এ বিধি কেমন বিধি, বিধি মেনে চলে না!
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৬:২৫
ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিনে দুপুরের পর আমার গ্রামের বাড়ি থেকে একটা মৃত্যুসংবাদ এলো। যিনি মারা গেছেন, তিনি আমার এক চাচী। খবরটা শুনে বেশি অবাক হইনি। কারণ, চাচী ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন বহুবছর ধরে। এই বয়সে থেরাপি দিয়ে এত কষ্ট করে বেঁচে থাকার চেয়ে চলে যাওয়াই ভালো। স্বাভাবিক থেকেই আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, গ্রামে যাওয়া দরকার; জানাজায় যোগ দিতে হবে। কিন্তু, হাতে অনেক কাজ, তাই দোটানায় পড়ে গেলাম। হাতের ঘড়ি দেখলাম। ঘড়ির হিসেব বলল জানাজা পাবনা। তাই আর গেলাম না, বসে পড়লাম। আমার শৈশবের দিনগুলোতে এই চাচীদের সাথে মা কিভাবে গল্প গুজবে মেতে থাকতেন সেই স্মৃতিতে চলে গেলাম আমি।
ল্যাপটপ রেখে আবার প্রক্রেষ্টিনেশন! হঠাৎ মনে হলো ফ্রিজে খাবার নেই, রান্নাবান্না করতে হবে। তাই প্রক্রেস্টিনেশন থেকে বাঁচার জন্য আর দেরি না করে রান্না শুরু করলাম। রান্নার জন্য পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে দেখলাম চোখ দিয়ে অনেক পানি পড়ছে। আমিতো আরও বহুবার পেঁয়াজ কেটেছি কিন্তু এত পানি তো কখনো দেখিনি। নিজেকে বুঝালাম, বাড়িতে নিশ্চয়ই কান্নাকাটি চলছে; আর সেই কান্নার পানি বুঝি আমার চোখ দিয়ে পড়ছে! টি শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মুছলাম, কিন্তু পানি পড়া থামছেনা, এবার কিছুটা অবাকই হলাম! যাইহোক, রান্না শেষ করতে করতে দশটা বেজে গেলো। এরপর ফোনটা হাতে নিলাম। আমার দ্বিতীয় হাইস্কুল আল-আমিন একাডেমীর হোয়াটসএপ গ্রুপে দেখলাম বন্ধু ফরিদ উদ্দিন খান লিখেছে –আমাদের বন্ধু মশিউর রহমান টিপু আর নেই। যারা যারা দেখেছে, সবাই অবাক! আমিতো অবাকই, একটু সন্দেহও লাগলো। কারণ, মাঝে মাঝে বন্ধুরা এমনভাবে ফান করে যে কিছুই বোঝা যায়না। কিন্তু মৃত্যু নিয়ে কি ওরা এমন ফান করতে পারে!
এবার কনফার্ম হওয়ার জন্য ফেইসবুকে এলাম, দেখলাম একই খবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের মুখে মুখে। অর্থাৎ চাঁদপুর আল-আমিন একাডেমীর হোয়াটসএপে বন্ধু টিপুর মৃত্যু নিয়ে বন্ধুদের খবরটা ফান নয়। টিপু নেই! সত্যিই নেই! আমাকে এটা বিশ্বাস করতে হলো যে- বিধির খেল বোঝা বড় দায়! এ বিধি কেমন বিধি, যে বিধি বিধি মানে না, বিধি বুঝে চলেনা!
আচ্ছা মৃত্যু তো হয়ই। ঐ যে শুরুতে বলেছিলাম একই দিনে আমার একজন চাচীও মারা গেছেন। তার মৃত্যু নিয়ে তো আমার কিংবা আমাদের কোন প্রশ্ন নেই, কারণ তার বয়স হয়েছে এবং কঠিন একটা রোগও ছিল। কিন্তু টিপুর মৃত্যুটা আমরা কেন মেনে নিতে পারছি না। কম বয়স বলে? না, এর চেয়ে কম বয়সেও তো মানুষ মারা যায় এবং আমরা হয়ত মেনেও নেই। কিন্তু আমরা কেন টিপুর মৃত্যুটা মেনে নিতে পারছি না! এখানেই বিধির খেলা। যে টিপু আমাদের সব বন্ধুদের সাথে সদা হাসিখুশি, চঞ্চল, যে টিপু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ব্যাচের সব বিভাগের সবাইকে একত্রিত করার মতো তারুন্যবাহী কঠিন কাজটা করে! যে টিপু স্বাস্থ্য সচেতন টগবগে এক তরুন, যে টিপু পরোপকার করে আনন্দ পায়; সেই টিপুর মৃত্যুটা আমরা মেনে নিতে পারছিনা।
কারণ এটা সময় নয় টিপুর মৃত্যুর! টিপু এখন স্বপ্ন দেখবে তার ক্যারিয়ারের পরবর্তি ধাপ নিয়ে; টিপু এখন স্বপ্ন দেখবে তার দুই শিশু বাচ্চা, ছেলেটা ও মেয়েটার ভবিষ্যৎ নিয়ে। ছেলেটা ও মেয়েটার স্বাস্থ্য কিভাবে ওর মতোই টগবগে রাখা যায় বা ওরা বড় হলে কে কি পড়বে, কে কি হবে এইসবই তো! ওদের নিয়ে এর চেয়ে বেশি চিন্তা করার মতো সময়ও তো এখনো আসেনি! ওরা তো এখনও ছোট। টিপুও তো ছোট! ওদেরকে নিয়ে আরো কত কি চিন্তা করার আছে টিপুর! আছে না! আরে সেই সময়টা আসতে হবে তো? যেমন –ছেলেটা কেমন মেয়ে বিয়ে করবে বা মেয়েটাকে কেমন ছেলের কাছে বিয়ে দিবে এইসব চিন্তা করার সময়ই তো আসে নাই এখনো! কারণ, টিপুই তো এখনো ছোট!
অসুখ-বিসুখহীন শরীর ও মন নিয়ে যেমন সুন্দরভাবে কাটছিল ওর দিন, তার ওপর ভিত্তি করে আমরা তো আশা করতেই পারি যে টিপু শতায়ু হবে, বা শতায়ু না হোক এই সময়ের গড় আয়ু যদি হয় ৭৬ তাহলে ওর বয়স অন্ততঃ সাত এর ঘরে তো যাবে? কিন্তু না কোনোটাই না! আমাদের ভাবনাতীত এক ঘটনা ঘটে গেল গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে। ব্রেইন স্ট্রোক এর ছুতা দিয়ে দুইটা শিশু বাচ্চার বাবাকে নিয়ে নেওয়া হল! এটা কেমন নিয়ম! বিধির এ কি খেলা! এ বিধি কেমন বিধি, যে বিধি বুঝে চলে না! এ খেলা কেমন খেলা, সময় বুঝে খেলে না!
টিপুর সাথে আমার পরিচয় সেই হাইস্কুলে। ওর বাবার চাকরির সূত্র ধরে চাঁদপুর আল-আমিন একাডেমিতে ও দুই বছর পড়েছিল। সেই কারণেই আল-আমিন একাডেমির হোয়াটসএপ গ্রুপে ওকে নিয়ে আলোচনা হয়, বন্ধুরা ওর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে অবাক হয়! দুঃখিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমি আবার টিপুকে পেলাম। আল-আমিন একাডেমির আরেক দোস্ত ইয়াদুল, যে এখন বাংলাদেশ পুলিশের বড় কর্মকর্তা, সে আর টিপু ভর্তি হলো একই ডিপার্টমেন্টে। ও আচ্ছা, আপনাদের বলতে ভুলে গেছি- গতকাল সন্ধ্যায় আমি যখন রান্না করছিলাম, আমার চোখ দিয়ে যখন পানি বের হচ্ছিল তখন কিন্তু ইয়াদুল ফোন করেছিল; তখন সন্ধ্যা সাতটা (টিপু মারা গেল নয়টায়)। ইয়াদুলের সাথে কিছুক্ষন খাজুরে আলাপ করার পর চোখের পানি সরে গিয়েছিল। কিন্তু রান্নার শেষে দশটার পরে ফোন হাতে নিয়ে জানতে পেলাম যে টিপু নেই। আমি সাথে সাথেই টেক্সট করে ইয়াদুলেকেও জানিয়ে দিলাম। এই যে আমরা, এই আমদের নেটওয়ার্ক। এভাবেই বিধি আমাদেরকে নেটওয়ার্কের জালে আটকায়, পেঁয়াজ কাটার ছলে চোখ দিয়ে ভরপুর পানি বের করায়; আবার এই বিধিই আমাদের সাথে কঠিন খেল খেলায়। আমরা ছিটকে যাই জাল থেকে। এ বিধি কেমন বিধি, বিধি বুঝে চলে না! এ খেলা কেমন খেলা, সময় বুঝে খেলে না! আমাদের দীর্ঘশ্বাস ছাড়া ব্যাতিত কিছুই করার থাকেনা।
তবে সমস্যা নেই! আমাদেরও একটা কিছু করতে হবে; আর টিপুও আমাদের মাঝেই থাকবে। কিভাবে থাকবে? শুনবেন? শুনুন তাহলে, আমাদের অনেক বন্ধু আছে যারা এখন বিদেশে থাকে। ওদের সাথে তো আমাদের দেখা নেই বছরের পর বছর ধরে। কিন্তু আমরা বিভিন্ন সময়ে ওদের নিয়ে কথা তুলি, ওদের নিয়ে আলাপ করি। কারণ আমরা জানি যে ওরা ভালোভাবেই বেঁচে আছে। এখন, আমরাও ধরে নেবো যে টিপু একটা অচিন দেশে গ্যাছে; আর ওখানে টিপু এখানকার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ভালোভাবেই আছে। আমরা তুলবো তো ওর এইসব কথা! অচিনদেশে ওর এতটা ভালো থাকার কথা! আমাদের সাথে ওর কাটানো পুরানো সব কথা, সব তুলবো তো! তাহলে! তাহলে, ফলাফল কি দাড়ালো? ফলাফল হলো টিপু মারা যায় নাই! আমাদের টিপু আমাদেরই আছে। বন্ধু টিপু, তোর জন্য শুভকামনা চলমান।
লেখক: প্রধান নির্বাহী- ফুল-পাখি-চাঁদ-নদী রিসার্চ এন্ড এডভোকেসি ফোরাম
সারাবাংলা/এসবিডিই