‘এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী’
১৩ এপ্রিল ২০২২ ১৭:৫৩
আমাদের বিয়ের বয়স ছয় মাস না পেরুতেই পহেলা বৈশাখ এসে গেল। তখনও জুকারবার্গ আঠারো পেরোয়নি। হার্ভার্ডে ঢুকবার প্রস্তুতি চলছে। ফেসবুক ভূমিষ্ঠ হয়নি। প্রথম আইফোন এসেছে আরও ছ’বছর বাদে। সব মিলিয়ে আদম হাওয়া ইডেন গার্ডেনে (কিংবা রমনা পার্কে) ‘শুধু দু’জনে’ হাত ধরে হাঁটছিল সেই বৈশাখে।
হাতে একটা নকিয়া ফোন ছিল বটে। তবে সেই ফোনকে এখন বলা হয় ‘ডাম্ব ফোন’। কারণ সে স্মার্ট ছিল না। আমাদের ছোটবেলার ‘মিমি, মিমি, মিমি – মিমি চকলেট“ এর সাথে কিবোর্ডের মিল থাকার কারণে সেই ফোনগুলোকে ‘ক্যান্ডিবার ফোন’ বলা হয়। গুগল সার্চ দিয়ে দেখতে পারেন।
পাঞ্জাবীর পকেটে ফোন, গায়ে বৈশাখী শাড়ি, হাতে লাল চুড়ি। আচ্ছা, চুলে কি বেলী ফুল ছিল? শাড়িটা কি সাদা লাল নাকি নীল লাল? মনে পড়ে না। কোনো ছবি নাই। অবাক লাগে মাত্র ২০ বছর আগে ছবি ছাড়াও আমাদের উৎসব হতো। সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড ছাড়াও আমরা শাড়ি পড়তাম, কপালে টিপ দিতাম, রমনায় গান হতো। ছায়ানটের শিল্পীরা কাক ভোরে বাংলাজ শাড়ি পরে বর্ষবরণ করতো!
আমাদের তখন গাড়ি ছিল না। ভোরের বাতাসে হুট ফেলে রিকশা চড়ার সেই স্বাদ! সেই ঘ্রাণ! বাতাসে সীসার নেই কোনো বাড়াবাড়ি। বছর বছর দূষিত শহরের তালিকায় তখনও নাম উঠে নাই ঢাকার। উন্নয়নের জোয়ারের পালে তখনও এমন তীব্র হাওয়া লাগেনি। সিগারেটের ধোঁয়ার সঙ্গে ক্ষতির মাত্রা নিয়ে তখনও হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করছে না ‘ডেভেলপমেন্ট ডাস্ট’।
আমরা রিকশা চালকের ভাড়া মিটিয়ে রমনা পার্কের মাঠের মাঝ দিয়ে সরু একটা পথ বেয়ে বটমূলের দিকে যাচ্ছিলাম। নিরাপত্তা বেষ্টনীর বালাই নাই। স্বাধীন সার্বভৌম মন দিয়ে সার্বজনীন বৈশাখ বরণে আমরা মিলিয়ে যাচ্ছি। বাচ্চারা গালে একতারা এঁকে হাতে ডুগডুগি বাজাচ্ছে। দূরে নাগরদোলা একবার আকাশ ছুঁইছে। আবার পাতালে নামছে। আকাশ বাতাস আকুল করে একটি মেয়ে গাইছে,
“এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায়
হেরিনু পল্লী জননী
ফুলে ও ফসলে কাদামাটি জলে
ঝলমল করে লাবনী।”
আমিও গুনগুন করে গাইছি আর ভাবছি ‘হেরিনু’ শব্দের অর্থ কী? কাজী নজরুল কিভাবে ব্রিটিশ আমলে অবিভক্ত ভারতে এমন বাংলা শিখলেন। লবণ থেকে লাবণ্য, সেই থেকে কি লাবনী? দু’জন মানুষের জন্য একটি বেসিক ফোন। তাতে শুধু কথা বলা যায়। নাই সিরি, নাই গুগল। আমার জানা হলো না লাবনী শব্দের অর্থ।
এর মধ্যে বিকট শব্দে কানে তালা লাগলো। গানটা থেমে গেল। তখনও দেশে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। তখন হররোজ ট্রান্সফর্মার বিস্ফোরণ হতো আমাদের এলাকায়। ভাবলাম হয়ত ট্রান্সফরমারই বার্স্ট করল। একটু পরে গান শুরু হয়ে গেল। আমরা তখনও হেঁটে হেঁটে রমনা রেস্তোরাঁর দিকে এগুচ্ছি।
আমাদের ভাইবোনের বড় একটা দল তখন রমনার বটমূলের কাছে পৌঁছে গেছে। একটু পর পর কোনো ফোন বাজছে না। বাড়ি থেকে সদ্য খবর পেয়ে কেউ রিং করছে না। আমরা গন্তব্যে পৌঁছলাম স্বাচ্ছন্দ্যে। দশ মিনিট পর আরেকটি বিকট শব্দের পর গান থেমে গেল। তখনও মিষ্টি পানওয়ালা পান ফেরি করছে। হরেকরকম মসলায় তার পানের ডালাটা আমাজন লিলির মতো ফুটে আছে। ঠিক কি হয়েছে—কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়েও আমরা ঠিক জানি না।
হঠাৎ এক লোক এসে বলল, ‘সাতটা লাশ পড়ে আছে স্টেজের কাছে। রক্তে ভাজছে মাটি’। তখনও মৃত্যু এত সহজ ঘটনা ছিল না আমাদের জন্য। অকাল মৃত্যুর ঘটনায় থিতু হয় নাই মন। আমার এক ভাই ঝাড়ি দিয়ে বসলো লোকটাকে—‘ফাইজলামি করার জায়গা পান না। অযথা গুজব রটিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন’। লোকটা বলল, ‘বিশ্বাস না হলে দেখে আসেন।’ আমাদের ভাইয়েরা সাতপাঁচ না ভেবে দেখতে গেল ঘটনাস্থল।
ভদ্রলোক ফাজলামো করেন নাই। সত্যি লাশ পড়ে আছে। হঠাৎ মাইকিং করে আমাদের দ্রুত রমনা ত্যাগ করতো বলল। স্ক্রলবারে তখনও হয়তো কোনো সংবাদ নেই। লোকে কিছু না জেনে না বুঝে রমনা ত্যাগ করতে লাগল। আমরাও বাড়ি ফিরলাম। একটু আগেও ঝলমল করা লাবণী কেমন নিথর হয়ে ঢেকে গেল।
পুনশ্চঃ পরের বছরও রমনাপার্ক গিয়েছিলাম পহেলা বৈশাখে। বাঙালি এই মন বার বার মরে।
সবাইকে বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা।
নেপথ্য ঘটনা: ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল (বাংলা ১৪০৮ সনের ১ বৈশাখ) পয়লা বৈশাখের দিন ভোরে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানস্থলে দু’টি বোমা পুঁতে রাখা হয় এবং পরে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে তা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সকাল ৮টা ৫ মিনিটে একটি ও ১০-১৫ মিনিট পর আরেকটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। বোমা হামলায় প্রাণ হারান ১০ জন। আহত হন আরও অনেকেই।
১৩ বছর পর, ২০১৪ সালের ২৩ জুন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. রুহুল আমিন হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে মুফতি হান্নানসহ আটজনের মৃত্যুদণ্ড এবং ছয় জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
প্রসঙ্গত, অভিযুক্ত মুফতি আব্দুল হান্নানের ফাঁসি ২০১৭ সালের ১২ এপ্রিল রাতে কার্যকর হয়েছে। সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাই মামলা হতে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল।
লেখক: বেসরকারি কর্মকর্তা, গ্রামীণফোন
সারাবাংলা/আইই