ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা বিরুদ্ধে বাংলা নববর্ষ
১৩ এপ্রিল ২০২২ ২২:৩৫
করোনা মহামারির থাবায় গত দুইবছর বাংলা নববর্ষে ছিল না কোনো উৎসবের রঙ। ছিল না ঢাকের বাদ্য, ছিল না পান্তা-ইলিশের বাহার কিংবা হালখাতা খুলে মিষ্টিমুখ। গলি থেকে রাজপথ শূন্য। নিজেকে বৈশাখের রঙে রঙিন পোশাকে রাঙিয়ে তরুণ তরুণী, আবালবৃদ্ধবনিতা বা শিশুরা বের হয়নি। হয়নি মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন। করোনার সেই দুর্বিষহ সময় পেরিয়ে এসেছি আমরা। এবারে পহেলা বৈশাখে বর্ষ উদযাপন উপলক্ষে সরাদেশে আয়োজন কোনো ঘাটতি নেই। আর ঘরে বসে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতে হবে না। কারণ ইতোমধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ অনেকাংশেই কমে গেছে।
বাংলা নববর্ষ এলে মনে হয় আমাদের পূর্বপুরুষেরা বাঙালি ছিল। সেই সূত্র ধরেই তো আমরা বাঙালি পরিচয়ে বিশ্বের কাছে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে জীবন সংগ্রাম ও নিজস্ব সংস্কৃতির কথা তুলে ধরতে পারি। সাদা মনে কাদা নেই এমন সহজ সরল মানুষ হিসাবে বিশ্বের কাছে আমরা বাঙালি বেশ সুপরিচিত। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যপ্ত সারাবাংলা ভেসে উঠছে আনন্দের উচ্ছাসে। ধর্ম-বর্ণ, শ্রেণি-পেশা, বয়স নির্বিশেষ সব মানুষ সামিল হয় বৈশাখী উৎসবে। সব ভেদাভেদ ভুলে বাঙালি হওয়ার প্রেরণায় দীপ্ত বাঙালি বরণ করে পহেলা বৈশাখ। কোলাহল পূর্ণ শহরের যান্ত্রিকতা ছেড়ে প্রকৃতির সান্নিধ্য লাভ করার জন্য অনেকে গ্রামে মানুষ পহেলা বৈশাখ উৎযাপন করেন।
বিশেষ করে গ্রামের হাট-বাজারে বসে বৈশাখী মেলা। আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের মিলনকেন্দ্র এইসব বৈশাখী মেলা। এখানে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে সবাই মিলে আনন্দ-উল্লাস করে পহেলা বৈশাখের দিনটিকে উদযাপন করেন। মেলা থেকে মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা, সন্দেশ, মিষ্টি কিনে খাওয়া, নাগরদোলায় চড়া, লাঠিখেলা দেখা, বায়স্কোপ দেখা, সাপুড়েদের সাপ খেলা, বানরের খেলা আর ষাঁড়ের লড়াই উপভোগ করে পহেলা বৈশাখের দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখা যায় বৈশাখী মেলায়।
বাঙালি কেন এই পহেলা বৈশাখ পালন করে? ইতিহাস বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, হালখাতা থেকে পহেলা বৈশাখ। সম্রাট আকবরের সময় থেকে ‘পহেলা বৈশাখ’ উদযাপন শুরু হয়। কিন্তু তখনকার পহেলা বৈশাখ উদযাপন এখনকার মতো ছিল না। তখনকার পহেলা বৈশাখ পালনে ভিন্নতা ছিল। যেমন, বছর শুরুর আগের দিনে, অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যেই সকলকে সকল প্রকার খাজনা-মাশুল-শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। আর পরের দিন, অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা, অর্থাৎ জমিদাররা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। খাজনা পরিশোধ করা উপলক্ষে বিভিন্ন উৎসবেরও আয়োজন করা হতো। কালের পরিক্রমা সেটি বাঙালির সার্বজনীন উৎসবে পরিনত হয়েছে।
চৈত্র মাসে শৈশবের কথাগুলো স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। পাড়ার ছেলে-মেয়েদের সাথে প্রচণ্ড গরমে দৌঁড়ে পুকুরে গোসল করা। গোসল শেষে বাড়িতে এসে মায়ের হাতের রান্না মজায় অন্যরকম মধুর। যেমন শুটকি মাছের সাথে কাঁচা মরিচের ভর্তা, পান্তাভাত আর ভিন্ন প্রকারের শাক ভাজি দিয়ে পেট ভরে খেয়ে নিতাম। তারপর মেলায় যাওয়া হতো। সেখানে বাহারি রঙের দোকানে পাওয়া যেত রংবেরঙের খেলনার জিনিস। মেলায় বসতো লোকসঙ্গীতের আসর। যা উত্তরবঙ্গের প্রকৃতি ও মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভাওয়াইয়া সঙ্গীতধারা। আমি বাল্যকালে গ্রামের সুন্দরখাতা শান্তিনিকেতন স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তাম। তখন আমাদের স্কুলে প্রথম পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল। জীবনের প্রথম শতশত মানুষের ভীড়ের মধ্যে, ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে’ গান গাইতে শুরু করি কিন্তু হঠাৎ তিন লাইন গাওয়ার পর পরের লাইন ভুলে যাই। জীবনের প্রথম এত বড় লজ্জা কোথাও পাইনি ফলে জিব্বায় কামড় দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন সামনে বসা দর্শকেরা পরবর্তী লাইন গাইতে শুরু করেন। তাদের সাথে আমিও গান গাইছে শুরু করি।
লোকসঙ্গীতের প্রবাদপুরুষ আব্বাস উদ্দীনের গান গ্রাম বাংলার পথে প্রান্তরে মানুষের অন্তরে বাজে। যা হৃদয় জুড়িয়ে প্রশান্তি আনে। ভাওয়াইয়া গান মানেই ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতীক সেই ‘গরুর গাড়ি’ এবং ‘গাড়িয়াল ভাই’। কিন্তু দুঃখের বিষয় তা কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে। আরও উদ্বিগ্ন হতে হয় যখন বাঙালি তার নিজস্ব সংস্কৃতি পালন করতে গিয়েও বাঁধার মুখে পড়তে হয়। যার ফলাফল হিসাবে আমরা দেখেছি, ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল তারিখ ছিল বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন; বাংলা ১৪০৮ সনের পহেলা বৈশাখ। প্রতি বছরের মতো সেবারও রমনার বটমূলে ছায়ানট কর্তৃক ঐতিহ্যবাহী বাংলা বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ অনুষ্ঠানে গানের অনুষ্ঠান চলাকালীন বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ঘটনাস্থলে ৯ জন সাংস্কৃতিক কর্মী ও দর্শক প্রাণ হারানোর পাশাপাশি আহত হন আরো অগণিত মানুষ। কিন্তু তারপরও বাঙালি জাতি থেমে যায়নি ধর্মান্ধগোষ্ঠীর চোখে আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়ে মঙ্গলশোভা যাত্রার লোকের জমায়েত।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশ- আজকাল এ কথা বলতে খুব কষ্ট পেতে হয়। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা দেশ বললে ভুল হবে না। কারণ চৈত্র মাসের শেষ যখন বাংলাদেশের মানুষের সার্বজনীন বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালন করব। ঠিক তখনি দেশের মধ্যে একের পর এক সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটেই চলছে। টিপ-বিতর্ক, বিজ্ঞান শিক্ষকের নামে ধর্মীয় অবমাননা তুলে কারাগারে পাঠানো, হিজাবের নামে শিক্ষিকাকে হেনস্তা করা, মাঝে মাঝে জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত বিতর্ক, গণপরিবহনে নারী কোন পোশাক পরবে, নারীদের বেলায় কঠোর ধর্মীয় অনুশাসন করতে হবে ইত্যাদি ঘটনা দেখে অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষদের উদ্বিগ্ন হতে হচ্ছে। বাঙালির একমাত্র জাতীয় উৎসব নববর্ষের অনুষ্ঠানমালা পবিত্র রমজান মাসে হবে কী না, সেই সংশয়ে থাকতে হয় আজকাল! সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও কিছু চ্যানেলে ছায়ানটের বর্ষবরণের প্রস্তুতি পর্ব যখন দেখাচ্ছে তখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই প্রতিবেদনের নীচের মন্তব্য দেখে মনে হবে খোদ পাকিস্তান আমলেও মানুষ বুঝি এতটা ধর্মান্ধ ছিল না।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর বাংলাদেশ কোন পথে? সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে ধর্মান্ধতা তৈরী হচ্ছে ভবিষ্যৎতে কী বাঙালি পহেলা বৈশাখ উদযাপন করতে পারবে? আমরা নেতাদের মুখের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফুলঝুরি শুনতে পাই। দেশ না কী অসাম্প্রদায়িক, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় পরিচালিত হচ্ছে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে দেশের আনাচকানাচে যাত্রাপালা, বাউলগান, পালাগানের জন্য প্রশাসনের জন্য কেন অনুমতি নিতে হবে? আবার অনেক সময় নিরাপত্তার অজুহাত দিয়ে অনুমতি দেওয়া হয় না। হেফাজতের কথা শুনে প্রগতিশীল লেখকের লেখা কেন বাদ দেওয়া হয়েছে? তাহলে কী ধরেই নিবো রাষ্ট্র ধর্মান্ধতা অর্থাৎ জঙ্গীদের ভয় পায়! না কী ক্ষমতার সুরক্ষার জন্য আপসকামিতার মাধ্যমে দেশের সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়েছে।
খুব কষ্ট হয় যখন দেখি ধর্মান্ধরা ধর্মকে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থপূরণ করে। আর সমাজে তাদের এই অন্যায় আবদার দাবি সব মেনে নেওয়া হচ্ছে ধর্মের নামে। ক্লাসে ৬ষ্ঠ শ্রেণির এক শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বলো তো পহেলা বৈশাখ কাদের উৎসব?’ শিক্ষার্থী অকপটেই উত্তর দিলো, ‘স্যার, পহেলা বৈশাখ হিন্দুদের উৎসব।’ আমি চুপ থেকে তাকে বললাম, ‘কিভাবে জানলে পহেলা বৈশাখ হিন্দু ধর্মের উৎসব?’ সে বলল, ‘স্যার আমি বাবার ফোনে একজন ইসলামি বক্তার বক্তব্যে শুনেছি যে পহেলা বৈশাখ মুসলমানদের পালন করা হারাম।’ সমাজে প্রতিটি স্তরে নতুন প্রজন্মের কাছে সাম্প্রদায়িক যে বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তাতে নতুন প্রজন্ম কেমন প্রত্যাশা করি আমরা? বাঙালির সংস্কৃতিকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে শুধু ধর্মীয় উসকানিমূলক জলসাকে নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের দল ক্ষমতায় তারপরও কেন ধর্মান্ধতাদের চাষ করা হচ্ছে?
‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা…’ -গানটি সত্যি বাস্তবে পরিণত হবে যখন বাঙালিরা নির্ভয়ে নববর্ষ উদযাপন করতে পারবে। মানুষ মুক্তবুদ্ধির চর্চা করতে পারবে। বাংলার সংস্কৃতি চর্চায় কোনো বাঁধা পাবে না। মঙ্গল শোভাযাত্রা করতে পারবে। নারীরা শুধু কপালের টিপ নয়, যে কোনো পোশাক পরার স্বাধীনতা পাবে। গ্রামীণ জনপদের আবারও যাত্রাপালা, বাউল, জারি-সারি, বিভিন্ন উৎসব-পার্বণ, মেলা ও লোক ঐতিহ্যের সঙ্গে বাঙালির ঋতুভিত্তিক উৎসবে মেতে ওঠবে। তাই বাংলা নববর্ষ উৎসবকে পরিপূর্ণতা দিতে রাষ্ট্রের উচিত ধর্মান্ধতা মৌলবাদী গোষ্ঠীর কাছে আপোসকামিতা বন্ধ করা। দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের কৌশল করে পাঠ্যপুস্তকে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রচার ও প্রসার করতে হবে। তাহলেই বাঙালি বলতে পারবে ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।তাপসনিশ্বাসবায়ে; মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।’ শিল্পীরা রং-তুলি ক্যানভাসে হৃদয়ের কথার ছবি আঁকুক। এবারে বৈশাখে অশ্রুবাষ্প ধুয়ে মুছে যাক, মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হোক। চৌদ্দশত ঊনত্রিশ বাংলা নববর্ষের অঙ্গিকার হোক দূর্নীতি মুক্ত দেশ হোক এবং রাজনীতির আবর্জনা দূর হয়ে যাক।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
ধর্মান্ধতা রাশেদুজ্জামান রাশেদ সাম্প্রদায়িকতা বিরুদ্ধে বাংলা নববর্ষ