রাজনৈতিক সংস্কৃতির অসুস্থতা: আ.লীগ নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী
১৩ এপ্রিল ২০২২ ১৪:২৪
বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাসে বাংলাদেশ আওয়ামী লগের মতো কীর্তিবাহী রাজনৈতিক গণসংগঠন দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না। যে সংগঠনের নেতৃত্বে একটি জাতিসত্তা বিনির্মাণ, নিয়মতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সেই রাষ্ট্রের সুবর্ণজয়ন্তীতে বিশ্বসভায় অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। কিন্তু জাতির দুর্ভাগ্য, আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দ্বিতীয় আর কোনো স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠেনি। রাজনৈতিক দলের নামে যা আছে তাদের জন্ম হয় জলপাইতলায়, না হয় ধর্মতলায়। আর আছে বিশ্বব্যাপী প্রত্যাখ্যাত বাতিল কিছু স্বপ্নভাবালু গ্রুপ। তাই বলা হয়ে থাকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল দু’টি। আওয়ামীলীগ ও এন্টি আওয়ামী লীগ।
টানা তিনবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগ নিজেই এখন নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী। রাজনীতিতে অর্থ, ধর্ম ও ক্ষমতার চরম অপব্যবহার, অনৈতিক-অসহিষ্ণু-সুবিধাবাদী-দুর্বিত্তায়িত মানসিকতা, অশিক্ষা-অজ্ঞতা-অসচেতনতা সেই সঙ্গে রিয়েল লাইফের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে অবারিত ভার্চুয়াল জগতের নানা জানালা। আওয়ামী লীগের মতো একটি গণসংগঠন যেখানে নিরক্ষর থেকে পন্ডিত, প্রান্তিক মানুষ থেকে ধনাঢ্যজন সবাই এর স্টেক হোল্ডার, এমনতর একটি গণসংগঠনের রাজনৈতিক চরিত্র বিশুদ্ধ রাখা প্রায় অসম্ভব। নানা বৈচিত্র্যের ব্যক্তি বিচ্যুতি ও অপচর্চার ধারাবাহিকতা রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে অসুস্থতার সৃষ্টি করেছে তা নির্মূলযোগ্য না হলেও নিয়ন্ত্রণযোগ্য।
’৭১ ও ’৭৫-এর শত্রুরা রাজনৈতিকভাবে রিয়েল লাইফে প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় অগাধ অর্থ ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে পাকিপন্থী শত্রুশাবকরা। বিগত কয়েক বছরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বেড়ে ওঠা প্রজন্ম অনলাইন এক্টিভিস্ট হিসেবে কিছুটা শক্তি অর্জন করলে শত্রুশাবকদের মিশন সফল করতে নিজের অজান্তেই যুক্ত হয় অবুঝ ধর্মান্ধ আওয়ামী এক্টিভিস্টরাই। ঘরে-বাইরে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিভ্রান্ত আওয়ামী নেতা-কর্মীরাই।
২০১২ সালের অক্টোবরে রাষ্ট্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সামগ্রিক উদ্যোগের সহায়ক কৌশল হিসেবে ‘সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়: জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল’ প্রণীত হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন, “এই কৌশলটি বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, সুশীল সমাজ এবং বেসরকারি শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। চরিত্রনিষ্ঠা আনয়নের জন্য মানুষের জীবনের একেবারে শুরু, অর্থাৎ পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। রাজিনীতিতেও শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।”
বর্তমানে সকল প্রকার সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ‘শুদ্ধাচার কৌশল কর্মপরিকল্পনা’ গ্রহণ করা হয়েছে। সে লক্ষ্যে বিভিন্ন সময়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু হয়েছে। রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিটি সেক্টরে অনৈতিকতা এখন মহামারিতে রূপান্তরিত। রাষ্ট্রের মধ্যে যা কিছুই ঘটুক না কেন দিনশেষে দায়টা রাজনীতিবিদদের। তাই রাজনীতিতে শুদ্ধাচার প্রয়োজন সবার আগে। কিন্তু রাজনৈতিক শুদ্ধাচার ফিরিয়ে আনার কোনো পরিকল্পিত সাংগঠনিক উদ্যোগ নেই। আদতে প্রয়োজন সকল নেতা-কর্মীর রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ। প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের চর্চা গণসংগঠনে নেই। নেতা-কর্মীদের সচেতনতা ফিরিয়ে আনতে ও রাজনৈতিক শুদ্ধাচার প্রতিষ্ঠা করতে অসঙ্গতিসমূহ চিহ্নিত করা গেলেই একটি বড় কাজ হবে।
আওয়ামী লীগের কাছে জনগণের প্রত্যাশা এবং করণীয় একেবারেই নীতিনির্ধারণী বিষয়। কিন্তু আমাদের চোখের সামনে মাঠ পর্যায়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য অসঙ্গতি যে অসুস্থ ধারার সৃষ্টি করেছে, শীর্ষ নেতৃবৃন্দ যদি সেগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন তাহলেই অনেকটা নিয়ন্ত্রণ আসবে এই অপচর্চা। এই প্রক্রিয়ায় ইতোমধ্যেই অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে যা আমাদের মনে রাখতে হবে এবং ধরে রাখতে হবে।
দুই-একটি উদাহরণ দেই। বিগত মাত্র কয়েক বছর আগে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রাজনীতিতে হাইব্রিড-কাউয়া বিষয়ক ডিসকোর্স তুলে ধরলেন। এই মুখরোচক ডিসকোর্সটি এমনভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল স্থানীয় নেতৃবৃন্দও এখন অনেক বেশি সাবধানী। এরই ধারাবাহিকতায় আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনসমূহের নতুন কেন্দ্রীয় কমিটিগুলো প্রায় হাইব্রিড-কাউয়া শূন্য।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিত্য নতুন ডিজিটাল সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। যেমন হাতে লেখা ব্যানারের জায়গা কেড়ে নিয়েছে ডিজিটাল প্রিন্ট। প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডিজিটাল প্রিন্ট সহজলভ্য হওয়ায় দলের ভুঁইফোড় নেতা-কর্মীরা আত্মপ্রচারের এই মোক্ষম সুবিধাটি পুরোমাত্রায় ব্যবহার করল। দেশ ঢেকে গেল বিজ্ঞাপনে। সকল প্রকার জাতীয় দিবস, সাংগঠনিক দিবস এমনকি ১২ মাসের তের পার্বণে প্রচারে, সৌজন্যে, শুভেচ্ছান্তে, পৃষ্ঠপোষকতায়, পছন্দের নেতার অনুগত্যে অসংখ্য বড় বড় ছবি ও বঙ্গবন্ধু ও নেত্রীর মাইক্রোসকপিক ছবি ব্যবহার করে ব্যানার, তোরণে ঢেকে গেল শহর, বন্দর-জনপদ। ওয়ার্ড পর্যায়ের কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা, দু’একজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা বছরের ৩৬৫ দিন যেন নিজের বিশাল খোমাসম্বলিত বড় বড় বিলবোর্ড ও ফেস্টুন ঢাকাসহ দেশের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যেন শোভা পায় তার যথাযথ ব্যবস্থা করেছিল। এমনকি জাতীয় শোক দিবসের ব্যানার পোস্টরেও প্রচারকারীর বিশাল ছবির পাশে হারিয়ে যেত বঙ্গবন্ধুসহ ১৫ই আগস্টের শহিদদের মুখ। এমন নির্লজ্জ, বেহায়া আত্মপ্রচার পৃথিবীতে কেউ কখনও দেখেছে বলে মনে হয় না।
অবশেষে, ২০১৫ সালের ১৪ই ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এক চিঠিতে নির্দেশনা জারি করেন, ‘পোস্টার-ব্যানার, বিলবোর্ড, ফেস্টুন ও লিফলেটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি ছাড়া কারও ছবি ব্যবহার করা যাবে না।’ কিন্তু শুভেচ্ছার বন্যা কিছুটা কমলেও খুব বেশি পরিস্থিতির উন্নয়ন হয়নি। সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলো পরিচ্ছন্নতায় কিছুটা উদ্যোগী হলো। সকল অঙ্গসংগঠনে পরিবর্তনের হাওয়া লাগল। ওবায়দুল কাদেরসহ মূল দলের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ভুঁইফোড় নেতাদের আত্মপ্রতারণা নিয়ে ট্রোল করা শুরু করলেন ও অঙ্গসংগঠনসমূহের নবনির্বাচিত নেতৃবৃন্দ অনেকটা সোচ্চার হলেন। এখন পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে। আর যাইহোক, কয়েকবছর শোক দিবসের প্রচারণায় অযাচিত খোমা প্রদর্শন তেমন চোখে পড়েনি।
অপরাজনীতির এই অস্থির সময়ে আরেকটি ইতিবাচক পরিবর্তনের উদাহরণ দেই। স্বাধীনতার পূর্বে বিদগ্ধজনেরা আফসোস করত, বাঙালির একটি বড় সংকট হচ্ছে বাঙালি সংগঠন বুঝে না, বাঙালির কোনো সংগঠন নেই। আর এখন সেই শূণ্যতা দূর করতে বাঙালি এখন এতটাই সিদ্ধহস্ত, শুধু বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে হাজারো ভুঁইফোড় সংগঠন। এদের দৌরাত্ম এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, সাধারণ মানুষ অনেকেই বিভ্রান্ত কোনটা আসল আরকোনটা নকল সংগঠন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের জাতীয় সংগঠন গড়ার জন্য নামের শেষে ‘লীগ’ যুক্ত করে কিছু ব্যানার পোস্টার করলেই সৃষ্টি হয়ে গেল নতুন দোকান। এক ‘প্রজন্ম লীগ’ এই যুক্তশব্দের আগে পিছে কয়েকটি শব্দ জুড়ে তৈরি হলো কয়েক ডজন দোকান। বেশ কয়েকজন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা আছেন যাদের দাওয়াত করলেই তারা সম্মানিত বোধ করেন। কে, কারা, কী উদ্দেশ্যে, কী অনুষ্ঠান করছে সে খবর নেই, দাওয়াত দেওয়া মাত্রই নেতা উপস্থিত। একটা অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় নেতা আসলে তার সঙ্গে এমনভাবে সেলফিবাজি করা হয় যে, আয়োজকদের ধান্দাবাজীর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ব্যবস্থা হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু নামের যথেচ্ছ ব্যবহার কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হলো। কিন্তু ‘লীগ’ যুক্ত বাহারি নামের সংগঠনসমূহের অবাধ দৌরাত্ম চলছেই। ১৯৯৪ সালে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট গঠন করা হয়। ট্রাস্টের নীতিমালায় বলা হয়, বঙ্গবন্ধু বা তার পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করে কোনো ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান সামাজিক-সাংস্কৃতিক, স্বেচ্ছাসেবী ও দাতব্য কোনো সংগঠন গড়ে তুলতে চাইলে বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট থেকে অনুমোদন নিতে হবে। ট্রাস্ট গঠনের দুই বছর পর ১৯৯৬ সালে প্রথমে বঙ্গবন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের নামে সংগঠন অনুমোদন দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এরপর থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ১৭টি সংগঠনকে অনুমোদন দেয় বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। ২০১৫ সালের পর আর কোনো সংগঠন ট্রাস্টের অনুমোদন পায়নি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা পার্লামেন্টে যেমন ঘোষণা দিতে বাধ্য হলেন, তিনি এবং শেখ রেহানার পরিবারের সদস্য ছাড়া আর কেউ বঙ্গবন্ধু পরিবার নয়, তেমনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ২৫(২) ধারা অনুযায়ী আটটি সহযোগী সংগঠন ১টি ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন (ছাত্রলীগ) ও স্ব-শাসিত সংগঠন (শ্রমিক লীগ) ছাড়া বৈধ আর কোনো সংগঠন নেই। কিন্তু ভুঁইফোড় সংগঠনসমূহের বেপরোয়া গতিতে চরম অস্বস্তিতে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম তার ফেসবুকে এক পোস্টে বলেছেন, “ময়ূরের পেখম লাগালেই কাক কখনো ময়ূর হয় না। তেমনি নামের সঙ্গে ‘লীগ’ শব্দ ব্যবহার করলেই আওয়ামী লীগ হয়ে যায় না। আওয়ামী লীগ একটা আদর্শ। এটাকে ধারণ করতে হয়। দলের গঠনতন্ত্রের বাইরে কোনো সংগঠনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক নেই।”
এই সংকট থেকে উত্তরণ ঘটালেন মহামতি হেলেনা জাহাঙ্গীর। গতবছর ২২ শে জুলাই আওয়ামী লীগের নামের সঙ্গে নাম জুড়ে ‘চাকরিজীবী লীগ’ নামের একটি সংগঠন বিভিন্ন জেলা-উপজেলা ও বিদেশি শাখায় নেতা বানাতে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেয় হেলেনা জাহাঙ্গীর। তখনই নড়েচড়ে বসে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। ১৭ই সেপ্টেম্বর একটি ‘প্রজন্ম লীগ’ খোদ ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর আয়োজন করলে স্বয়ং সাধারণ সম্পাদক তা বন্ধ করে দেন। এরপর পরই নেতা-কর্মীরা কিছুটা সচেতন হলো, প্রশাসন উদ্যোগী হলো। গ্রেফতার এড়াতে অনেক পালের গোদা পালিয়ে বেড়ালেন। আপাতত এই ভুঁইফোড় ধান্দাবাজরা দৌড়ের উপর রয়েছে।
মাত্র তিনটি উদাহরণ দিলাম। এখন ভাবুন ২/১ বছর আগেও এইসকল অসুস্থ ধারা যে নিয়ন্ত্রণযোগ্য, সুশীল সমাজ বা রাজনীতি সচেতন মানুষ কল্পনা করতে পেরেছিল কি? অথচ কত সহজে শুধু কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ শুধু নোটিশ করেছে তাতেই দুরারোগ্য তিনটি রাজনৈতিক বিষফোঁড়া নির্মূল প্রায়।
কিন্তু আরও অসংখ্য বিষফোঁড়া রাজনীতিতে প্রবহমান। এগুলো নিয়ন্ত্রণ খুব জরুরী এবং আমি বিশ্বাস করি প্রচলিত অনেক অসুস্থ ধারা যদি ঠিকমত নোটিশ করা যায় তাইলেই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
এরকমই কয়েকটি ইস্যু নিয়ে ধারাবাহিক লিখবো। যেহেতু প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ বেশ দুরূহ কাজ কিন্তু নেতা-কর্মীদের সচেতনতায় এই ভাবনাগুলো ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি।
রাজনীতিতে কদমবুসি সংস্কৃতি
জ্যেষ্ঠদের সম্মান জানানো সকল ধর্ম ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধর্মজীবীরা স্থানীয় সংস্কৃতির প্রায় সকল অনুষঙ্গ ও প্রচলিত রীতিনীতিকে ধর্মের নামে নানা প্রকারের অপব্যাখ্যা ও ফতোয়া দিয়ে বিধর্মী/বিজাতীয় ট্যাগ লাগাতে সর্বদা সচেষ্ট থাকে। পহেলা বৈশাখ বা একুশে ফেব্রুয়ারি পালন, কিংবা টিপ পরা মুসলমানের জন্য হারাম বলে যারা ফতোয়া দেয় তারাই ‘কদমবুসি’-কে শিরক বলে জ্ঞান করে। আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির গতিপথে বাঁধ দিতে ধর্মান্ধরা যতই চেষ্টা করুক তা রুদ্ধ করতে পারেনি। শত প্রতিকূলতা স্বত্বেও বাঙালির পারিবারিক ও সামাজিক রীতি হিসেবে ‘কদমবুসি’ আজও আছে এবং প্রবলভাবেই তা আছে। কদমবুসি’র অর্থ হচ্ছে পদচুম্বন বা পদধূলি কপালে ধারণ। সমস্যা হচ্ছে কে কাকে কদমবুসি করবে? প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী পিতা-মাতা বা পিতৃমাতৃতূল্য ব্যক্তিকেই আমরা কদমবুসি করি। এটাই সম্মান জানানো বা অনুগত প্রদর্শনের ভারতীয় প্রথা।
যেহেতু কদমবুসির মাধ্যমে খুব সহজেই সম্মান জানানো বা অনুগত প্রদর্শন করা যায় তাই অধুনা রাজনীতিতে এটি মহামারির চেয়েও ভয়াবহ রূপ পেয়েছে। নেতার শুভদৃষ্টি যে কর্মীর প্রয়োজন সেই নেতা পিতৃমাতৃতূল্যতো অনেক পরের বিষয়, বয়সে যদি অনুজও হয় তবুও ভরা মজলিসে নেতার চরণধূলি কপালে ধারণ করার প্রতিযোগিতায় সে ভীষণ সিরিয়াস। আমি অনেক অশীতিপর বৃদ্ধ থেকে শিক্ষিত জ্যেষ্ঠ মানুষ দেখেছি তাদের হাঁটুর বয়সী, নাতি বা নিদেনপক্ষে পুত্রবয়সী তরুণ জনপ্রতিনিধিদের খুবই অনুরাগ নিয়ে কদমবুসি করতে।
আওয়ামী লীগের জাতীয় নেতাদের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা কদমবুসি করে, যদিও দ্রোহকালীন কৈশোরে একটু খটকা লেগেছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এটা স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু হঠাৎ করেই দেখলাম সম্মেলন শেষে ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়ে গেল কর্মীদের কদমবুসি করার প্রতিযোগিতা। ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে একটু লজ্জা লাগল।
বৈশ্বিকভাবে রক্ষণশীলরা ক্ষমতাশালী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে সেক্যুলার রাজনীতিবিদদেরও এখন ভোটের রাজনীতিতে ধর্মভীরু প্রমাণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কমিউনিস্ট নেতাদেরও আমরা হজ্বে যেতে দেখি, তারাও নামের আগে আলহাজ্ব যুক্ত করেন। বিশেষ কোনো পীরের মুরিদ নয় এমন জাতীয় নেতা খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগের কয়েকজন জাতীয় নেতা আছে তাদের কদমবুসি করলে তারা পরম মমতায় দোয়া দুরূহ পড়ে ফুঁ ও দেন। একজন বর্ষীয়ান নেতা রয়েছেন যার পদধূলি মাথায় নেয় নি এমন কোন কেন্দ্রীয় নেতা (দু’একজন ব্যতিক্রম ছাড়া) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে আছে কি-না সন্দেহ। সিনিয়র নেতারা যখন তাকে কদমবুসি করেন উপস্থিত অন্যান্যদের তা অনুসরণ করা ছাড়া উপায় থাকে না। কেউ কদমবুসি করলে সাধারণত তার মাথায় নেতা হাত বুলিয়ে দেন, কিন্তু অনুতাপের বিষয় হলো, অধিকাংশ সময়ে কদমবুসিকালে এই নেতা এতটাই ভাবলেশহীন থাকেন যে, মানুষ না অন্যকোন প্রাণী তার পদস্পর্শ করল সে দিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। একজন শীর্ষস্থানীয় নেতার প্রতি মুহূর্তে অসংখ্য মৌখিক ছালাম গ্রহণ করতে হয়, প্রত্যেকের ছালাম যথাযথভাবে গ্রহণ করে ফিরতি ছালাম দেওয়া সম্ভব হয় না, অনেকে শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে যান। ছাত্রলীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে দেখেছি তারা মাথাও ঝাঁকান না। কিন্তু কদমবুসিকালেও যে মানুষ নির্বিকার থাকতে পারে এটা জানা ছিল না। মানুষ যখন তার ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে নেতার চরণে কপাল ঠেকায় তখন নেতার নির্লিপ্ততা অভূতপূর্ব মনে হলেও খুব অযৌক্তিক মনে হয় না।
আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি অফিসে একদিন এক বৃদ্ধলোককে দেখলাম দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়াকে কদমবুসি করার প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছেন। বড়ুয়া যথারীতি ভৎর্সনা করা শুরু করলেন, বিপরীতে বৃদ্ধ কর্মী বললেন, ‘বয়সে আমি বড় হলেও রাজনীতিতেতো আপনি অনেক সিনিয়র…আমি তো আর বেয়াদব না!’ বিগত ২ বছরে করোনা মহামারিও কর্মীদের ‘কদমবুসি’ থেকে বিরত রাখতে পারেনি। কে চায় বেয়াদব ট্যাগ খেতে? স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক দু’জনেই নিখাদ ভদ্রলোক বলে কর্মীদের কদমবুসিতে প্রায়শই বিব্রত হন। এ থেকে মুক্তি পেতে আমার পরামর্শও চেয়েছেন একবার। আমি আর কি বলবো, কেননা আমার মতো পাতি নেতাও এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে দু’চারবার পড়েছি! তাদের বিড়ম্বনা তাই সহজেই অনুমেয়। যুবলীগ সভাপতি নাকি একজন লোক রেখেছেন কদমবুসি পার্টিকে ঠেকানোর জন্য। নেতার প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য দিন দিন ব্যক্তিত্বের এমন অবক্ষয় রাজনীতির জন্য অমঙ্গলজনক।
সারাবাংলা/আইই