওকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম পঞ্চগড়ের কথা। সে যা বলল, কোনোটিই পঞ্চগড়ের মানুষের জন্য ভালো কোনো কথা না। পঞ্চগড়ের ঐতিহ্য, পঞ্চগড়ের সংস্কৃতি কিংবা পঞ্চগড়ের পর্যটন নিয়ে তার কথার বেশিরভাগই ছিল নেতিবাচক।
আমার বিপরীত দিকে বসা কম বয়সী দম্পতি আনহা-আলিম আফ্রিদী আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন— পঞ্চগড়ে ঘুরতে যাচ্ছি কি না। বোঝা গেল, স্বচ্ছের কথা শুনে তারা কিছুটা ক্ষুব্ধ। নিজের অঞ্চল সম্পর্কে স্থানীয় কারও মন্দ কথায় যেকোনো মানুষেরই কিছুটা হলেও খারাপ লাগাই তো স্বাভাবিক। আনহা-আলিম আফ্রিদী অবশ্য পঞ্চগড় নিয়ে ভালো ভালো কথা বলছিলেন। বিভিন্ন জায়গার কথা, খাওয়ার কথা, কৃষি উন্নয়নের কথা, চা-বাগানের কথা, পাথর শিল্পের সংকট, করতোয়া নদীর কথা বলছিলেন। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম।
ওরা বললেন, ওদের ওখানে সবাই টিউবওয়েলের পানি ব্যবহার করে। আলাদা করে ফুটানো পানি বা মিনারেল ওয়াটার ব্যবহার করতে হয় না। এখানকার খাওয়া-দাওয়া ভীষণ টাটকা ও প্রাকৃতিক। ওদের কথাগুলো খুবই সত্য। আনহা নামে মেয়েটি খুব আফসোস করল, অক্টোবর-নভেম্বরে গেলে কাঞ্চনজঙ্ঘাটা পরিষ্কার দেখা যেত। আলিম আফ্রিদী আমার মোবাইল নম্বরটি নিয়ে বললেন, তাকে বললে আমাকে পঞ্চগড় ঘুরে ঘুরে দেখাবেন। সময় কম পাওয়ার কারণে সবকিছু না দেখতে পারলেও আলিম আফ্রিদী আমাকে কিছু কিছু জায়গা দেখিয়েছেন।
এখানকার মানুষ খুব সহজ-সরল। শান্তশিষ্ট এলাকা। মারামারি-কাটাকাটি নাই। তবে ভূমি বিরোধ, নারী নির্যাতন, মাদক সমস্যার মতো বিষয়গুলো এই অঞ্চলের গৌরব ও সম্ভাবনা ম্লান করে দিচ্ছে। সড়ক ব্যবস্থা মসৃণ, চমৎকার। তবে ভীষণ ধুলা ওড়ে এখানে, বায়ুদূষণ হয়। এগুলো বড় সমস্যা।
মাছ ধরা, জার বুনন, মাটির হাঁড়িপাতিল তৈরি, হাঁস-মুরগি পালন, বাঁশ-বেতের কাজই ছিল এ অঞ্চলের জীবন-জীবিকা অর্জনের অন্যতম সংস্কৃতি। পরবর্তী সময়ে কৃষি সংস্কৃতি শুরু হয় চীনা কাউন, ভুট্টা ও পয়রা চাষের মধ্য দিয়ে। বর্তমানে হচ্ছে ধান, গম, আখ, ভুট্টা, ডাল, চীনাবাদাম, তরমুজ, কমলালেবু, স্ট্রবেরিসহ উন্নত ফল ও ফসল। কর্মে যুক্ত হয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ, পাথর-বালি আহরণ। গড়ে উঠেছে মিল ও ফ্যাকটরি। সবুজ ঘেরা সমতল পঞ্চগড়ের উর্বর মাটিতে চা-চাষের মহোৎসব এখানকার মানুষের কৃষি উন্নয়ন ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। জুটমিল, ডিস্ট্রিলারিজ, খাম্বা, জেমকন ফ্যাকটরিতে উৎপাদন পর্যাপ্ত হলেও শিল্প সংস্কৃতিতে এ অঞ্চলের জনমানুষের মাঝে তা ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলতে পারেনি। জগদলের স্থানীয় ব্যবসায়ী আসলাম উদ্দিন বলেন, ‘পঞ্চগড়ের মাটি সোনা। এখানে যা লাগানো হবে, সব ফলবে।’ তবে চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখানকার শ্রমিকদের অনেকে কষ্টে আছেন বলে চিনিকল সংশ্লিষ্টরা জানান।
দুই.
ঘড়ির কাঁটা, রাত ২টা। সরব হয়ে উঠেছে চা বাগানগুলো। বাগানজুড়ে চলছে আলোর খেলা। রাতের আঁধারের মাঝে ছোট ছোট বাতি নড়াচড়া করছে। দূর থেকে হঠাৎ দেখলে কেউ ভৌতিক চরিত্র বলে বিভ্রমে পড়তে পারেস। কিন্তু চরিত্রগুলো প্রকৃতপক্ষে রাতের চা শ্রমিক। মাথায় টর্চলাইট বেঁধে চা পাতা তোলার কাজ করছেন।
একসময় দিনের বেলায়ও সূর্যের কড়া তাপ সয়েই চা পাতা তোলার কষ্টসাধ্য কাজ করেছেন চা শ্রমিকরা। এতে যেমন ভোগান্তি পোহাতে হতো, তেমনি শুকিয়ে যেত পাতা। কারখানা মালিকরাও নিতে চাইতেন না শুকনো পাতা। গত দুই বছর ধরে শ্রমিকরা মধ্যরাত থেকে পাতা তোলার কাজ শুরু করেন। দিন দিন বাড়তে থাকে রাতের শ্রমিকের সংখ্যা। প্রতিটি দলে শ্রমিক থাকেন ১০ থেকে ১৫ জন। প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতা তোলার বিনিময়ে বাগান মালিকরা শ্রমিকদের মজুরি দেন ৩ টাকা। একজন রাতের শ্রমিক প্রতিদিন পাতা তুলতে পারেন ২০০ থেকে আড়াইশ কেজি। সেই হিসাবে তাদের দৈনিক আয় ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত।
শ্রমিকদের কাছে জানা যায়, রাত ৯টা থেকে ১০টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন তারা। উঠে পড়েন রাত ২টায়। তারপর হাতে চা পাতা কাটার চাকু আর মাথায় টর্চলাইট বা মোবাইলের লাইট বেঁধে নেমে পড়েন চা বাগানে। রাতের নিরব শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশে চলতে থাকে চা পাতা তোলার কাজ। সকাল ১০টার মধ্যেই পাতা তুলে তা কারখানায় পাঠানোর পর বাড়ি ফেরেন। পরে দিনের বেলা আবার অন্য কাজ করেন। দ্বৈত আয়ে সুন্দরভাবে চলছে তাদের সংসার। অর্থকষ্টে থাকা এই শ্রমিকদের জীবনে এখন সচ্ছলতা এসেছে।
পঞ্চগড়ে সাতটি ও ঠাকুরগাঁওয়ে একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রায় ৭ হাজার ৫৯৮ একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। ভ্রমণের সময় রাস্তার দুই পাশে যেদিকে চোখ যায়, দেখা যায় দিগন্ত-বিস্তৃত চা বাগান। সবুজ, শ্যামল, সুন্দর, সুবর্ণ, রূপসী, অনন্য। সৌন্দর্যপিপাসু মনের ক্ষুধা মেটানোর এক অপরূপ ভূ-চিত্র। পঞ্চগড়ের চা শিল্পে চাষিদের পাশাপাশি ২০ থেকে ২৫ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। তারা আগে অলস সময় কাটাতেন। কোনো কাজ ছিল না। এখন চা বাগানে কাজ করে তারা সচ্ছলতা পেয়েছেন। এ অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে জানা যায়, যাদের ২ বিঘা জমি আছে, সেগুলো উঁচু, তারা চা বাগান করে ফেলেন। প্রথম বছর পরিচর্যা করলেও দ্বিতীয় বছর থেকে ৪০ দিন পর পর চা পাতা কাটা হয়। কৃষকরা দিন দিন লাভবান হয়।
তিন.
২১ ডিসেম্বর। শীত ভালোভাবেই জেঁকে বসেছে। পঞ্চগড় শহর থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তেতুঁলিয়ায় জেলা পরিষদ ডাকবাংলোয় যখন পা পড়ল, তখন গড়ির কাঁটায় ঠিক সকাল সাড়ে ৮টা। কুয়াশা তখনো কাটেনি, বাংলোর এক পাশে দাঁড়িয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা আর হিমালয় দেখছিলাম। দেখা যাচ্ছিল না, অক্টোবর-নভেম্বরে পরিষ্কার দেখা যায়। পাথর শনাক্তের লোহার রড দিয়ে নদী থেকে পাথর তুলছে শ্রমিক। দীর্ঘ চৌদ্দ ঘণ্টা ভ্রমণে যখন চোখে ক্লান্তি, ঠিক তখনই দৃষ্টি পড়ল মহানন্দার বুকে।
ওপাশটা ভারতীয় কাঁটাতারে ঘেরা, এ পাশটা বাংলাদেশ। দুই দেশের সীমানার ওপর দিয়েই মহানন্দার চলাফেরা। হিমালয়ে কোলঘেঁষা মহানন্দার পানি থেকে ধোঁয়া উঠছিল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার মহালিদ্রাম পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়ে পশ্চিবঙ্গের উত্তরাংশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে আবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলা হয়ে ভারতে প্রবেশ করেছে নদীটি। পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা থেকে শুরু করে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ১৫ থেকে ১৬ কিলোমিটার জুড়ে দুই দেশের সীমানা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে মহানন্দা। মূলত এই অংশটুকুর মধ্যেই পাথর উত্তোলন করা হয়। মহানন্দা নদীর বাংলাদেশের যে অংশটুকুর মধ্যে পাথর তোলা হয় এর এক পাশে তেঁতুলিয়া, অন্য পাশে ভারতের হাতিয়া গছ ও শিলিগুড়ি।
নদীটির উজানে ভারতের ফুলবাড়িতে রয়েছে স্লুইজ গেট। ভারত এ গেট বন্ধ রাখে, আবার কখনো খুলে দেয়। খুলে দিলেই পানির স্রোতের সঙ্গে ভেসে আসে বিভিন্ন আকৃতির পাথর। সেই পাথরেই জীবিকা তেঁতুলিয়াসহ পঞ্চগড়ের অধিকাংশ মানুষের। দূর থেকেই আঁচ করা গেলো বেশ ঠান্ডা হবে মহান্দার পানি। কিন্তু তাতে কী, তবুও থেমে নেই মহানন্দা পাড়ের মানুষের কর্মব্যস্ততা। বাতাসে ফুলানো গাড়ির চাকার টিউবের ভেলায় পাথর তুলছেন এক শ্রমিক।
নদীতে নামা পাথর শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাদের জীবনযাপন ও মহানন্দার গল্প। তারা জানান, এককালে অভাব-অনটন ছিল এখানকার মানুষের নিত্যসঙ্গী। এখন আর সে অবস্থা নেই, পাল্টেছে জীবনের দৃশ্যপট। মহানন্দার পাথর তুলে যে আয় হয়, তা দিয়েই ঘুরে তাদের জীবনের চাকা।
কেউ পাথর তুলছেন। আবার কেউ নদীর ঘাট থেকে সে পাথর কিনে এনে মেশিনের কাছে দিচ্ছেন। কেউ মেশিন চালিয়ে রোজগার করছেন, আবার কেউ ট্রাকে পাথর লোড-আনলোড করছেন। অনেকে আবার কারবারিদের কাছে পাথর সরবরাহ করছেন। বিশাল কর্মযজ্ঞ। মহানন্দার পাথরই তাদের বেঁচে থাকার অন্যতম অবলম্বন এখন।
সরকারের বিধিনিষেধ থাকার কারণে আগের মতো স্থানীয়ভাবে পাথর উত্তোলন করতে পারেন না। পাথরের একটি সংকট বর্তমানে রয়েছে। অনেক জায়গায় তারা প্রত্যাশিত পাথর সরবরাহ করতে পারছেন না।
চার.
পঞ্চগড়ে হাজারও নারী পাথর শ্রমিকদের অভিযোগ, পেটের দায়ে ও সংসার চালাতে তারা পুরুষের সমান কাজ করেও ন্যায্য মজুরি পান না। একসময় এখানে নারীরা ঘর থেকে বের হতেন না। কিন্তু নিজেদের প্রয়োজনে ও অভাবের তাড়নায় ক্রমেই উপজেলার নারী শ্রমিক পাথর শিল্পে যুক্ত হয়ে পড়েন। দেশের সর্ব উত্তরের অঞ্চলে ভূ-গর্ভস্থ পাথর উত্তোলন-প্রক্রিয়াকরণ ছাড়াও সমতল ভূমিতে চা চাষ, চা পাতা সংগ্রহ, ভবন নির্মাণ ও কৃষিকাজে পুরুষের পাশাপাশি এদের অবদান অপরিসীম। পাথর ভাঙাসহ বিভিন্ন কাজ করে সংসারের হাল ধরেছেন এসব নারী শ্রমিকরা।
পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়াতেই পাথরের কাজ করেন অন্তত ৫০ হাজার শ্রমিক। তাদের অধিকাংশই নারী। সেখানে পুরুষ শ্রমিকরা সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কাজ করে মজুরি পান ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা। কিন্তু একই সময় পর্যন্ত কাজ করে নারী শ্রমিকরা পান মাত্র ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। সারাদিন পাথর ক্রাশিং মেশিনে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে সংসারের হাল ধরেছেন এসব নারী শ্রমিকরা। কিন্তু সমান পরিশ্রম করলেও পুরুষের তুলনায় নারী শ্রমিকরা এখনো মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
ফাতেমা বেগম বলেন, ‘কয়েক বছর আগত স্বামী পালায় ঢাকাত আরেকটা বিহা করিছে, ঐঠে আরহ দুইঝন ছুয়া ছে। পাথর ক্রাশিং মেশিনত কাজ করে সংসার চালাছু। দুই ছুয়াক লেখাপড়া করাছু। পুরুষলার লগত ঔ সমান কাজ করছু। কিন্তু হামার মুজরি উমার চেয়ে কম। এইখান রৌদত এইরকম ঘাম ঝড়চে হামার। কিন্তু হামার মুজুরি কম হবে কেনে? পুরুষলার মতো মোর একশ টাকা বেশি হলে ছুয়ালাক ভালো খাবার তো কিনে দিবা পারিম।’
স্থানীয় পাথর ও চা বাগান ব্যবসায়ী আসলাম উদ্দিনকে জিজ্ঞাসা করলে বলেন, নারী বলেই তাদের মজুরি কম দেওয়া হয়।
পাঁচ.
পঞ্চগড় অঞ্চলে প্রচলিত শব্দাবলি মূলত প্রাকৃত ও প্রাচীন বাংলারই সামান্য পরিবর্তিত রূপ। পালি, প্রাকৃত, প্রাচীন মধ্য বাংলা এবং ব্রজবুলি-অসমীয়-হিন্দি-বিহারি ইত্যাদি শব্দগুচ্ছ এই অঞ্চলে অনেক বেশি প্রচলিত। মুন্ডা ও সাঁওতালি ভাষার কয়েকটি শব্দ যেমন— চাউলি, চুলা, জাইত, পাড়া, হাল, ডোঙ্গা, মেয়েছেলে, বেটাছেলে, মেয়েলোক ইত্যাদি এই অঞ্চলে প্রচলিত। স্বামী অর্থে ‘ভাতার’, বিবাহ অর্থে ‘বিহা’, যুবক-যুবতী অর্থে ‘গাভুর’, বিধবা অর্থে ‘আড়ি’, বাউন্ডুলে অর্থে ‘বাউদিয়া’, স্ত্রী অর্থে ‘মাইয়া’, ঘর জামাই অর্থে ‘ডাঙ্গুয়া’, ব্যথা অর্থে ‘বিষ’ ইত্যাদি শব্দগুলো পঞ্চগড়ের ভাষায় ব্যাপকভাবে প্রচলিত।
১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত নজরুল পাঠাগারকে কেন্দ্র করে পঞ্চগড়ে সাংস্কৃতিক চর্চা গতিশীল হয়ে ওঠে। অসংখ্য বই, মানচিত্র, বিশ্বকোষ, রচনাবলি ইত্যাদির সমৃদ্ধ সংগ্রহে এই পাঠাগারটি ছিল পঞ্চগড় অঞ্চলের জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার এক বাতিঘর। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনী পাঠাগারের অনেক মূল্যবান বই ও এনসাইক্লোপিডিয়া জ্বালিয়ে দেয়। পঞ্চগড় অঞ্চলে স্থানীয় সংস্কৃতির মধ্যে ‘হুলির গান’ সবেচেয়ে বেশি প্রচলিত ও জনপ্রিয়। হিন্দুদের হুলি পুজা থেকে হুলির গান নামটির উৎপত্তি হলেও সমসাময়িক ঘটনা বা অসঙ্গতিপূর্ণ সামাজিক চিত্র, প্রেম কাহিনী ইত্যাদিকে কেন্দ্র করেও ব্যাঙ্গাত্মক ও রসাত্মকভাবে এই গান পরিবেশিত হয়। সাধারণত শীতকালে রাতের বেলায় এ গান পরিবেশিত হয়। হুলি পালা শ্রেণির গান। এই গানে যেমন রয়েছে নাটকীয়তা, তেমনি আছে কাহিনীর ধারাবাহিক বিন্যাস। কাহিনীকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য একজন ছেলে (মেয়ের সাজে ছেলে অভিনেতা) এবং একজন সং (জোকার) উপস্থিত থাকে। এরাই দর্শক ও শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। হুলি পরিবেশনের সময় ঢোল, বাঁশি, কাসর, সারেঙ্গী ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ও বর্ণিল পোশাক ব্যবহৃত হয়।
ছয়.
পঞ্চগড়ে মাদক পরিস্থিতি সেখানকার তরুণ সমাজকে দিন দিন অবক্ষয়ের দিকে যাচ্ছে। এটাই পঞ্চগড়ের দুঃখ। ছেলের হাতে মায়ের খুন হওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে এখানে। মাদকের ছোবলে আক্রান্ত তরুণ ও যুবসমাজ বিপর্যয়ের মুখে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাদক ছড়িয়ে পড়ার কারণে সেখানকার পরিবেশ কলুষিত হচ্ছে। অন্যদিকে মাদকের জন্য অর্থের জোগান দিতে গিয়ে এসব ছাত্ররা চাঁদাবাজি ও দলবাজি করে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ছড়াচ্ছে। সীমান্তের ওপার থেকে আসছে মাদক। হাত বাড়ালেই এখানে শহর কী গ্রাম— সব জায়গায় মাদক মেলে। দুয়েক জায়গায় গোপনে মাদক কারবার চললেও বেশিরভাগ স্থানেই চলে প্রকাশ্যে বেচাকেনা। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে।
মাদক ও চোরাকারবারিদের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে পঞ্চগড় সদর উপজেলার শিংরোড প্রধানপাড়া, নায়েকপাড়া, ভুজারিপাড়া, দক্ষিণপাড়া, ঘাগড়া, মোমিনপাড়া, জুলিপাড়া, বাঙালপাড়া, বড়দরগা, নালাগঞ্জ, বড়বাড়ি, অমরখানা, টোকাপাড়া সীমান্ত। বোদা উপজেলায় রয়েছে বড়শশী, পাহাড়িয়া, ধামেরঘাট, সুয়েরপাড়, বালাপাড়া, মালকাডাঙ্গা, সরদারপাড়া, কাজীপাড়া, ডাঙ্গাপাড়া, মহিষবাথান ও নাওতারি সীমান্ত।
এছাড়া তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর ইউনিয়নের ভূতিপুকুর, সরদারপাড়া, দেবনগর ইউনিয়নের শুকানি, কালিয়ামনি, শালবাহান ইউনিয়নের পেদিয়াগছ, তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের শারিয়ালজোত, বড়বিল্লাহ, পুরাতন বাজার, সরদারপাড়া, তীরনইহাট ইউনিয়নের ভোকতিডাঙ্গী, ইসলামপুর ও রৌশনপুর, বাংলাবান্ধা ইউনিয়নের দেবীভিটা, বন্দিভিটা, সরদারপাড়া, নারায়নজোত, চুতরাগছ, উকিতজোত, জাগিরজোত, কাশেমগঞ্জ, বাংলাবান্ধা এবং আটোয়ারী উপজেলার ধামোর, তোড়িয়া, সোনাপাতিলা, গিরাগাঁও, বোদগাঁও সীমান্ত এলাকাও ব্যবহার হয়ে আসছে।
বাংলা মদ, চোলাই মদের সঙ্গে এসব সীমান্তে ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা, গাঁজা, প্যাথেড্রিন ইনজেকশনসহ নানা ধরনের মাদক ঢুকে যাচ্ছে। কখনো আসছে অবৈধ অস্ত্রও। এসবের সঙ্গে ব্যবসায়ী শিল্পপতি, প্রভাবশালী ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানেরা জড়িয়ে পড়েছে এসব নেশায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব দেখেও না দেখার ভান করে থাকেন।
মাদকের বিরুদ্ধে ঘরে ঘরে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছিলেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। মাদকের ভয়াবহ গ্রাস থেকে তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করতেই এই ঘোষণা দেন তারা। এসব ঘোষণা যে ‘গালগল্প’, স্থানীয় কয়েকজন তা মনে করেন। তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, সেসব দলের লোকজনই এসব মাদক কারবারে জড়িত। স্থানীয়রা মনে করে— এ মাদক সমস্যাটাই পঞ্চগড়কে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
সাত.
পঞ্চগড়ে পর্যটনে সম্ভাবনা প্রচুর। রাজনগড়, মিরগড়, ভিতরগড়, দেবেনগড় ও হোসেনগড়— এই পাঁচটি গড়ের সমন্বয়েই হয়েছে জেলার নাম ‘পঞ্চগড়’। হিমালয়কন্যা নামেও দেশজোড়া এ অঞ্চলের পরিচিতি ছিল। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত একটি থানা ছিল। এখানে দেখার মতো অনেক কিছু আছে। সড়ক ব্যবস্থা অনেক উন্নত হলেও পরিবহন ব্যবস্থা অপ্রতুল। পর্যটন খাতকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য পর্যাপ্ত উদ্যোগের অভাব রয়েছে। জেলা শহরটিকে ঘিরে একটি পরিকল্পনা নেওয়া উচিত। এ বিষয়ে আমাদের ভাবার দরকার।
লেখক: রাজনীতিবিদ, সংগঠক
সারাবাংলা/টিআর