নজরুলের চেতনায় সমাজ হোক বৈষম্যহীন
২৯ মার্চ ২০২২ ১৬:৫৫
২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত হয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ফলাফল। ২১তম হয়ে পেয়ে যাই বিদ্রোহী কবির নামে প্রতিষ্ঠিত দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ। ভাইভায় ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে সুযোগ পেলেও আর ভর্তি হওয়া হয়নি। ভর্তি হয়েছিলাম সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের লোকপ্রশাসন ও সরকার পরিচালনা বিদ্যা বিভাগে। এই অনুষদে অবশ্য ১৬তম হয়েছিলাম। যা–ই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরই ঊনবিংশ শতকের ইতিহাসের প্রান্তিক নিঃসংশয়বাদী কবি সম্পর্কে, তাঁর সৃষ্টি, তাঁর দর্শন, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে জানার আগ্রহ খুব বেশি বেড়ে গিয়েছিল। কেননা, পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ই যেন কবির ছোঁয়ায় ও স্মৃতিতে জীবন্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের পরিবহনের জন্য ধূমকেতু, প্রভাতী, প্রলয়শিখা, বাঁধনহারা নামের বাস কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে খানিক এগোলেই নজরুলের ভাস্কর্য, রয়েছে ‘চির উন্নত মম শির’ স্মৃতিস্তম্ভ কিংবা ‘গাহি সাম্যের মঞ্চ’, ‘চুরুলিয়া মঞ্চ’। আরও দেখা মিলবে কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’ ও ‘দোলনচাঁপা’র নামে শিক্ষার্থীদের হল, কাব্যগ্রন্থ ‘চক্রবাক’-এর নামে ক্যাফেটেরিয়া। ছোটগল্প ‘ব্যথার দান’–এর নামে মেডিকেল সেন্টার কিংবা কবির ডাকনাম দুখু মিয়ার নামে নামকরণকৃত উপাচার্যের বাসভবন। এমন নামকরণে এ নজরুল তীর্থে বিদ্রোহী নটরাজের আবেদন বাড়িয়েছে।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গি আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বর। এ কারণেই তিনি ভূষিত হন ‘বিদ্রোহী কবি’ হিসেবে। আজীবন সংগ্রাম করেছেন শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য। সোচ্চার ছিলেন সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও কূপমণ্ডুকতার বিরুদ্ধে। তরুণদের কাছে তিনি বিদ্রোহের অনন্ত প্রতীক। চির উন্নত শির কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর মাত্র দুই যুগের সৃষ্টিকর্মজুড়ে পরাধীন দেশের মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়ে গেছেন। তিনি ‘পুতুলের বিয়ে’ (১৯৩৩) নাটিকায় লিখেছিলেন, ‘মোরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান, মুসলিম তার নয়নমণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।’ নজরুল হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মানবধর্ম লালন করার কথা বলেছেন। তিনি কল্পনা করেছেন এক সাম্যবাদী সমাজের, যেখানে নেই শোষণ, বৈষম্য আর সাম্প্রদায়িক বিভেদ: ‘গাহি সাম্যের গান, যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান, যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রিশ্চান।’
তিনি ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে মানবতাকে সবচেয়ে বড় করে দেখার জন্য ‘সাম্যবাদী’ (১৯২৫) কবিতায় আরও বলেছেন, ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। / নাই দেশ-কাল-পাত্রের ভেদ, অভেদ ধর্ম জাতি, / সব দেশে, সব কালে, ঘরে ঘরে তিনি মানুষের জ্ঞাতি।’ নজরুল শোষিতের পক্ষ অবলম্বনে কোনো রাখঢাক রাখেননি। তিনি তাঁর সৃষ্টিশীলতার প্রায় সব প্রয়াস মনুষ্যত্ব, মানব ধর্মের বিকাশ এবং প্রগতির পথের বাধা দূর করার জন্য নিবেদন করেছিলেন। নজরুল তাঁর সাহিত্যে পারস্পরিক সাংস্কৃতিক সমন্বয় তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, এর ফলে দুই প্রধান সম্প্রদায়কে কাতারে আনা এবং সমাজে অধিকতর সহনশীলতা নিশ্চিত করা যাবে। তাই তিনি হিন্দু ও মুসলমান ধর্মীয় বিভিন্ন চরিত্র সংমিশ্রণ করে ব্যবহার করেছেন।
কাজী নজরুল ইসলাম সমাজের সকল স্তরের, সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন। দুখু মিয়া জানতেন গরীব কৃষক মুটেমজুর আর দৌলতবান মানুষের ঈদ- আনন্দ কেমন। তাইতো ‘কৃষকের ঈদ’ কবিতায় ক্ষুব্ধ নজরুল লিখেছিলেন-
‘বেলাল! বেলাল! হেলাল উঠেছে পশ্চিম আসমানে,
লুকাইয়া আছ লজ্জায় কোন মরুর গোরস্তানে!
…..
জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুদায় আসেনা নিদ,
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ…?’
নজরুল তাঁর সাহিত্যকর্মে নারী-পুরুষকে সমানভাবে দেখেছেন। তিনি নারীকে যথাযথ স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত হননি। তাঁর মতে, পৃথিবীতে সব কল্যাণকর অবদানের অধিকারী হচ্ছে নারী। ‘নারী’ (১৯২৫) কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই। / বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ এর মাধ্যমে তিনি নারীর ক্ষমতায়নের দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন। নজরুল অন্যান্য লেখায়ও নারীর প্রতি গভীর সম্মান প্রদর্শন করেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম সব সময় চেয়েছেন, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টিকারী ধর্মীয় সংস্কৃতির রাজনৈতিক ভৌগোলিক অচলায়তন ভেঙে ফেলতে। অন্তরের গভীর উপলব্ধি থেকে উচ্চারণ করেছেন, মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান। তিনি মানুষের ভেতরের আত্মবিশ্বাস এবং আত্মপ্রত্যয়ের অনমনীয় চিত্তকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছেন। একইভাবে কবিতাটিতে নজরুল নারীদের গুণগান করেছেন, গেয়েছেন নারীর জয়গান। নারীকে শক্ত ও সাহসী হতে বলেছেন, স্বীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করার মন্ত্রণা দিয়েছিলেন এভাবেই-‘আমি মহাভারতী শক্তি নারী।/আমি কৃষতনু অসিলতা/স্বাহা আমি তেজঃ তরবারি।’
মহান কবি কাজী নজরুল ইসলাম নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমি চাই, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের চেতনায় সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ উৎপাটন করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে উঠুক। জেগে উঠুক মানুষের ভেতরের আত্মবিশ্বাস এবং আত্মপ্রত্যয়ের অনমনীয় চিত্ত। তিনি আজীবন অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছেন, দেখিয়েছেন। তাঁর জীবনাদর্শ অনুসরণ করে একটি অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, শান্তিপূর্ণ, সুখী-সমৃদ্ধ ও আধুনিক বাংলাদেশ বিনির্মাণ হোক— এটাই আমার প্রত্যাশা।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
নজরুলের চেতনায় সমাজ হোক বৈষম্যহীন মুক্তমত মো. আশিকুর রহমান সৈকত