বাঙালির জাতীয় উৎসব বাংলা নববর্ষ
১৩ এপ্রিল ২০২২ ২৩:৩১
বারো মাসে তের পার্বণ উদযাপনের জাতি বাঙালি। যদিও এ জাতির যাপিত জীবন প্রাচুর্যে ভরপুর ছিল তা বলা যাবে না। বরং কঠিন জীবন সংগ্রামে লিপ্ত বাংলার অধিকাংশ মানুষ দরিদ্রসীমার নীচেই বসবাস করতো। দু বেলা দু মুঠো অন্নের সংস্থানে উদয়াস্ত পরিশ্রমেই ব্যস্ত থাকতে হয়েছে বেশিরভাগ মানুষকে। এমন কঠিন জীবনের শ্বাসরূদ্ধকর চাপ থেকে মুক্তি পেতে, শত অভাব অনটনের মধ্যেও বাঙালি অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করে থেকেছে একটা পার্বণের জন্য। জীবনের কঠিনতম সংগ্রামের বিপরীতে আনন্দ উৎসবকে বিলাসিতা মনে হলেও সমস্যাক্লিষ্ট জীবনের কথা ভুলে হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠার পার্বণগুলোতে মানুষ আগামীর প্রাণশক্তি সঞ্চয়ে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছে। এক একটা উৎসব যেন গ্রীস্মের খরতাপদহের পর সুশীতল বারিধারার ন্যায়। উৎসবের ক্ষণস্থায়ী আনন্দ বাঙালির সংগ্রামী জীবনকে স্নিগ্ধ ও সজীব করে দিয়েছে।
যদিও আমাদের দেশে অনেকক্ষেত্রে উৎসব বলতে ধর্মীয় উৎসবই প্রাধান্য পেয়ে এসেছে কিন্তু আজো বাঙালি মুক্তির আনন্দ খোঁজে তার সর্বজনীন সামাজিক উৎসব আর পার্বণগুলোতে। আজ আমরা স্বাধীন। নিজেদের সংস্কৃতি চর্চার জন্য আজ আমাদের কারও অনুমতির অপেক্ষা করতে হয় না। কোনো বহিরাগত সংস্কৃতি পালনের বাধ্যবাধকতার আর চোখ রাঙানি সহ্য করতে হয় না। আর তাই বাঙালি আজ তাদের সাংস্কৃতিক চেতনার গভীরতা প্রকাশের পরিবেশ ও মানসিকতায় বাংলা নববর্ষকে পরিণত করতে পেরেছে তার জাতীয় উৎসবে।
এখানকার নববর্ষের অনুষ্ঠান উৎসবাদি কোনভাবেই ধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত নয়। কারণ আমাদের হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান ও খ্রিস্টান-অধ্যুষিত দেশ অথচ এখানে ধর্মের কোনো বিশেষ প্রভাব আমাদের নববর্ষের অনুষ্ঠান ও উৎসবে দেখা যায় না। পয়লা বৈশাখ কোনো লোকাচার ছাড়া ৪০০ বছরেরও অধিককাল আগে অর্থাৎ সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের পর কৃষি ও ঋতুর সঙ্গে অনেক অনুষ্ঠান যুক্ত হয়ে পড়ে।
মানুষ কোনো কিছু না করলেও প্রাকৃতিক নিয়মে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত হবে। দিন রাত্রি হবে। চাঁদের পূর্ণিমা ও অমাবস্যা হবে। ৭ দিনে সপ্তাহ, ৩০ দিনে মাস, ৩৬৫ দিনে বছর হবে। মানুষই তার চলার পথে জীবনে নানা অভিজ্ঞতার আলোকে এসব দিনক্ষণ বার-তিথি সপ্তাহ মাস বছরকে নানা তাৎপর্যমণ্ডিত করে সেগুলোর ওপর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য আরোপ করেছে। যাদের বর্ষপঞ্জি আছে তারা বছরের শেষ দিন ও প্রথম দিনকে অন্যান্য দিন থেকে আলাদাভাবে দেখে একটিকে বিদায় দেয় আর অপরটিকে বরণ করে।
ইংরেজ জাতির খ্রিস্টীয় সাল আছে এবং সেই অনুসারে তাদের পয়লা জানুয়ারি ও নিউ ইয়ার্স ডে পালিত হয়। আরব জাতির হিজরি সন আছে এবং সেই অনুসারে তাদের পয়লা বছর ও নওরোজ আছে। নতুন বছরকে বরণ করার রেওয়াজ সর্বত্রই চালু রয়েছে। নতুন বছর জাতির জীবনে নতুন সৌভাগ্য ও সম্ভাবনা বহন করে আনে। এরূপ প্রত্যাশা নিয়ে দিনটিকে বর্ণাঢ্য ও উৎসবমুখর করে পালন করা হয়।
আমরা জাতি হিসেবে সুগঠিত এ জন্য যে আমাদের নিজস্ব বর্ষপঞ্জি বাংলা সন ও আছে। বছরের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ আছে। আমরা পয়লা বৈশাখকে নববর্ষ দিবসরূপে উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে উদাযাপন করি। পাশ্চাত্যে খ্রিস্টান জগতে পয়লা জানুয়ারি পালিত হয় নববর্ষ। বর্তমানে পয়লা জানুয়ারি নববর্ষ পালন অনেকটা সর্বজনীন হয়ে উঠেছে শুধু পাশ্চত্যেই নয় প্রাচ্যেও। সম্প্রদায়গতভাবে মুসলমানদের নববর্ষ মোহররমের আশুরা থেকে। ইহুদিদের নববর্ষের নাম রাসহাসানা, ভিয়েতনামিদের নববর্ষকে বলা হয় তেত।
বাংলা নববর্ষ পালনের মূলে আছে কৃষি। আগে বছর গণনার ভিত্তি ছিল চন্দ্রকলা। পরে ফসল বোনা ও কাটা বা কৃষির কারণে চন্দ্র, সূর্য বা চন্দ্রসৌর বছরভিত্তিক গণনা শুরু হয়। এনামুল হক লিখেছেন, গোড়ায় নববর্ষ ছিল মানুষের আর্তিব উৎসব বা ঋতুধর্মী অনুষ্ঠান। ঋতুধর্মী বলে কৃষির সঙ্গেও এর সম্বন্ধ ছিল অতিঘনিষ্ঠ। কারণ কৃষিকাজ একটি ঋতুনির্ভর মানববিজ্ঞান। প্রকৃতির কাছে নতিস্বীকার নয়, ঋতুর পরিবর্তন থেকেই পালিত হতে থাকে নববর্ষ। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ও জাতির নববর্ষের মূল বৈশিষ্ট্য স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দ। পাশ্চাত্যে খ্রিস্টানরা নববর্ষের দিন গির্জায় প্রার্থনা করেন বটে কিন্তু ৩১ ডিসেম্বর রাত বারোটার পর থেকে মেতে ওঠেন আনন্দে। বলা হয় থর্টি ফার্স্ট নাইট। প্রাচ্যে জাপানি-ভিয়েতনামিদের নববর্ষ ও বেশ আনন্দের। ইরানে নওরোজ পালিত হয় প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে। এনামুল হক আরও লিখেছেন আগেরকার ঋতু পরিবর্তনকালীন স্বতঃফূর্ত নাচগান আমোদপ্রমোদ ও পানাহার জোরেসোরেই চালু রইলো বটে তবে তার সঙ্গে যে নতুন উদ্যোগ যুক্ত হলো তাকে বলা যায় বিশ্বাস অনুশাসিত অনুষ্ঠান। এর বড় উদাহরণ মুসলমানেরা তাদের নববর্ষ শুরু আশুরার বিষাদ নিয়ে। এক্ষেত্রেও মুসলমানেরা ব্যতিক্রম। কারণ পৃথিবীর কোনো দেশের বা জাতির নববর্ষ শুরু বিষাদ দিয়ে নয়। হয়ত নিয়তিবাদের প্রভাব। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, মক্কা মদিনা যখন পারস্যের প্রদেশ হিসেবে গণ্য তখন সেখানে পালিত হতো নববর্ষ। হজরত (সাঃ) মদিনায় হিজরতের দুবছর পর নওরোজ বাদ দিয়ে প্রবর্তন করেন ঈদ উৎসব। এবার হিজরি সন বাংলা ও খ্রিস্টাব্দ নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন।
সন আরবি শব্দ আর সাল হলো ফার্সি। যাযাবররা দিনের পর দিন রাতের পর রাত মরুভূমির পথে চলাফেরা করে। তাদের হাতে কোনো ক্যালেন্ডার থাকে না। দিন-তারিখের হিসাব রাখবে কীভাবে? সূর্য উঠলেই তো নতুন দিনের শুরু হবে। এভাবে ৩০ দিন গেলে সে বুঝতে পারবে এক মাস হয়ে গেল। কিন্তু সূর্যের দিকে তাকিয়ে হিসাব রাখা সহজ নয়। কারণ প্রতিদিন একইভাবে সূর্য ওঠে, সূর্য ডোবে। এর চেয়ে সহজ বুদ্ধি বরং চাঁদের দিকে নজর রাখা। কারণ চাঁদ একটু একটু করে বাড়তে থাকে। আবার একটু একটু করে কমতেও থাকে। চাঁদের বাড়াকে বলা হয় শুক্লপক্ষ। আর চাঁদের ক্ষয়ে যাওয়াকে বলে কৃষ্ণপক্ষ।
আগে যাযাবরেরা এভাবেই চাঁদের কলা বা তিথি দেখে দিন-মাসের হিসাব রাখত। তবে চাঁদের হিসাবে বছর হয় ৩৫৪ দিন ৯ ঘণ্টায়। সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘুরে আসতে সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৬ঘণ্টা। চাঁদের হিসাবে বছর ধরলে কিছু সমস্যাও আছে। যেমন কোনো ফসল বোনার জন্য উপযোগী সময়ের কথা আমরা ভাবি। সূর্য সারা বছর ধরে সব জায়গায় একভাবে তাপ দেয় না। আর পৃথিবীও কিন্তু নিজ অক্ষের ওপর একটু কাত হয়ে ঘোরে। ফলে একই জায়গায় বছরের কোনো সময়ে শীত তো অন্যান্য সময়ে গরম বেশি হয়। চাঁদের হিসাবে বছর ধরলে ঋতুর হিসাব এলোমেলো হয়ে যাবে। কারণ সৌরবর্ষের চেয়ে চান্দ্রবর্ষ ১১ দিন কম।
খ্রিস্টীয় সাল গণনা করা হয় সূর্যের হিসাবে। আবার হিজরি সাল গণনা করা হয় চাঁদের হিসাবে। প্রাচীন মিসরে, ব্যাবিলনে ও চীনে এই চান্দ্র মাসের হিসাবে বছর গণনা করা হতো। মুঘল সম্রাট আকবরের সময়েও রাজকাজে হিজরি সাল চালু ছিল ফলে কৃষি ফলনের সঙ্গে তা মিলত না। আকবর তাই সূর্যের বছরের সঙ্গে চাঁদের বছরের সমন্বয়ের কথা ভাবলেন। দায়িত্ব দিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজিকে (১৫৫৬ সাল বা ৯৯২ হিজরিতে)। বশ্য অনেকে বলে থাকেন, বাংলা সাল চালু হয়েছে রাজা শশাঙ্কের সময় (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯০ থেকে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দ) থেকে।
বাংলা মাসের নামকরণও চমকপ্রদ। ১২টি মাসের নাম নেয়া হয়েছে একেকটি নক্ষত্রের নাম থেকে। যেমন বৈশাখ মাসের নাম এসেছে বিশাখা নক্ষত্র থেকে। জ্যৈষ্ঠা নক্ষত্র থেকে জ্যেষ্ঠ। আষাঢ় ও শ্রাবণ মাসের নাম এসেছে উত্তর আষাঢ় ও শ্রাবণা নক্ষত্র থেকে। এ রকম ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ মাসের নাম এসেছে পূর্ব ভাদ্রপদ, অশ্বিনী, কৃত্তিকা আর মৃগশিরা নক্ষত্র থেকে। পুষ্যা, মঘা, উত্তর ফাগ্লুনী আর চিত্রা নক্ষত্র থেকে এসেছে শেষের চারটি মাসের নাম। এ রকম মোট ২৭টি নক্ষত্র আছে সৌরমণ্ডলে এবং এর বাইরে কিন্তু নক্ষত্রের শেষ নেই। তবে বাংলা পঞ্জিকায় ২৭টি নক্ষত্রকে বিশেষ বিবেচনায় রাখা হয়। ২৭ কেন? কারণ মোটামুটি ২৭ দিনে চাঁদের একটি চক্র শেষ হয়। পৃথিবী তো গোল, এর চারপাশে সব মিলিয়ে আছে ৩৬০ ডিগ্রি। এখন যদি একে ২৭ দিয়ে ভাগ করি তাহলে ১৩ ডিগ্রির কিছু বেশি জায়গা থাকে।
এবার ‘খ্রিস্টাব্দ’ শব্দটির শুরুর কথা আমরা অনেকেই জানতে চাই। তাই এর উৎপত্তির একটু ধারণা দেয়া দরকার। খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিস্টের জন্মের বছর থেকে যে বছর গণনা করা হয়, তাকেই খ্রিস্টাব্দ বলে। যিশুখ্রিস্টের জন্ম, জীবন, সেবাকাজ, মৃত্যু, পুনরুত্থান অবিস্মরণীয় করে রাখার জন্য সাধু গ্রেগরি নতুন এ বছরের গণনা শুরু করেছেন।
বর্তমান পৃথিবীতে এ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ও প্রচলিত। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে ইংরেজি বছর বলতে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। একেবারেই ভুল করে তা ব্যবহার করা হয়। অজ্ঞানতাবশত তা করছে প্রকৃত অর্থে ইং বলতে ইংরেজি নয় এটি ইসায়ি।
বাংলা নববর্ষ বাঙালির চিরন্তন ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় উৎসব আনন্দে মেতে ওঠার দিন। আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় গণমুখী উৎসব। নববর্ষ সেজন্যই আমাদের আর্থ-সামাজিক ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় বাঙালির ঐতিহ্যের অহংকার। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেকেও খ্রিস্টীয় সালের দিনক্ষণ মেনে চলতে হয়। তবুও বাঙালির ঐতিহ্যের শিকড়ে প্রোথিত বাংলা নববর্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। মহিমায় উজ্জ্বল। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বাংলা নববর্ষই দেশের সর্বজনীন বড় উৎসব।
কম্পিউটার, ইন্টারনেট ও ই-মেইলের আধুনিক এ যুগে এখনও দেশের ব্যবসায়ী সমাজ আড়ম্বরে শুভ হালখাতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। যাতে শুধু বর্ষ পরিক্রমার ইতিহাস নয়, বাঙালি জাতির স্বতন্ত্র বাংলা ভাষা সংস্কৃতি এবং আবহমান ঐতিহ্যের সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে সম্পৃক্ত এই দিনে আমাদের দেশের মানুষ পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার বন্ধনকে আরও গাঢ় করে তোলে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দোর্দণ্ড প্রতাপের মধ্যেও বাঙালির হৃদয়ের গভীরে সে চিত্রটি প্রতিনিয়ত দোলা দেয়, সেটি পয়লা বৈশাখ, একান্ত আপন ঠিকানা।
বাংলা নববর্ষ এমন একটি দিন, এর প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, এটি হিন্দু বা মুসলমান কিংবা বৌদ্ধের একক কোনো উৎসবের দিন নয়। এটির চরিত্র সর্বজনীন। এখানে আরেকটি বিষয় ও বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান। কিন্তু তাদের নববর্ষ আসুরা বা মুহরম থেকে শুরু নয়। তা বিষাদময়ও নয়। বলতে দ্বিধা নেই এ কারণেই বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ পালিত হয় স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে।
এখানকার নববর্ষের অনুষ্ঠান উৎসবাদি ধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত নয়। কারণ আমাদের হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান ও খ্রিস্টান অধ্যুষিত দেশ অথচ এখানে ধর্মের কোনো বিশেষ প্রভাব আমাদের নববর্ষের অনুষ্ঠান ও উৎসবে দেখা যায় না। পয়লা বৈশাখ কোনো লোকাচার ছাড়া চার শ’ বছরেরও অধিক কাল আগে অর্থাৎ সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের পর কৃষি ও ঋতুর সঙ্গে অনেক অনুষ্ঠান যুক্ত হয়ে পড়ে। এভাবেই আবর্তিত হয়ে পয়লা বৈশাখ রূপান্তরিত হয় নববর্ষে। আর সত্য বলতে কি বিগত শতকের ষাটের দশকে এভাবেই বাংলা নববর্ষ এক নতুন রাজনৈতিক মাত্রা লাভ করেছে। বাংলাদশে ছাড়া অন্য কোনো দেশে কোনো ঋতু এ রকম রাজনৈতিক ও সামাজিক মাত্রা লাভ করেছে বলে জানা নেই।
আবহমান কাল বাঙালির নববর্ষের উৎসব পূর্বসূরির জীবনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। নগরবাসীর জীবনে নববর্ষ দীর্ঘ কালব্যাপী ছিল উপেক্ষিত। এখানে আমাদের নাগরিক জীবনের কাজকর্ম, দেনাপাওনা ব্যবসা-বাণিজ্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত খ্রিস্টীয় সন তারিখ ধরে চলে।
বাঙালিয়ানার প্রতি আমাদের আন্তরিক আনুগত্যের কারণেই বাংলা নববর্ষ আমাদের প্রত্যেকের মনে ঐতিহ্য চেতনার রঙিন আলো ছড়িয়ে দিয়েছে। এই রূপান্তরের অর্থ পল্লিবাসীগণ নগরবাসীর জীবন যাপনের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। বাংলা নববর্ষ আমাদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতির নব আনন্দধারা যা নগরবাসীর চিত্তকেও আজ অনুরণিত করে।
নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নববর্ষের একাল সেকালের হিসেব কষলে দেখা যায় নববর্ষের সঙ্গে জড়িত হয়েছিল নানা আনুষাঙ্গিক বিষয়। এর কিছু লুপ্ত হয়ে গেছে কিছু আবার বিশেষ কিছু অঞ্চলে প্রচলিত রয়েছে। হালখাতা এখনও অটুট। কিন্তু প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে এমন একটি অনুষ্ঠান পুণ্যাহ। এর উদ্ভব কবে সে সম্পর্কে জোড়ালো তেমন কিছু জানা যায় না। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলুপ্তির পূর্ব পর্যন্ত তা বলবৎ ছিল। পুণ্যাহ যুক্ত ছিল নববর্ষের সঙ্গে। ওই দিন প্রজারা ভালো পোশাক পরে জমিদারের কাছারিতে যেতেন খাজনা কিংবা নজরানা দিতে। যেন পুণ্য কাজ করতে যাচ্ছেন। বলা যায় পুণ্য থেকে পুণ্যাহ।
আসলে আমাদের দেশের নববর্ষের মেলাগুলো ও প্রাচীন আর্তিব (ঋতুধর্মী) উৎসব ও কৃষ্যৎসব প্রভৃতির বিবর্তিত রূপ ব্যতীত আর কিছুই নয়। কারণ এগুলোতে এখন পর্যন্ত স্থানীয় কৃষি ও শিল্পজাত দ্রব্যাদির বেচাকেনা হয়। বাংলা নববর্ষ এখন আমাদের প্রধান জাতীয় উৎসব। ক্রমেই এ উৎসব বিপুল মানুষের অংশগ্রহণে বিশাল থেকে বিশালতর হয়ে উঠছে।
১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলার সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ সরকারকে বিপুলভাবে পরাজিত করে মুখ্যমন্ত্রী ও বাঙালিদের নেতা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সরকার বাংলা নববর্ষের ছুটি ঘোষণা করে এবং দেশবাসীকে নববর্ষের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। অবশ্য এ তাৎপর্যপূর্ণ বিজয় স্থায়িত্ব লাভ করেনি। যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দিয়ে এবং সামরিক শাসন জারি করে তা সাময়িকভাবে রুখে দিয়েছে স্বৈরাচারী পাকিস্তান সরকার। সরকারিভাবে আর নববর্ষ উদযাপিত হয়নি পাকিস্তান আমলে; কিন্তু প্রবল আগ্রহ ও গভীর উৎসাহ উদ্দীপনা বাঙালিদের বর্ষবরণ গণজোয়ারে রূপ নেয়। এরই মধ্যে সুপরিকল্পিত ও সুসংগঠিত হয়ে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ছায়ানট (১৯৬১) বর্ষপালনে উদ্যোগ গ্রহণ করে।
১৯৬৭ সাল থেকে রমনার বটমূলে (পাকুড়মূল) নববর্ষের যে উৎসব শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় বাধাহীন পরিবেশে জনসাধারণের অংশগ্রহণে জাতীয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়াও সারা দেশে যে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয় তা আবহমান বাঙালি ঐতিহ্যের স্মারক বহন করে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বংলা নববর্ষ ঘোষিত হয় সরকারি ছুটির দিন হিসেবে। এ সরকাররের আমলে বাংলা নববর্ষভাতা কিংবা বৈশাখিভাতা উৎসবপালনে নতুন মাত্রা যুক্ত করে দেয়। ধর্মীয় উৎসবভাতা স্ব-স্ব ধর্মের মানুষ শুধু তাদের ভিন্ন ভিন্ন পালা পার্বণে পেয়ে থাকে। কিন্তু নববর্ষভাতা জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একসঙ্গে প্রাপ্ত হয়, এ জন্য বাংলা নববর্ষবরণ উদযাপন আড়ম্বর পূর্ণ হয়ে ওঠে।
আমাদের সমাজ জীবনে তৃণমূল পর্যায়ের নববর্ষ পালনের সঙ্গে যুক্ত হয় শাহরিক প্রচেষ্টা। নববর্ষের দিন ঘটা করে পান্তা কালচারটিও নবতর সংযোজন, যা আমাদের সমাজজীবনে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুটি প্রভাবই প্রতীয়মান। নববর্ষের দিনে হঠাৎ করেই বাঙালি সাজার অভিপ্রায়ে মাটির পাত্রে পান্তা-ইলিশের আয়োজন তরুণ প্রজন্মের জন্য এক দুর্দমনীয় আকর্ষণ বটে। শাহরিক ফাস্টফুডের ভিড়ে, পান্তা-ইলিশ অন্তত বছরে একটি দিনের জন্য হলেও স্মরণ করিয়ে দেয় ‘একদিন বাঙালি ছিলাম রে’।
আবহমান বাঙালির কৃষি ও কৃষিকেন্দ্রিক গ্রামীণ জীবন যাত্রায় নিত্য আহার্য পান্তা জীবন ধারণের অন্যতম প্রধান খাদ্য। কিন্তু নববর্ষের দিনে ঘটা করে পান্তা-ইলিশের সমারোহ গ্রামীণ কৃষিজ ও কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনমানুষের প্রতি কটাক্ষের ইঙ্গিত বহন করে বৈকি। তবে বর্ষবরণে ও নির্মল আনন্দ খুঁজতে গিয়ে হয়ত পান্তা ইলিশের আয়োজন বিবর্তিত রূপ নিয়ে একদিন আচারেই পরিণত হবে।
আজকের স্বাধীন বাংলাদেশে নববর্ষ ধর্মনিরপেক্ষ অনুষ্ঠান হিসেবে তৃণমূল থেকে শাহরিক সব পর্যায়ে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়, একমাত্র খাঁটি বাঙালির উৎসব হিসেবে। অবশ্য সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানকে আখ্যায়িত করতে পারি পৃথিবীর এক বিরল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সেক্যুলার উৎসব হিসেবে।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই