Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বাম জোটের হরতালে মন্ত্রী কেন লজ্জা পেলেন

রাশেদুজ্জামান রাশেদ
৩১ মার্চ ২০২২ ১৭:২৫

এক রাজ্যের মানুষ প্রতিদিন বাজারে গিয়ে টিভি ক্যামেরার সামনে কান্না করে, টিসিবির ট্রাকের পেছনে গিয়ে রোদে পুড়তে পুড়তে ভাগ্যকে অভিশাপ দেন পত্র-পত্রিকা-ফেসবুকে দ্রব্যমূল্য নিয়ে আহাজারি করেন। সে রাজ্যের মন্ত্রী জনগণকে রূপকথার গল্প শুনায়, বাজারে তিনি থলে নিয়ে যায়। আটা, ময়দা, চিনি, ডাল আর তেল, চাল, লবণ সবই সস্তা দামে পায়। আরেক মন্ত্রী লজ্জা পেয়ে বলে যে রাজ্যের থাকি রে ভাই সে রাজ্যই অযোগ্য নগরী। যানজটে পারে না গাড়ি চলাচল করতে। রাস্তার চারিদিকে লোকে পারে না কোনো কিছু দেখতে। ধুলোয় মাখা দূষিত নগরী, এ লজ্জার কথা কারে বলি ভাই। এ দেখি ভয়নক মুশকিল কথা।

বিজ্ঞাপন

সে রাজ্যে করোনার কারণে চাকরি হারিয়ে নতুন করে বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ে। মানুষ চাকরির জন্য হন্য হয়ে চারিদিকে খুঁজে। মন্ত্রীর কান্ড দেখে রাজ্যের জনগণ খিলখিলিয়ে দাঁত বের করে হাসে। গল্প মনে হলেও সত্য আমাদের দেশের সাথে অনেকাংশেই মিলে যাবে। আমাদের দেশের জাতীয় সংসদে তর্কের বাকবিতন্ডা চলে। কে বাজারে খরচ করতে যান আবার কে বাজারে খরচ করতে যান না! সত্য ঘটনা হলো সংসদের ভিআইপি আর নামি-দামিরা কী বাজারের থলে নিয়ে বাজার করতে যেতেন পারেন? না ওনার যেতে পারেন কারণ ওনাদের অনেক সম্মান আছে। বাজার করতে গেলে ওনাদের লজ্জা হবে।

বিজ্ঞাপন

প্রতি নিয়ত বাজারে খরচ করতে যান আমাদের দেশের কৃষক, শ্রমিক, কামার কুমার, জেলে, নাপিত ইত্যাদি দিনমজুর অসহায় ছিন্নমূল মানুষকে। তারা বাজারের হিসাব টা ভালো করেই জানেন মসুর ডাল, আদা, চিনি, ভোজ্য তেল-সব কিছুরই দাম উর্ধমুখী। এমনকি সবজি, মুরগি এবং মুরগির ডিমের দামও বেড়েছে। আসন্ন রমজান নিয়ে জনগণ উদ্বিগ্ন কারণ অতীতের ইতিহাস থেকে আমরা জানি মুসলমানদের রমজান মাস এলেই হুট করে বাজারে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি পায়। আর যারা মানুষ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জন করেন। তাদের বাজার খরচ করতে লজ্জা হয় না।

তবে দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে যখন লাগাম ছাড়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে বাম গণতান্ত্রিক জোটের অর্ধদিবস হরতাল সারা দেশে পালন করেছেন বাম জোটের নেতাকর্মীরা। তখন হরতাল নিয়ে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ব্যঙ্গ করে বলেছেন, ‘বাম জোটের হরতালে আমারই লজ্জা লাগছে’। অথচ তার উচিত ছিল কেন হরতাল করলো? নিত্যপণ্যের দাম কমানো সম্ভব কী না। তা আলোচনায় না নিয়ে তামাশায় উড়ে দিয়ে তার না কী লজ্জা লাগছে! তখন মনে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের দখলে রাজনীতির চেয়ার।

বর্তমানে অধিকাংশ রাজনীতিবিদদের ব্যবসায়িক সিন্ডিকেটে জড়িত। এর কারণ সংসদ সদস্য হতে আগ্রহী ব্যক্তিরা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেন। তারপর নির্বাচিত হওয়ার পরে তার বহুগুণ কামাই করেন তাদের পদ-পদবিকে কাজে লাগিয়ে। আবার অনেকেই এসব অর্থবিত্ত কামাই করেন চাঁদাবাজি, দখলদারিত্ব ও নিয়োগবাণিজ্য ইত্যাদির মাধ্যমে। আর এসবের সুযোগ আছে বলেই এখন সবাই ছুটে সরকারি দলে মনোনয়ন পত্র নিতে। দেশের মধ্যে প্রধান দুই জোটের নেতাদের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে যে ভাবখানা এমন ‘যে যা বলিস ভাই, আমার এমপি হওয়া চাই’- এমন মানসিকতা আজ মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে ভরপুর।

স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গাছের ঝুলন্ত নেতাদের বিলবোর্ডে। বাস্তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপরীতে চলছে দেশ। তখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের প্রবেশ কেন? কারণ কালো টাকার মালিক ব্যবসায়ীরা উন্মুখ হয়ে থাকেন। যার ফলে রাজনৈতিক মুখোশ পরলে অতি সহজেই কালো টাকা সাদা করা যায়। আমরা যদি সুজনের দেওয়া তথ্য একটু ভালো ভাবে লক্ষ্য করি তাহলে স্পষ্ট দেখতে পাবো বর্তমানে আমাদের দেশের রাজনীতি কাদের দখলে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) দেয়া তথ্য মতে. একাদশ জাতীয় নির্বাচনে শপথ নেয়া সংসদ সদস্যদের ১৮২ জনই (৬১ দশমিক ৭ শতাংশ) পেশায় ব্যবসায়ী। এর মধ্যে মহাজোট থেকে নির্বাচিত পেশায় ব্যবসায়ী আছেন ১৭৪ জন (৬০ দশমিক ৪১ শতাংশ) এবং ঐক্যফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত আছেন ৫ জন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য হওয়া ৩ জন পেশায় ব্যবসায়ী। যদিও পরে কিছু আসনে পরিবর্তন হয়েছে। সেখানেও রাজনৈতিকদের চেয়ে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দেখা যায়। আমাদের দেশের রাজনীতির হালচাল নিয়ে যখন লেখছি তখন মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এর একটা বক্তব্য স্মরণ হচ্ছে তিনি বলেছে, ” রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের পকেটে চলে গেছে। এটি অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। আসলেই তিনি সত্যি কথা বলেছেন। ব্যক্তির চেয়ে দল, দলের চেয়ে দেশ বড় এই আদর্শের বিপরীতে দেশের শাসন চলে।

পুঁজিবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় দেশ ও জনগণের কল্যাণের জন্য তারা শুধু মুনাফা খোঁজে। তারা রাজনীতিটাকে পেশা বানিয়ে নিয়েছে। আদর্শিক রাজনীতির মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব কার? প্রকাশিত সংবাদপত্রের তথ্য মতে মার্চ জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে, বাংলাদেশে সয়াবিন তেলের বাড়তি দাম নিয়ে ১৫ দিনে আনুমানিক প্রায় ১০০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলছেন, ‘প্রতিদিন যদি ৫০০০ টন ভোজ্য তেলে চাহিদা থাকে, তাতে লিটারে ১০ টাকা করে বাড়লে মোট অঙ্কটা অনেক বড় হয়। এভাবে আনুমানিক একটা পরিসংখ্যান আমরা দিয়েছি।’ এতদিনে সেই টাকা লোপাটের অঙ্কটা আরও বেড়ে গেছে। বাজার নিয়ন্ত্রণ না আসা পর্যন্ত সেই অঙ্ক বাড়তেই থাকবে। যার কারণে রাজনীতি চলে ব্যবসা কেন্দ্রীক।

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সমস্যা কী শুধু বামজোটের? না সমস্যা সারা দেশের মানুষের। রাজপথে যে পুলিশ হামলা করে তাকেও বাজার করতে হয়। ফলে বাজারের নিত্য পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে তারাও সমস্যা হয়। ফলে হরতাল ছিল জান বাঁচানোর হরতাল। মানুষ বিভিন্ন ভাবে হরতালে সতস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করে হরতাল সফল করেছেন। স্বাভাবিক ভাবে আমরা জানি যারা হরতাল করে তারা ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে কিন্তু মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বামজোটের হরতালে উল্টো ঘটনা ঘটেছে। হরতাল যারা আহবান করেছে উল্টো তাদেরকেই মারা হয়েছে। হরতালে হঠাৎ জলকামান, সাউন্ড গ্রেনেড, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে ও বেধড়ক লাঠিচার্জ করে। এতে আমাদের নেতারা পুলিশি আক্রমণে শিকার হয়েছেন বলে নেতাকর্মীদের অভিযোগ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

বিশেষ করে দেশের ঐতিহাসিক গণআন্দোলনগুলোতে বামপন্থীদের ভূমিকাও ঐতিহাসিক। ’৪৭ থেকে ’৭১-এর প্রতিটি পর্যায়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে বামপন্থীদের অবদান অনেক। শ্রেণি শোষণ থেকে আরম্ভ করে সব ধরনের শোষণ, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে বামপন্থার সর্বকালে সর্বদেশে লড়াই করে এসেছে। বুর্জোয়া নেতৃত্বও নানা ধরনের সামাজিক অবিচার, লিঙ্গ বৈষম্য ও জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে এখনও সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের তাদের আন্দোলন দেখে তাদের লজ্জা পাওয়ার কথা যারা ব্যবসার মাধ্যমে মুনাফা টিকে রাখতে যায়। দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল- নয় বরং রাষ্ট্র ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিতে কাজ করে। সময় এসেছে লজ্জা ভুলে গিয়ে জনগণের স্বার্থে কাজ করতে হবে। তরুণ তরুণীদের বেকারত্বে অভিশাপ থেকে রক্ষা করতে হবে। রাজধানীকে বাসযোগ্য করে গড়তে তুলতে হবে। অসৎ ব্যবসায়ীদের মহাসিণ্ডিকেটের পাহাড় ভেঙে ফেলতে হবে। চুরি, দুর্নীতি, লুটপাট আর অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। চাল-ডাল-পিঁয়াজ-সিলিন্ডার গ্যাসসহ অতি জরুরি খাদ্যদ্রব্য মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

বাম জোটের হরতালে মন্ত্রী কেন লজ্জা পেলেন মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ

বিজ্ঞাপন

সভ্য দেশের গৃহহীন মানুষ
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:০৮

আরো

সম্পর্কিত খবর