Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যৌবন তুমি আগুন হও, লাল পলাশের ফাগুন হও

অয়ন সেনগুপ্ত
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৪:৩৬

সাধারণত মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীরা যে মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে তাই তাদের ভাষা। ধারণা করা হয়, পৃথিবীতে মানুষের ভাষার জন্ম হয়েছিলো প্রায় ৫ লক্ষ বছর আগে। ভাষার উৎপত্তি নিয়ে অবশ্য ভাষাবিজ্ঞানীরা বহু মতামত দিয়েছেন। কারো মতে মানুষ কথা বলা শিখেছে পশুপাখির ডাক থেকে। কেউ বলেছেন আবেগ অনুভূতি থেকে ভাষার জন্ম। আবার কেউ বলে থাকেন, মানুষ ভাষা রপ্ত করেছে অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে এবং সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। বর্তমানে পৃথিবীতে মোট ভাষার সংখ্যা প্রায় ৪ হাজারের মতো, যার মধ্যে বাংলা ভাষা পঞ্চম স্থান অধিকার করে রেখেছে। গোটা পৃথিবীতে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি।

বিজ্ঞাপন

আজকে যে বাংলা ভাষা নিয়ে আমরা গর্ব করি, সেই ভাষার পেছনে রয়েছে বহু বছরের একটি রক্তাক্ত ইতিহাস। সাল ১৯৪৭। ব্রিটিশ সরকার দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষকে ভেংগে ভারত ও পাকিস্তান নামের দুটি আলাদা রাষ্ট্র করে দেয়। দেশভাগের পর পরই করাচির একটি শিক্ষাসম্মেলনে পাকিস্তানের তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উর্দুকে বাধ্যতামূলক করবার প্রস্তাব ঘোষণা করলে শিক্ষার্থীরা তৎক্ষনাৎ এর প্রতিবাদ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনির চৌধুরী ও আবুল কাশেমের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘তমদ্দুন মজলিশ’ নামের একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। এই সংগঠনের নেতৃত্বে ১৯৪৭ সালের ৬ ডিসেম্বর শুরু হয় ভাষা আন্দোলনের প্রথম লড়াই মিছিল। এই মিছিলে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এই দাবিতে সমবেত হয়েছিল অগনিত শিক্ষক শিক্ষার্থী। পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়ার এই দাবি অযৌক্তিক ছিল না কারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার দিকে বিবেচনা করলে পাকিস্তানের মোট ৬ কোটি জনগনের মধ্যে প্রায় ৪ কোটি মানুষই ছিলেন বাঙালি। পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী এই দাবি মানতে চায়নি যেখানে কিছু সরকারদলীয় বাঙালি সদস্যও ছিল।

বিজ্ঞাপন

১৯৪৮ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি মনিষী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু এবং ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাকেও সমান মর্যাদা দেওয়ার দাবি রাখলে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের বাঙালি সংসদ সদস্যরাই এর বিরোধিতা করেন। প্রতিবাদে ছাত্ররা একদিকে রাজপথে নিজেদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে দফায় দফায় মিছিল, হরতাল ও অন্যান্য কর্মসূচী পালন করতে শুরু করে। অন্যদিকে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে গোটা বাংলার ছাত্র-শিক্ষক সমাজের এই আন্দোলনকে রুখতে একের পর এক ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনা সাজাতে থাকে। চলমান এই আন্দোলনের মধ্যে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন ১৯৫২ সালের ২৭শে জানুয়ারি পল্টনের জনসভায় উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্টভাষা হিসেবে ঘোষণা করলে বাংলার ছাত্রসমাজ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। প্রগতিশীল ছাত্রনেতাদের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলো তত দিনে এই লড়াইয়ে নিজেদের ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। মওলানা ভাসানী ও প্রগতিশীল ছাত্রনেতাদের নেতৃত্বে কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, রাজনৈতিক দলসহ বাংলা ভাষার সমর্থনকারী সকল স্তরের মানুষদের নিয়ে গঠন করা হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। পরিষদের দাবিগুলো ছিল-

১. ২১শে ফেব্রুয়ারি সারা দেশে হরতাল পালন করা হবে।
২. পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
৩. শেখ মুজিবকে জেল থেকে মুক্তি দিতে হবে।

দেশব্যাপী সংগ্রাম পরিষদের বিভিন্ন ইউনিটগুলো মিছিল, শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক আন্দোলন সহ বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে প্রতিবাদের পাশাপাশি পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী ২১শে ফেব্রুয়ারি হরতাল পালনের জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নিতে থাকে। সরকার গণজোয়ার ও হরতাল রুখতে ১৪৪ ধারা জারি করলে শুরু হয় এক নতুন বিতর্কের।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আওয়ামী লীগের সদস্যরা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে ছিল। তাদের যুক্তি ছিল- ‘আমরা যদি ১৪৪-ধারা ভঙ্গ করি তাহলে দেশে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে সরকার জরুরি অবস্থার ভিত্তিতে সাধারণ নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারে। আমরা সরকারকে সে সুযোগ দিতে চাই না’ (সূত্র: বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস)। দীর্ঘ বাকবিতন্ডা এবং সংগ্রাম পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠের মত না থাকার পরেও ছাত্রনেতারা এই সিদ্ধান্তে স্থির থাকে যে ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করা হবে। সরকারকে এই কর্মসূচীর মাধ্যমে সমুচিত জবাব দেওয়ার এটাই একমাত্র উপায়।

পরদিন ঢাকাসহ সারাদেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও দলে দলে মিছিলের সাথে শহরের বিভিন্ন রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। মিছিল ঠেকাতে পুলিশ হাজার হাজার ছাত্রকে আটক ও গুলি করে। গুম করে ফেলা হয় অসংখ্য লাশ। দেশব্যাপী সেদিনের হামলায় নিহতের সঠিক সংখ্যাও ছিলো অপ্রকাশিত। ভাষা শহীদদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হবার পর আন্দোলন আরো ভয়ানক রূপ ধারণ করে। ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে শিক্ষক, চাকুরিজীবি, দিনমজুর থেকে শুরু করে সকল শ্রেণীপেশার মানুষ সেদিন প্রাণের মায়া ত্যাগ করে রাজপথে নেমে আসে। আন্দোলনের চাপে পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত প্রথম সংবিধানে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।

সে দিনের ১৪৪-ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত ছিল সঠিক এবং সময়োপযোগী একটি পদক্ষেপ। কারণ ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের এই আন্দোলন এবং ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ দেশের সকল স্তরের সাধারণ মানুষদের এককাতারে রাজপথে নামিয়ে এনেছিল, পরিপূর্ণভাবে ছাত্রদের এই আন্দোলন রূপ নিয়েছিল গণ-আন্দোলনে। এছাড়াও শুধুমাত্র ভাষার জন্য পৃথিবীর বুকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের নজির আর একটিও না থাকায় দিনটি আলোচিত হয়েছিল বিশ্ব দরবারে। ৮ই ফাল্গুনের ভাষা সৈনিকদের যে আত্মাহুতি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের মাতৃভাষা হিসেবে এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে, সেই আত্মত্যাগের মর্যাদায় ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কোর অধিবেশনে মোট ১৮৮টি দেশ ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ কে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। পরবর্তীতে ২০১০ সালে জাতিসংঘ এই দিনটিকে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পূর্ণ মর্যাদার সাথে পালনের ঘোষণা দেয়।

আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত ভাষার মর্যাদা বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা আদৌ কতটুকু দিতে পেরেছি? একটা সময় পাকিস্তান সরকার সাংবিধানিকভাবে বাংলাকে স্বীকৃতি দিলেও এই দেশ থেকে চিরতরে বিতাড়িত হবার আগ পর্যন্ত তারা বাঙালি জাতির শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে প্রায় সকল কিছুতে বাংলার মধ্যে কখনো রোমান হরফ কিংবা আরবি শব্দের প্রচলন ঘটিয়ে, ষড়যন্ত্রমূলক বাংলা ভাষার শব্দ বদলে দিয়ে বাংলা ভাষাকে ধীরে ধীরে জনজীবন থেকে চিরকালের জন্য মুছে ফেলার অপচেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু তারা সফল হয়নি, কারণ সেসময় পূর্ব বাংলার জনগণ এই বিষয়ে যথেষ্ঠ সোচ্চার ও সচেতন ছিল এবং ছাত্রদের সাথে কোনরকম ছলনার আশ্রয় নেওয়া মোটেও সুবিধাজনক হয়ে ওঠেনি।

বর্তমান সময়ের পরিস্থিতি অতীতের তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখন আমরা বাঙালি হয়েও পশ্চিমাদের জীবনধারায় শুধু অনুসরণ করছি না সাথে অনুকরণ করছি তাদের ভাষাও। আমাদের প্রতিদিনের কথাবার্তায় প্রায় প্রতিটি বাক্যেই এক বা একাধিক ইংরেজি শব্দ আমরা মিশিয়ে ফেলি। কিছু শব্দ আমরা এতোটাই ব্যবহার করি যে ‘sorry’ এর অর্থ যে দুঃখিত এবং ‘please’ শব্দের অর্থ যে অনুগ্রহ সেটা আমরা অনেকেই জানিনা। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত কিছু ইংরেজি শব্দের সঠিক বাংলা অর্থ মনে করতে বেশ বেগ পেতে হয় অনেকেরই। শুধুমাত্র আন্দাজের উপর টুকটাক ইংরেজি শব্দের ব্যবহার ও বাংলা ভাষাচর্চার এই সংকটজনিত সমস্যা কমবেশি আমাদের অনেকের মধ্যেই আছে। আমরা বাঙালি হয়েও পশ্চিমাদের ভাবধারার প্রতি এতো বেশি সংবেদনশীল যে কথার ফাঁকে দুয়েক লাইন ইংরেজি না বললে নিজেদের উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মনে হয় না। এটা একদিকে যেমন মাতৃভাষার প্রতি অসদাচরণ তেমনি এক প্রকার মানসিক বিকৃতি এবং নৈতিক অবক্ষয়ের ও কারণ। তিক্ত হলেও সত্য যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজের পারিপ্বার্শিকতা এই অসংগতির পিছনে বড় ভূমিকা পালন করছে।

তাহলে মাতৃভাষার সুষ্ঠু চর্চা ও মর্যাদা রক্ষায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তব্য কী? কোমলমতি শিশুদের মাতৃভাষার গুরুত্ব বোঝাতে সর্বপ্রথম আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার কিছুটা সংস্কার প্রয়োজন। আমাদের দেশের বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীরা শিশু শ্রেণী থেকেই ‘assembly’, ‘good morning’, ‘good afternoon’ এই শব্দগুলোর সাথে পরিচিত। একটা ব্যক্তিগত জরিপে দেখা গেছে অনেক শিক্ষার্থী assembly এর অর্থ জানে না। ইংরেজি এই শব্দগুলোর বাংলা অর্থের চর্চার আনুষ্ঠানিকতা বিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তেমন নেই বললেই চলে। আমরা কি পারি না আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে শ্রেণীকক্ষে শুধু ইংরেজি শিক্ষকের বিষয় ছাড়া বাংলা, সমাজ সহ অন্যান্য বিষয়গুলোতে ‘good morning’ এবং ‘good afternoon’ এর জায়গায় ‘সুপ্রভাত/শুভ সকাল’ এবং ‘শুভ দুপুর’ বলার অভ্যেস করাতে?

আমাদের দেশে ইংলিশ মিডিয়াম নামের একটি শিক্ষাব্যবস্থা আছে যার অধীনে পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বাঙালি ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করলেও বাংলার কোন অস্তিত্ব সেখানে নেই। এর মধ্যে যারা ব্রিটিশ শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পরিচালিত তাদের পাঠ্যসূচী সাজানো হয় বিদেশী সংস্কৃতি, ইতিহাস, সমাজব্যবস্থা, গল্প, কবিতা দিয়ে। বিদ্যালয়গুলোতে বাংলায় কথা বলাও নিষিদ্ধ। তাদের শিক্ষাব্যবস্থায় নেই কোন বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা, নেই কোন বাঙালিয়ানা। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ছোট থেকেই মাতৃভাষার প্রতি চর্চা করার সুযোগ না থাকায় তাদের গড়ে উঠে না মাতৃভাষা ও দেশের প্রতি কোন মূল্যবোধ বরং তাদের মধ্যে জন্ম নেয় বৈষম্য ও নৈতিক অবক্ষয়ের ভয়ানক রূপ। আমি বলছি না ইংরেজি ভাষার উপর শিক্ষা গ্রহণ ও চর্চা অপ্রয়োজনীয়। আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে এটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে এই চর্চার খাতায় মাতৃভাষা বাংলাকে সতর্কতার সাথে যত্ন সহকারে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়াটা জরুরি। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ১৯৫২সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ার একদম ই সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের মধ্যেই পাঠ্যবইয়ে সীমাবদ্ধ। ভাষার গুরুত্বকে উপলব্ধি করাতে শিক্ষার্থীদেরকে শিশুবয়স থেকেই সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস সম্পর্কে জানবার সুযোগ করে দেওয়া প্রয়োজন। আর এই জন্যে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় অব্দি পাঠ্যবইগুলোতে ব্যাপক সংযুক্তি ও সংস্কার অবশ্যম্ভাবী। এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা বাঙালি হয়েও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, স্বাধীনতা দিবস, মহান বিজয় দিবসের সঠিক দিন তারিখ এবং ইতিহাস সম্পর্কেও ভালোমতন জানেনা। এই ব্যর্থতা আমাদের সকলের।

শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এই ঘাটতি পূরণের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। পরিবারকেও এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে। পরিস্থিতির শিকার হয়ে ও জীবনযাপনে মিশ্র পারিপার্শ্বিকতার চাপে কিংবা উচ্চবিত্ত হওয়ার দম্ভে আমাদের দেশের অধিকাংশ পরিবার ভাবে সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য ইংরেজি শেখার, ইংরেজিতে কথা বলবার কোন বিকল্প নেই। এই কারণে হোক অথবা গতানুগতিক ধারায় হোক, একটা শিশু যখন কথা বলতে শেখে তখন থেকেই পরিবারের দিক থেকে তাদের শিশুদের সাথে কথা বলার সময় মিশ্রভাবে অথবা সরাসরি ইংরেজি এর উপস্থিতি ঘটানো হয়। যেখানে শিশুদের প্রথম পাঠশালা হচ্ছে পরিবার, সেখানে পরিবারকে এই বিষয় সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

শুধু পরিবার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়। এই দায়িত্ব রাষ্ট্রেরও। আমরা উন্নত রাষ্ট্রগুলোর দিকে লক্ষ্য করে দেখবো প্রায় বেশিরভাগই তাদের প্রযুক্তি, গবেষণাসহ সকল রাষ্ট্রীয় ও দাপ্তরিক কাজ পরিচালনা করে থাকে তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায়। অথচ বহির্বিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্থাপন ও যোগাযোগ রক্ষার্থে ইংরেজি ভাষার প্রতি যতটুক দক্ষতা অর্জন করা প্রয়োজন তার পুরোটাই তারা আয়ত্তে রাখে। এদিক থেকে আমাদের দেশ কিছুটা ভিন্ন। আমাদের দেশে মোটামুটি প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে সাংগঠনিক ও দাপ্তরিক কাজগুলো পরিচালিত হয় ইংরেজিতে। নিজেদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে এই অবস্থা থেকে উঠে আসা প্রয়োজন। রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক সহ সকল সম্মেলনে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচিতি ঘটাতে হবে একমাত্র বাংলা ভাষার মাধ্যমেই। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের ২৯ তম অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে প্রথম বাংলায় ভাষণ দিয়ে বাংলাকে পৌঁছে দেন বিশ্বদরবারে। তার সেই ভাষণ জাতিকে শিখিয়েছিল কিভাবে বাংলাকে আত্মচেতনায় টিকিয়ে রাখতে হয় ও বিশ্বদরবারে দাপটের সাথে পৌঁছে দিতে হয়।

মাতৃভাষাকে উপলব্ধি করতে মাতৃভাষার সংজ্ঞা বোঝাটা জরুরি। ৫২’র ভাষা আন্দোলনে আমাদের লড়াই বিশেষ কোন ভাষার বিরুদ্ধে ছিল না। সকল উর্দুভাষীও আমাদের শত্রু ছিল না। উল্লেখ্য, মাতৃভাষার জন্য এই লড়াইয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্র সমাজের ব্যাপক অংশের ও সমর্থন ছিল। আমাদের শত্রু ছিল উর্দুভাষী সেসকল শাসকগোষ্ঠী যারা আমাদের ন্যায্য অধিকার আমাদের মাতৃভাষাকে কেড়ে নিতে চেয়েছিল। পৃথিবীর সকল মানুষের কাছেই তার মাতৃভাষা দামি। সকল অঞ্চলের মানুষের কাছে তার আঞ্চলিক ভাষাটাই স্বতঃস্ফূর্ত। অন্যের ভাষা নিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক মারমুখী আচরণ কোনভাবেই আমাদের নৈতিকতা এবং শিক্ষার মধ্যে পড়ে না। যে মানুষ অন্যের ভাষাকে শ্রদ্ধা করতে জানেনা বাস্তবে সে নিজের ভাষাকেও ভালোবাসতে জানেনা, নিজের ভাষার প্রতি তার সত্যিকারের কোন আবেগ থাকে না। আমাদের দেশে জেলাভিত্তিক মানুষের আঞ্চলিক ভাষাও ভিন্ন। এছাড়াও আদিবাসীদের ও রয়েছে নিজস্ব মাতৃভাষা। ভাষার এই ভিন্নতার কারণে প্রায়ই এক জেলার মানুষকে অন্য জেলার মানুষের কাছে কোন না কোনভাবে হেনস্তার শিকার হতে হয়। এটা খুবই কষ্টদায়ক এবং হীনমন্যতার পরিচয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আমাদের শেখায় নিজের ভাষাকে ভালোবাসতে, অন্যের ভাষাকে শ্রদ্ধা করতে।

বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা। এই ভাষায় কথা বলার জন্য, শিক্ষাগ্রহণসহ দৈনন্দিন জীবনের সকল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ন্যায্য অধিকার আদায়ের এই লড়াই মোটেও সহজ ছিল না। এই ভাষা আমাদের মেধাবী ভাইবোনের উচ্চশিক্ষার সুযোগ ও প্রাণের মায়া ত্যাগ করে অর্জিত। এই ভাষার সাথে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার রত্নগর্ভা মায়ের চোখের জল। আমরা কি এতো ত্যাগের মূল্য দিতে পেরেছি? আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস থেকে শুরু করে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি মূল্যবোধ কতটুক আছে আমাদের বর্তমান প্রজন্মের কাছে? বিশের দশকে এসে বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশের কাছেই ২১শে ফেব্রুয়ারি মানে শুধুই সরকারি ছুটির দিন তাই কিছুটা অতিরিক্ত সময় ঘুমিয়ে নেওয়া, আবার কারো ক্ষেত্রে বন্ধুদের সাথে রেস্টুরেন্টে কিংবা ভ্রমণস্থানে গিয়ে আনন্দঘন মুহূর্ত কাটানো। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেরই কাছে দেশ নিয়ে ভাবা, একুশের চেতনাকে ধারণ করা শুধুমাত্র সময়ের অপচয় মাত্র। তাদের ভাষায় ‘ক্যারিয়ার ডেভেলাপমেন্ট, অনেক অর্থ উপার্জন’ হলো একমাত্র ভাবনা। আবার অনেকের কাছেই একুশ মানে হলো ভোরের সকালে ফুল হাতে প্রভাতফেরিতে সমবেত কন্ঠে- “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি”। কারো কাছে প্রতিটি একুশ মানে নতুন স্বপ্ন, নতুন করে পথচলা আর নতুন উদ্যমে ঘুরে দাঁড়ানো। একুশ মানে যৌবনের প্রথম প্রেম। একুশ থাকুক আমাদের চেতনায়। একুশের চেতনা কখনোই পরাজয় মানে না। আজকের এই দিনে সকল ভাষা সৈনিক ও ভাষা শহীদদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
‘একুশ শুধুমাত্র প্রভাতফেরিতে নয়, একুশ গর্জে উঠুক নবকুঁড়িতে।’

লেখক: স্কুল ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, চট্টগ্রাম

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

অয়ন সেনগুপ্ত মুক্তমত যৌবন তুমি আগুন হও লাল পলাশের ফাগুন হও

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর