Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু

অরূপ চন্দ্র সরকার
২১ মার্চ ২০২২ ১৬:১৭

আমার ছোটবেলা কেটেছে হাওরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। বিদ্যুৎ নেই, টেলিভিশন নেই। আধুনিক জীবন থেকে অনেক দূরে। বাড়িতে বিনোদন আর দেশবিদেশের সংবাদ রাখার মাধ্যম বলতে ছিলো একটা রেডিও আর টেপ রেকর্ডার।

আমার দাদু খুব পড়াশোনা জানা মানুষ ছিলেন না কিন্তু তাঁর ছিলো কুসংস্কারমুক্ত মন, অসাধারণ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর দূরদর্শিতা। আমি আসলে দাদু-নাতির গল্প শোনাবো না- বলবো বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার পরিচয় হওয়ার অসাধারণ কিছু স্মৃতি।

বয়স তখন ৭-৮ বছর। তখনই দাদুর কোলে বসে রেডিওতে প্রতিদিন রাতে বিবিসি শোনা, বঙ্গবন্ধুর গল্প শোনা, মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনা, সাতই মার্চের ভাষণ শোনা! যেহেতু ঠাম্মার সাথেই বেশি সময় কাটতো তাই ঠাম্মার মুখ থেকেও বঙ্গবন্ধুর অনেক অনেক গল্প শোনা হতো, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের বালাটে কাটানো শরণার্থী ক্যাম্পের দিনগুলোর কথা শোনা হতো। তখন থেকেই বঙ্গবন্ধু আমার কাছে এক নিখাদ ভালবাসার ব্যক্তিত্ব যেনো বঙ্গবন্ধু আমার কাছে কতশত বছরের আপন! বঙ্গবন্ধু নামটাই আমার কাছে ভালবাসার আরেকটা সমার্থক শব্দ হয়ে গেছে। তাই সেই শিশুকাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর সাথে আমার পরিচয়।

বাড়িতে টেপ রেকর্ডার ছিলো। পুরোনো দিনের শিল্পী- হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখার্জি, অনুপ ঘোষাল, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, কিশোর কুমার, শচীন দেব বর্মনদের মতো শিল্পীদের ক্যাসেট ছিলো ঘরভর্তি। আর ছিলো বাবার আনা ৭ই মার্চের ভাষণের ক্যাসেট। এটাই ছিলো আমার কাছে বিশেষ। বড়রা যখন গান বাজাতো না, তখন আমি এই ভাষণ শুনতাম। যদিও তখন আমি সেই ভাষণের তাৎপর্য জানতাম না, বিশ্লেষণ করতে পারতাম না। শুধু জানতাম এই ভাষণ বঙ্গবন্ধুর, এই ভাষণ আমাদের মুক্তি দিয়েছে। শুনতাম, বারবার শুনতাম। এ যেনো জাদু। আজ যখন সেই ভাষণের তাৎপর্য জানলাম, বিশ্লেষণ করতে পারলাম তখন সেই ভাষণের প্রতি মুগ্ধতা আরও বেড়ে গিয়েছে।
আমাদের ছোটবেলায় কয়েকটা বছর খারাপ সময় গিয়েছে যখন রেডিও-টেলিভিশন কোথাও বঙ্গবন্ধুর নাম শুনতে পেতাম না। কিন্তু দাদু-ঠাম্মার হৃদয়ে গেঁথে দেয়া বঙ্গবন্ধুকে কখনোই ভুলিনি।

এখন আমাদের বড় সুসময়। বঙ্গবন্ধু মহানায়ক হয়ে আবার আমাদের মধ্যে ফিরে এসেছেন। এখন আমরা বুকভরে বঙ্গবন্ধুকে টিভিতে দেখতে পাই, ভাষণ শুনতে পাই। কোনও খারাপ শাসকদের নিষেধাজ্ঞা নেই। কোনও বিশেষ দিনে যখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনি সাথে সাথে দাঁড়িয়ে যাই- মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত শুনি, সেই সুযোগ না থাকলে যতক্ষণ শোনা যায় ততক্ষণ কান পেতে থাকি। কি মহনীয় কণ্ঠ! কি জাদু! আর এখনতো সাতই মার্চের ভাষণ ছাড়াও আরও কতো অসাধারণ ভাষণ পেয়েছি! স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর সেই কান্না ভেজা চোখ, গলা ধরে আসা আবেগভরা কণ্ঠ…….!

আমরা কতো সৌভাগ্যবান! আজ আমাদের হাতে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী আছে। প্রথম যেদিন বইটা হাতে পাই সেদিন যেনো আমি এক অন্য মানুষ! এক বাধ্য শিশু আমি! পড়ছি আর চোখের সামনে ভাসছে বাঙালির জন্য তাঁর সংগ্রামী জীবন। চোখে ভাসছে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় তাঁকে এক বৃদ্ধ গরীব মহিলার তীব্র ভালবাসায় ঘরে নিয়ে বসতে দেয়া, খেতে দেয়া, কয়েকটা পয়সা সাহায্য দেয়া। পড়ছি আর একটু পরপর চোখ বন্ধ করছি। কতো সহজেই সবকিছু চোখের সামনে ভাসছে! কিন্তু যতো সহজে চোখের সামনে ভাসছে তাঁর জীবনতো ছিলো তাঁরচেয়েও বহুশতগুণ কঠিন। সারাটা জীবন বাঙালির জন্য উৎসর্গ করলেন! বঙ্গবন্ধু যেনো বাঙালিকে মুক্তি দিতেই এই পৃথিবীতে এসেছিলেন।

ঢাকায় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কিছুদিন পরই যাই ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে-বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে। নিচতলায় খুবই সাধারণ রান্নাঘর দেখে দুইতলায় উঠলাম। বঙ্গবন্ধুকে যেখানে হত্যা করা হয়েছে সেই সিঁড়ির সামনে দাঁড়ালাম! দাঁড়িয়েই রইলাম! এখানে-সেখানে গুলির চিহ্ন! রক্তের দাগ গ্লাস দিয়ে ঢেকে দেয়া। আমাকে যেনো দুনিয়ার আবেগ পেয়ে বসলো! বুকটা অসম্ভব ভারী হয়ে গেলো। আর সামলাতে পারলাম না! হয়তো কোনও বাঙালিই পারবেনা। চোখ বেয়ে টলটল করে জল পড়তে লাগলো!

মাঝেমধ্যেই আমি আর মা আলাপ করি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা না হলে আজ দেখতে কেমন হতো! কিন্তু বঙ্গবন্ধুর তর্জনী উঁচিয়ে ভাষণ দেয়ার চেহারা কখনোই সরাতে পারিনা। ভাবি, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই এতদিনে সোনার বাংলা পেয়ে যেতাম! যতদিন বাংলা থাকবে, বাঙালি থাকবে, ততদিন বঙ্গবন্ধু থাকবে। অত্যাচার-শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধু অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে!

লেখক: উপ-পরিদর্শক, বাংলাদেশ পুলিশ

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

অরূপ চন্দ্র সরকার মুক্তমত হৃদয়ে বঙ্গবন্ধু


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর