Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বায়ুদূষণ রোধ করতে হবে

উম্মে কুলসুম কাইফা
২৯ মার্চ ২০২২ ১৬:৪৫

আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়েই পরিবেশ এবং পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো বায়ু। বেঁচে থাকার জন্যে আমরা বায়ুর ওপর নির্ভরশীল। বিশুদ্ধ বায়ু ছাড়া পৃথিবীতে কোন জীবের অস্তিত্ব টিকে থাকা সম্ভব না। কিন্তু কিছু ক্ষতিকর পদার্থ বাতাসে মেশার ফলে বায়ু দূষিত হচ্ছে। যার ফলে আমরা প্রতিনিয়ত ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। দুঃখজনক হলেও সত্যি আমরা নিজেরাই কখনো নিজের স্বার্থের জন্য বা উন্নয়নের জন্য পরিবেশের এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান দূষিত করছি।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘আইকিউএয়ার’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বিশ্বের ১১৭টি দেশ-অঞ্চলের ৬ হাজার ৪৭৫টি শহরের বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। মূলত বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর সূক্ষ্ম বস্তুকণা পিএম-২.৫-এর পরিমাণ দেখে তালিকাটি করা হয়েছে। ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে বাতাসের প্রতি ঘনমিটারে পিএম ২.৫-এর মাত্রা ৭৬.৯। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী, প্রতি ঘনমিটারে যা থাকার কথা ১০-এর কম।

বিজ্ঞাপন

বর্তমানে এই দূষণের পরিমান এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যা বলার মতো না । ‘আইকিউএয়ার’ প্রতিবেদনে আবারো বাংলাদেশর অবস্থান শীর্ষে। আইকিউআরের প্রতিবেদনে আমরা উদ্বিগ্ন হলেও আমরা বিস্মিত না কেননা ২০১৮ সাল থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশের নাম। শুধু দেশ হিসেবে নয়; নগরী হিসেবে আমাদের রাজধানী ঢাকাও বিশ্বের দূষিত স্থান হিসেবে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। ঢাকার বায়ুমান কেমন সেইটা নাক, মুখ ও চোখ দিয়েই বুঝা যায় এ জন্যে গবেষণাগারে পরীক্ষা করার প্রয়োজন হয় না।

বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে যদি ‘হটস্পট’ এর কথা চিন্তা করি তবে প্রথমে চলে আসে রাজধানী ঢাকার কথা। জীবন ও জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসে ঢাকায়। সরকারি অফিস, আদালত, ব্যাংক, পোশাক কারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠানসহ সব কিছুই ঢাকামুখী হওয়ার জন্যে ঢাকাকে সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যার ফলে ঢাকার বায়ু ক্রমান্বয়ে দূষিত হচ্ছে।

বায়ুদূষণের একটা বড় কারণ হলো রাজধানীর বর্জ্য। রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে উন্মুক্ত বর্জ্য পড়ে থাকতে দেখা যায়। এবং প্রকৃতিতে খোলা অবস্থায় প্লাস্টিক সহ ময়লা পোড়ানো হয় যার ফলে বায়ু দূষিত হয়। বায়ু গবেষকেরা বলছেন, সড়কে পড়ে থাকা ময়লার বড় অংশ থাকে প্লাস্টিক, যা পোড়ানোর কারণে ডাইঅক্সিন, ফুরান, মার্কারি, পলিক্লোরিনেটেড বাই ফিনাইলের মতো বিষাক্ত উপাদান বাতাসে যুক্ত হচ্ছে। এ ছাড়া কার্বন ডাই–অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই–অক্সাইডসহ অন্তত ছয়টি বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয় যার ফলে বায়ু দূষিত হচ্ছে।

বায়ুদূষণের একটি প্রধান কারণ হলো নির্বিচারে বনজঙ্গল কেটে ফেলা। আমরা আমাদের প্রয়োজনে গাছ কাটছি কিন্তু পরে আর কোন গাছ রোপন করি না। এর ফলে বায়ুতে কার্বনডাই অক্সাইডের পরিমান বেশি হয়ে এবং বায়ুদূষণ হচ্ছে। ঢাকা নগরীতে মেট্রোরেল সহ বিভিন্ন মেগা ও মাঝারি উন্নয়ন কর্মকান্ড চলছে। ব্যাপক নির্মাণ কাজের জন্য বায়ুদূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। শিল্পকারখানার ধোঁয়া, যানবাহনের কালো ধোঁয়ার ফলে বায়ুদূষণ হচ্ছে ।

বাংলাদেশেজুড়ে আমরা বায়ুদূষণের একই চিত্র দেখতে পায়। গ্রামে যে দূষণ হচ্ছে নাহ এমনটা নয়। কেননা যদি শহরের বায়ুদূষণই যদি হতো তবে পরপর বাংলাদেশের নাম শীর্ষে আসতো না। এছাড়া একটি প্রতিবেদন বলছে দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৫৪ টি বায়ুর মান মাত্রার চেয়ে অনেক খারাপ। আদর্শ মাত্রার মধ্যে আছে ১০ টি জেলার বায়ুর মান।

বায়ুদূষণের একটি প্রধান কারণ হলো ইটখোলা নির্মাণ। কোনরকম নিয়ম না মেনেই তৈরি করা হচ্ছে ইটখোলা। অবাধে ব্যবহার করা হয় ড্রাম চিমনি। মানুষের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যানবাহন। এছাড়া রাস্তায় ফিটনেস বিহীন গাড়ি দেখা যায় যার ফলে বায়ু আরো বেশি দূষিত হচ্ছে।

বায়ুদূষণ এখন বিশ্বের বৃহত্তম পরিবেশগত স্বাস্থ্য হুমকি হিসেবে বিবেচিত। বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। বায়ু দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব অনেক। দূষিত বায়ুতে আমাদের নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হয়। বায়ু দূষণের ফলে সবচেয়ে খারাপ প্রভাব পড়ছে মানুষের প্রজনন ক্ষমতা ও সার্বিক স্বাস্থ্যের ওপর। দূষিত বায়ু আমাদের শরীরে নানা রকম রোগ সৃষ্টি করে থাকে। বায়ু দূষণের কারণে হাঁপানি, ক্যান্সার, হৃদরোগ, ফুসফুসের সমস্যাসহ বহুরোগ হয়। বায়ুদূষণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশুরা। এক পরিসংখ্যান বলছে গত বছর পাঁচ বছরের কম বয়সী প্রায় ৪০ হাজার শিশুর মৃত্যুর জন্য সরাসরি দায়ী বায়ুদূষণ।

বায়ুদূষণ এর ফলে যে শুধুমাত্র আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি তা নই। এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বায়ু দূষণের ফলে ওজনস্তর পাতলা হচ্ছে যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলে ভয়াবহ দাবানল, অসময়ে বন্যা, জলোচ্ছাস সহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে।

বায়ুদূষণের ফলে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি নেতিবাচক সংবাদ পৌঁছাচ্ছে। আমাদের দেশে বিনিয়োগ কম হবে এবং অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবো। বায়ুদূষণের দৈনিক অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা মোট বিশ্ব উৎপাদনের ৩ থেকে ৪ শতাংশ।

বায়ুদূষণ হলো স্লো পয়জন কিন্তু বায়ুদূষণের ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আমরা সচেতন না। বায়ুদূষণের ফলে যে রোগ হচ্ছে সেগুলো আমরা দ্রুত অনুধাবন করতে পারি না জন্যেই আমরা বায়ুদূষণকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। শুধুমাত্র বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। গতবছর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু কমেছে পাঁচ বছর চার মাস।

আইকিউএয়ার এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে চীনের বায়ুদূষণ পরিস্থিতি সম্প্রীতিক বছর গুলোতে প্রকট থাকলেও তারা এর মধ্যে উন্নতি করেছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতও পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা এখনো নীরব কেন?

বায়ুদূষণ রোধের মূল দায়িত্ব পরিবেশ অধিদপ্তরের। তারা বায়ু, পানিসহ পরিবেশগত নানা দূষণ নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তাদের খুব কার্যকর পদক্ষেপ আমরা দেখি না যার ফলেই একটি দেশ বারবার দূষণে শীর্ষে। ২০১৯ সালে নামমাত্র ‘নির্মল বায়ু আইন’ করা হয়েছিল যার কোন কার্যক্রম আমরা দেখতে পায়নি। তাই নতুন করে আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং আইন যেন কাগজে সীমাবদ্ধ না থাকে সেইদিকে কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে ।

বর্তমানে বায়ুদূষণে বিপর্যস্ত জনজীবনের চিত্র গণমাধ্যম এবং পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হলেও এটা এই পর্যন্তই সীমাবদ্ধ। প্রশাসন এবং জনগন কেউই সচেতন নয়। বায়ুদূষণ রোধে জনসচেতনতা খুবই জরুরি। দূষণ রোধ করার জন্যে নগরায়নে সুষ্ঠপরিকল্পনা দরকার। শিল্প -কারখানা থেকে যেন বায়ুদূষণ না হয় তাই পরিবেশবান্ধব শিল্প-কারখানা নির্মাণ করতে হবে। নির্বিচারে গাছকাটা বন্ধ করে বনায়ন করতে হবে। ঢাকার রাস্তায় নিয়মিত পানি ছিটাতে হবে ।

দূষণরোধ করার জন্যে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা যেকোনো দূষণ রোধ করতে পারে কিন্ত শুধুমাত্র সচেতন হয়ে এখন দুষণ রোধ করা সম্ভব না। পরপর চারবার বায়ুদূষণে শীর্ষে রয়েছি আমরা দূষণরোধে এখনই যদি কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়া হয় তবে অনেক দেরি হয়ে যাবে। বায়ুদূষণ রোধ করার জন্যে এখনই সুষ্ঠ পরিকল্পনা করতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে । দূষণরোধ করতে স্থানীয় প্রশাসন, বেসরকারি সংস্থা , ব্যবসায়ী পক্ষকে এগিয়ে আসতে হবে তবে তবেই আমরা সুস্থভাবে বাঁচতে পারবো।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

উম্মে কুলসুম কাইফা বায়ুদূষণ রোধ করতে হবে মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর