‘উজ্জ্বল’ স্মৃতিগাঁথা
৩০ জানুয়ারি ২০২২ ১৯:৪১
ঠিক বেলা ১২টা ২৫ মিনিট। স্নেহাস্পদ রিপায়নের ফোন। অঝোর ধারায় কান্না। উজ্জ্বল চলে গেছে। কত বয়স হল তার! ৪২ কি ৪৩। একমাত্র সন্তান এখনো পাঁচ পেরোয়নি। দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র নামের একটি এনজিওতে কাজ করত। যুব আন্দোলনের নিবেদিত মুখ। যুব ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক। ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার সভাপতি ছিল। উজ্জ্বলের সাথে না ছাত্র ইউনিয়ন, না যুব ইউনিয়ন- কোনটাই করিনি। প্রায় এক যুগ রাজনৈতিক দল ও কাজের সাথে যুক্তও নই। তবুও উজ্জ্বলের সাথে বহু উজ্জ্বল স্মৃতি আমার রয়ে গেছে। আমার পেশাগত জীবনের কয়েকজন বন্ধুর সাথেও রয়েছে উজ্জ্বলের গভীর সম্পর্ক।
উজ্জ্বল ছিল একজন অসম্ভব পরিশ্রমী তরুণ। ছিল ভীষণ আদর্শনিষ্ঠ। জেদী ও একরোখা মনোভাবের উজ্জ্বল একাই টানতে চাইত গন্ধমাদন পর্বতের ভার। প্রায় একক পরিশ্রম করে সে একা চষে বেড়িয়েছিল চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার থানা-উপজেলা। দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানচিত্র আর যাতায়াতের পথ এমন যে, চাইলেই এক রুটের বাসে চেপে সব থানায় যাওয়া যায় না। প্রচন্ড মনোবল, তীব্র কর্মস্পৃহা আর অসম্ভবকে হাতের মুঠোয় আনার প্রবল অভীপ্সা ব্যাতিরেকে তা কঠিন।
উজ্জ্বল চিন্তার জগতে খুব যে ভীষণ অগ্রসর ছিল তেমন নয়। তবে সংগঠক হিসেবে ছিল ভীষণ চৌকস। আর রাজনীতি ও সংগঠনের কাজে তার দৃঢ় নিষ্ঠা ও অনুরাগ তার সকল সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে অনেকের চেয়ে অনেক বেশি ভালোবাসায় আবদ্ধ করেছে।
উজ্জ্বল অনেক বেশি যোগাযোগ ও সম্পর্ক রাখত তার সময়কালের ও তার উত্তর ও পূর্ববর্তী প্রজন্মের সাথে। একটা জীবন্ত সম্পর্কের মধ্যে থাকা মানুষের জ্ঞান ও বোধ বই পড়া জ্ঞানের চেয়ে কম গভীরতর নয়। উজ্জ্বল একালে, এ-যুগে আমাদের মতো অনেক মানুষের কাছে ফিকে হয়ে আসা স্বপ্ন অনেক ভালবাসা নিয়েই আগলে ছিল। সাম্যের ভোর আনার স্বপ্নগুলো যতটা ফিকে হয়ে এসেছে, দুনিয়াজুড়ে নয়া উদারনীতি ততই ঘাড়ে জেঁকে বসেছে। মানুষ হিসেবে মানুষের পৃথিবীতে জন্মলাভ, মানুষের জন্য কিছু অধিকার দাবি করে। আর নিউ লিবারেল পুঁজিবাদ মানুষকে রেসের ঘোড়ার মত ছুটিয়ে বেড়ায়। চালকের আসনে বসা পুঁজির তীব্র চাবুকের সপাং সপাং দাবড়ানি খাওয়া মানুষের জন্য একেই অনিবার্য নিয়তি ও অপরিবর্তনীয় হিসেবে হাজির করতে চায়। নব্য উদারনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানাতে যে মানুষেরা তিমির বিনাশী আপাত অসম্ভবের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখে, তাদের মাঝেই বেঁচে থাকে মানুষের মহত্বম হয়ে উঠবার সাধনা। উজ্জ্বল সেই উজ্জ্বল মানুষের মাঝে উজ্জ্বল স্মৃতি নিয়েই থাকবে।
উজ্জ্বল তার পরিবারের একমাত্র পুত্র। স্ত্রী একটি বেসরকারি চাকরিতে। মা- বাবা বয়োবৃদ্ধ। গ্রামের সাথে ছিল তার নিত্য যোগাযোগ। গ্রামে নিজেদের ক্ষেতে কিছু আবাদ আর মাছের কিছু চাষ সে করছিল বেশ ক’বছর ধরেই। খুব যে সাফল্য বয়ে এসেছে তা নয়। কৃষিকাজে লাভের মুখ দেখা দুষ্কর বৈকি!
উজ্জ্বলের কাছ থেকে আমি খুব গভীরভাবে বুঝতে শিখেছিলাম, গভীর নলকূপগুলো নগর জীবনে আপাত সুখের পাশাপাশি পানির স্তরকে কী করে ক্রমশ আরো নীচে নামিয়ে দেয়। সুপেয় পানির স্তরকে ক্রমাগত নীচে নামিয়ে মানুষের ও পরিবেশের অমোচনীয় ক্ষতির কারণ নির্মাণ করছে। বস্তিবাসি মানুষের জীবনের সাথে পেশাগত কারণে যুক্ত থেকে, পরিসংখ্যানের ছাত্র উজ্জ্বল আমাকে হিসেব কষে দেখিয়েছে, কী করে দেশের সবচেয়ে নিম্নআয়ের বস্তিবাসি মানুষেরা সবচেয়ে বেশি ইউটিলিটি ( গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ) বিল বহন করে। উজ্জ্বল খুব মনযোগী শ্রোতা ছিল। আমাকেও নিবিষ্ট শ্রোতা হিসেবে তার জানাটুকু জানাতে কসুর করত না।
উজ্জ্বল আপাত কর্কশ গলার রগ সবটুকু ফুলিয়ে শ্লোগান ধরতে ভালবাসত। উজ্জ্বল তার বাবা মায়ের জন্য, সন্তানের জন্য, বন্ধুদের জন্য, পরিবারের জন্য অন্তঃপ্রাণ ছিল। তেমনি চূড়ান্ত উদাসীন ছিল নিজের জন্য। তার পকেটে ছিল ‘নিডোকার্ড স্প্রে’, যখন তার হার্ট এটাক হয়। সুতরাং, উজ্জ্বল তার স্বাস্থ্যের খবর যে জানত না, এ কথা বলা মুশকিল। তবে হার্ট এটাকের আগে-পরে, হাসপাতালে পৌঁছার আগে-পরে এটার ব্যবহার সে করতে পেরেছিল কি না জানার সুযোগ আর নেই। যদি তা করে ও থাকে, না ফেরার জগত থেকে ফেরানোর উপায় আর নেই।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে উজ্জ্বলের শবদেহের দিকে আমি বেশিক্ষণ তাকাতে পারিনি। উজ্জ্বলের জীবনের ঔজ্জ্বল্য এতটুকু ম্লান হয়নি আমার চোখে। উজ্জ্বল তখন যেন আরো শ্বেতশুভ্র। উজ্জ্বল হারেনি। আজ সকালেও তার বাড়ি বাঁশখালি থেকে শীতের হিমঝরা সকালে মোটর বাইক চালিয়ে শহরে এসেছে অফিসে। উজ্জ্বল ফাইটার ছিল। লড়াকু উজ্জ্বল জীবনের শেষ দিনেও লড়াই করেছে। সব লড়াইয়ে জয়-পরাজয় হয়না। বিজয়ী হয়েও হেরে যায় মানুষ। হেরেও বিজয়ী হয়। সংশপ্তক এর মালা উজ্জ্বল এর উজ্জ্বল স্মৃতিতে নিবেদন করি।
উজ্জ্বলের মৃত্যু আমাকে নিয়ে গেছে ১৪ বছর আগের এক ভোরে। ২০০৭ সালের জরুরি আইনের খড়গে মোবাইল নেটওয়ার্ক ছিল সারারাত বন্ধ। সকালে নেটওয়ার্কের আওতায় এসেই পেয়েছিলাম সে আরেক দুঃসংবাদ। অমিত সম্ভাবনা ও স্বপ্নের আরেক তরুণ কানু। সে সময় যুব ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম জেলার সহ-সভাপতি। এরকম বা এরচেয়েও আরো কম বয়সে আমরা হারিয়েছিলাম তাকে।
পরিবর্তন এর অপরিবর্তনয়তায় আস্থাশীল মানুষের সংগ্রাম থামে না। জীবন এর বহমানতায় তা আবহমান। চলমান।
উজ্জ্বল, প্রিয় ভাই আমার। উজ্জ্বল, আমার ফিকে হয়ে আসা স্বপ্নের উজ্জ্বল সারথি। উজ্জ্বল, লড়াইয়ে সমুজ্জ্বল তরুণ বন্ধু আমার, তোমাকে সালাম। তোমার সন্তানকে, প্রিয়তম পিতার ভালবাসা আর ছোঁয়া কেউ ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু তোমার প্রিয়জনেরা যেন সেই দায়িত্বটুকু পালন করে, যা তুমি বেঁচে থাকলে তোমার সন্তানের জন্য করতে কসুর করতে না। উজ্জ্বলের শেষ যাত্রায় সশরীর উপস্থিত সহযাত্রী আর উপস্থিত হতে না পারা দূরত্বের কারণে- এমন সব সহযাত্রীদের কাছে সেই নিবেদন রাখি।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, সমাজ সমীক্ষা সংঘ
সারাবাংলা/এসবিডিই