সড়কে মৃত্যুর মিছিল, দায় কার?
৫ এপ্রিল ২০২২ ১৪:৩৩
আমাদের বাড়ির আঙ্গিনায় কুকুরকে পা দিয়ে গর্ত করতে দেখলে দাদী কুকুরকে তাড়িয়ে দিতেন। তিনি কুকুরকে গর্ত করতে দিতেন না। একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। দাদী কুকুরটাকে কেন তাড়িয়ে দিলে? কুকুরটি কী অপরাধ করছিল? তখন দাদী উত্তরে বলতেন কুকুর যদি বাড়িতে গর্ত করে তাহলে অমঙ্গল হয়, কারো মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকে এ জন্য নাকী কুকুর গর্ত করে। তখন বুঝেছিলাম তিনি মৃত্যুকে খুব পান। বাড়িতে কুকুরকে গর্ত করতে দেন না। কিন্তু বাস্তবে কুকুর তাদের একঘেয়েমি দূর করার উপায় হিসাবে গর্ত খনন করে। দাদী চিন্তা কুসংস্কারপন্থী। তবে আমাদের দেশে যারা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় তাদের অনেকেই কপালে বা ভাগ্যে লেখা ছিল বলে মারা গেছে! এক শ্রেণির মানুষ কপালতত্ত্ব মূলক কুসংস্কারপন্থী কথা বলে সড়ক দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণটাকে ধামাচাপা দিতে চায়। ‘ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে!’ আষাঢ়ের বাদল দিনে কবি বাইরে যেতে নিষেধ করতেন।
কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিবারের শিক্ষিত মা বাবা তার সন্তান-সন্ততিদের বাইরে যেতে নিষেধ করেন। কারণ দেশে সড়ক দুর্ঘটনা যে বিদ্যুৎ গতিতে বেড়েই চলছে। তা নিয়ে দেশের মানুষ খুবেই উদ্বিগ্ন। মহামারি মরণব্যাধি করোনা ভাইরাস থেকে মুক্তির পথ নিয়মিত মাস্ক ব্যবহার করা, টিকা গ্রহণ করা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ইত্যাদি। কিন্তু দুঃখের বিষয় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু থেকে মুক্তির পথ কী? একটা সড়ক দুর্ঘটনায় এক জন মানুষের মৃত্যু হলে তার পরিবার চিরদিনের জন্য শুধু চোখে জল ফেলাবেন তা নয় পরিবারটি আজীবনের জন্য অর্থনৈতিক সংকট লেগেই থাকে। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় বছর দুই আগে আমার বাড়ির পাশে ডিজেল চালিত নসিমোন গাড়ির ড্রাইভার সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে। তার পরিবারের একমাত্র তিনি উপার্জন করার মত ব্যক্তি ছিলেন। তার পাঁচ মাসের ছেলে সন্তান আছে। কিন্তু তার মৃত্যুর পর অভাবের সংসারে তার বউকে অন্যের সাথে বিয়ে দেয়। তার পরিবার এখন খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। সেই সাথে তার ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা করা অনিশ্চিত কারণ ঠিক মত খেতেই পায় না আবার পড়ালেখা করাবে কেমন করে।
দেশে যখন করোনা সংক্রামণ দেখা দিয়েছিল তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস আদালতসহ অনেক কিছুই বন্ধ ছিল তখন ভাবছি এবার বুঝি সড়কে মৃত্যুর খবর শুনতে হবে না। কারণ সড়কে তো বেশি যানবাহন চলে না। কিন্তু ঘটনা উল্টো ঘটেছে মানুষ ঘরে থাকতে পারে নি। করোনা ভাইরাসকে উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পেটে ক্ষুধা নিবারণের জন্য কর্মক্ষেত্রে বাইরে এসেছিল। সেই কর্মক্ষেত্রে এসে একদিনে করোনায় মৃত্যু অন্য দিকে সড়কের মৃত্যুর মিছিল ভারী হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। পরিসংখ্যান বলে দিচ্ছে, করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ৮৫ দিন গণপরিবহন বন্ধ থাকার পরও ২০২১ সালে ৫ হাজার ৬২৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮০৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৯ হাজার ৩৯ জন। ২০২০ সালে দেশে চার হাজার ৭৩৫টি সড়ক দুর্ঘটনায় পাঁচ হাজার ৪৩১ জন নিহত এবং সাত হাজার ৩৭৯ জন আহত হয়েছেন বলে রোডটি সেফটি ফাউন্ডেশনের ‘সড়ক দুর্ঘটনার বার্ষিক প্রতিবেদন-২০২০’ এ বলা হয়েছে।২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা শূন্য দশমিক ৮৯ শতাংশ বেড়েছে। প্রাণহানি বেড়েছে চার দশমিক ২২ শতাংশ এবং আহতের হার বেড়েছে তিন দশমিক ৮৮ শতাংশ। আগের বছরে তুলনায় ২০২০ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং প্রাণহানি বেড়েছে ৫৪ দশমিক ৮১ শতাংশ। এই মৃত্যুর মিছিলের শেষ কোথায়? নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজপথে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ধারাবাহিক আন্দোলন করে যাচ্ছে। টেলিভিশনের গোল টেবিল আলোচনায় নিরাপদ সড়কের মডেল তৈরী করা হয়। সড়কে পথযাত্রীদের গণসচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করেন সাংবাদিকরা। পত্রিকার পাতায় পাতায় কলামের পর কলাম নিরাপদ সড়কের জন্য মতামত, গবেষণা ইত্যাদি হতেই চলছে। শুধু জনগণ সচেতন হলেই কী নিরাপদ সড়ক হবে? না কী রাষ্ট্রের অব্যবস্থাপনা আছে? সম্প্রতি রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলে বাসের ধাক্কায় সিএনজিচালিত অটোরিকশার একই পরিবারের তিন যাত্রী নিহত হয়েছেন। এই মৃত্যুর মিছিলের পদযাত্রী শ্রমজীবী, শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক। সড়কে দেশের মেধাবী সম্পদ পিষে মারা হচ্ছে। রাষ্ট্রের নিরবতা কেন? নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাজপথে স্লোগান দেয় ‘জেগেছে জেগেছে ছাত্র সমাজ জেগেছে’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘আমার ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’। তাদের স্লোগানে সড়কে অব্যবস্থাপনার চিত্র ফুটে ওঠেছে। নিরাপদ সড়ক প্রতিষ্ঠাসহ ১১ দফা দাবিতে রাজধানীর রামপুরায় সর্বসাধারণের মধ্যে প্রচারপত্র বিতরণ করেছে সোহাগী সামিয়ার নেতৃত্বে কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি গুলোর মধ্যে সড়কে নির্মম কাঠামোগত হত্যার শিকার নাঈম ও মাঈনউদ্দিনের হত্যার বিচার করতে হবে। তাদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। গুলিস্তান ও রামপুরা ব্রীজ সংলগ্ন এলাকায় পথচারী পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজ নির্মান করতে হবে। সারাদেশে সকল গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফপাস সরকারি প্রজ্ঞাপন দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে। হাফপাসের জন্য কোনো সময় বা দিন নির্ধারন করে দেওয়া যাবে না। বর্ধিত বাস ভাড়া প্রত্যাহার করতে হবে। সকল রুটে বিআরটিসির বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। গণপরিবহনে ছাত্র-ছাত্রী এবং নারীদের অবাধ যাত্রা ও সৌজন্যমূলক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ফিটনেস ও লাইসেন্স বিহীন গাড়ি এবং লাইসেন্স বিহীন চালককে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।গাড়ি ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে বিআরটিএ’র দূর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। সকল রাস্তায় ট্রাফিক লাইট, জেব্রা ক্রসিং নিশ্চিত করা সহ জনবহুল রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ এর সংখ্যা বাড়াতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের ঘুষ দূর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। বাসগুলোর মধ্যে বেপরোয়া প্রতিযোগিতা বন্ধে এক রুটে এক বাস এবং দৈনিক আয় সকল পরিবহন মালিকের মধ্যে তাদের অংশ অনুয়ায়ী সমান ভাবে বণ্টন করার নিয়ম চালু করতে হবে। শ্রমিকদের নিয়োগপত্র – পরিচয়পত্র নিশ্চিত করতে হবে। চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করতে হবে। চুক্তি ভিত্তিতে বাস দেওয়ার বদলে টিকেট ও কাউন্টারের ভিত্তিতে গোটা পরিবহন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শ্রমিকদের জন্য বিশ্রামাগার ও টয়লেটের ব্যবস্থা করতে হবে। গাড়ি চালকের কর্মঘন্টা একনাগাড়ে ৬ ঘন্টার বেশি হওয়া যাবে না। প্রতিটি বাসে ২ জন চালক ও ২ জন সহকারী রাখতে হবে। পর্যাপ্ত বাস টার্মিনাল নির্মান করতে হবে। পরিবহন শ্রমিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যাত্রী- পরিবহন শ্রমিক ও সরকারের প্রতিনিধিদের মতামত নিয়ে সড়ক পরিবহন আইন সংস্কার করতে হবে এবং এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ট্রাক,ময়লার গাড়ি সহ অন্যান্য ভারী যানবাহন চলাচলের জন্য রাত ১২ টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত সময় নির্ধারিত করে দিতে হবে। মাদকাসক্তি নিরসনে গোটা সমাজ জুড়ে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। চালক-সহকারীদের জন্য নিয়মিত ডোপ টেস্টের ও কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে শিক্ষার্থীদের ১১ দফার দাবির কোনোটিই অযৌক্তিক কোনো দাবি নয়। সড়ক দুর্ঘটনা কেন হয়? সড়ক দুর্ঘটনার কারণ গুলো বিশ্লেষণ করে দেখি তাহলে দেখা যাবে মোটাদাগে কয়েকটি কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে তা হলো বেপরোয়া গতি, বিপদজনক অভারটেকিং, রাস্তাঘাটে ত্রুটি, ফটিনেসবিহীন যানবাহণ, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চালকের অদক্ষতা ইত্যাদি।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী গত বছর ৫ জুলাই সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে বালু বোঝাই ট্রাক চাপায় স্কুল ছাত্র সহদর দুই ভাই নিহত হয়েছে। এ সময় ট্রাক খাদে পড়ে যায়। এই প্রতিবেদন থেকে বলা যায় ওই রাস্তা যদি খাদ না থাকতো তাহলে সন্তানহারা মায়ের কোল খালি হত না। ফলে সারা দেশের রাস্তার চিত্র করুণ। যার জন্য মানুষের মৃত্যুও হচ্ছে করুণ ভাবে। ‘রাস্তা নির্মাণ হলো, এক পশলা বৃষ্টি হলো, রাস্তা থাকে না। ছাল-বাকল সব উঠে যায়। তাহলে এই রাস্তা করার দরকার কি? রাস্তার জন্য বড় বড় বরাদ্দ। কিন্তু কিছু দিন গেলেই নানান সংকট দেখা দেয়। কোথাও গর্ত, কোথাও দেবে যায়, ছেঁড়া কাঁথার মতো রাস্তায় ফাটল দেখা যায়। এসব কেন হবে?’ এমন প্রশ্ন ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের প্রকৌশলীদের। সড়ক নির্মাণ খরচ বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশে বেশি এমন তথ্য জানিয়েছেন বিশ্বব্যাংক। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের সড়ক হয়ে গেছে মানুষের জন্য মৃত্যুঝুঁকি। তাহলে বেশি অর্থ ব্যয় করেও রাস্তা উন্নত হয় না কেন? রাজনৈতিক অবক্ষয় ও ক্ষমতার অপব্যবহার। ফলে দুর্নীতি ও অপরাধের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার প্রভাব বিস্তার করে। দেশ পরিচালনা নীতিতে সাধারণ জনগণের স্বার্থের চেয়ে উচ্চবিত্তদের প্রাধান্য দেয়া এবং ব্যক্তিগত লাভের জন্য রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার। কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যেও স্বাস্থ্যখাতে নানা কেলেঙ্কারি খবর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বড় ধরনের দুর্নীতিকে বিচারের আওতায় না আনা এবং রাঘব বোয়ালদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার ক্ষেত্রে দুদকের অকার্যকর ভূমিকা। আর্থিক ও ব্যাংকিং সেক্টরে ঋণখেলাপীদের বাঁচাতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং চুক্তির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের কার্যক্রম সংকুচিত করা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা এবং তথ্য, সংবাদ প্রকাশ ও বিরোধী মতের প্রতি সহশীলতার অভাব। ইত্যাদির কারণে ইতোমধ্যে বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) ২০২২ সালের ২৫ জানুয়ারি তাদের বার্ষিক দুর্নীতির ধারণাসূচক (সিপিআই)–২০২১ প্রকাশ করেছে। সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় গত বছর বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম হলেও এই বছর হয়েছে ১৩তম। দুর্নীতির ধারণাসূচকে হতাশা দেশের মানুষ।কোন পথে বাংলাদেশ? জনগণের কল্যাণে সর্বপ্রথম দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। সেই সাথে রাস্তার মেরামত কাজে দুর্নীতি অনিয়ম বন্ধ করা না হলে সড়কের অব্যবস্থাপনা থেকেই যাবে।পরিবহনের মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্বরাস্তা তৈরি করতে হবে। পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে। গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। রেল ও নৌ-পথ সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমাতে হবে। টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। সড়কে মৃত্যুর মিছিল বন্ধ করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি