সাম্প্রদায়িকতার জাল ছিঁড়তে না পারলে অশনি সংকেত
১৪ এপ্রিল ২০২২ ১৫:৩০
দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িক উদ্দেশ্যবাজরা ইদানিং খুব তৎপর হয়ে উঠেছে। চলমান সময়ে পত্রিকা থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত হচ্ছে তিনটি বিষয়। তেজগাঁও কলেজ শিক্ষিকা টিপ পড়ায় পুলিশি হেনস্থা; মুন্সিগঞ্জে বিজ্ঞান শিক্ষক ক্লাসে বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে ধর্ম অবমাননা; নওগাঁয় হিজাব পরে আসায় শিক্ষিকা ছাত্রীদের নির্যাতনের অভিযোগ। লক্ষ্য করলেই বুঝা যায় তিনটি ঘটনা একই সুতোয় গাঁথা। তিনজনই বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় সংখ্যালঘু অর্থাৎ সংখ্যাল্প। তিনটি ঘটনার ভুক্তভোগীর বিপরীতে যাদের অবস্থান তারা সংখ্যাগুরু অর্থাৎ সংখ্যায় বেশি। এটা স্পষ্টভাবে বোধগম্য যে ঘটনাগুলো সাম্প্রদায়িকতা উস্কানির বহিঃপ্রকাশ।
তেজগাঁও কলেজের শিক্ষক লতা সমাদ্দার টিপ পরে রাস্তায় চলার সময় দায়িত্বরত পুলিশ বলে ‘টিপ পরছস কেন’ বলেই বাজে গালিগালাজ করে যা লতার ভাষ্যমতে নিজের স্বামীকেও বলার মতো না। পুলিশ দাঁড়িওয়ালা, অতি অনুভূতিসম্পন্ন মুসলিম। ফলে অনুভূতির হালফ্যাশন মোতাবেক কারো কপালে টিপ দেখলে তার আঘাত লাগে! অকথ্যভাষায় গালিগালাজ করা তার নৈতিক দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়! এমনকি টিপ যারা পরে তারা বেশ্যা! এমন অনেক স্ট্যাটাস, ভিডিওবার্তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আজকাল ভাসে। তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়ার পরেও মসজিদের ইমাম পুলিশের পক্ষ নিয়ে ঘটনার আসল বর্ণনার বিপরীতে বানোয়াটভাবে উপস্থাপন করে, টিপ পরা হারাম, টিপ পড়ে হিন্দুরা ইত্যাদি উস্কানিমূলক সাম্প্রদায়িকতার বাহবা দেওয়ার ভিডিও মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশের কোন সংবিধানে, কোন আইনে লেখা আছে যে একজন নারী টিপ পরতে পারবে না? এখানে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, এমনকি অবিবাহিত অথবা বিধবাসহ সকল নারী যুগ যুগ ধরে টিপ পরে আসছে। টিপ ভারতবর্ষ তথা আমাদের বাঙালি সংস্কৃতি। শুধু টিপ নয় বাংলার সংস্কৃতির উপর সাম্প্রদায়িকতার জাল বুনে দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।
মুন্সিগঞ্জে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে গ্রেপ্তার করে জেলে রাখা হয়েছিল ক্লাসে বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে। একজন বিজ্ঞান শিক্ষক ক্লাসে বিজ্ঞান পড়াবেন, এটাই স্বাভাবিক বিষয়। জীবন ও জগতের নিয়ম জানা ও শেখানো বিজ্ঞান শিক্ষকের কাজ। বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারের মধ্য দিয়েই যুক্তিবাদী মন গড়ে তুলে মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক, কুপমণ্ডক ধ্যান ধারণার অবসান ঘটানো সম্ভব। কেবলমাত্র এভাবেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে সত্যানুসন্ধানী মন এবং যুক্তিগ্রহণ ও ভুল চিন্তা বর্জন করে আধুনিক মনন গড়ে তোলা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা মোটেও সেই উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে না। ক্রমেই পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ হচ্ছে, বাদ দেওয়া হচ্ছে অসাম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন সকল লেখকের লেখা। হৃদয় মন্ডলের স্ত্রীর কথামতে তার ছেলে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বিজ্ঞান ক্লাসে ধর্ম আর বিজ্ঞানের তর্ক তুলে উদ্দেশ্যমূলকভাবে রেকর্ড করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হৃদয় মন্ডল ভালো মানের বিজ্ঞান শিক্ষক। তাকে ফাঁসানোর জন্য সাম্প্রদায়িকতার জাল তৈরি করা হয়েছে। তার প্রমান একের পরে এক গণমাধ্যমগুলোর প্রতিবেদনে উঠে আসছে। বিজ্ঞানশিক্ষা আর ধর্মবিশ্বাসের দ্বৈরথ বহু পুরনো। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এই দ্বৈরথকে যে জাতি আশ্রয়-প্রশ্রয় না দিয়ে যুক্তিকে সামনে রেখে এগিয়েছে, তারাই উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছেছে।
নওগাঁয় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদ নেওয়ার জন্য ২২ বছর ধরে কর্মরত শিক্ষিকা আমোদিনী পালকেও সাম্প্রদায়িকতার জালে আটকানোর অপচেষ্টা চলেছে। আমোদিনী পাল ও আরেকজন শিক্ষক সেদিন শিক্ষার্থীদের শাসন করেছিল স্কুলড্রেসের কারণে। ঐ শিক্ষকের নামে কোনো অভিযোগ ওঠেনি। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ড্রেস পরে না আসলে শাস্তি পেতে হয়। স্কুলে পড়ার সময় এসেম্বলিতে স্যারেরা দেখতো কে ইউনিফর্ম পরে আসেনি। ইউনিফর্ম পরে না আসলে পেটাতো। কলেজে গিয়েও তাই দেখেছি। কারণ ইউনিফর্ম পরে আসা স্কুলের সংবিধানের অংশ। নওগাঁর দাউল বারবাকপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের অনেকবার বলার পরেও স্কুলড্রেস না পড়ে হিজাব পরলো কেন? নিশ্চয়ই উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মতলববাজেরা ছাত্রীদের ব্যবহার করে হিজাবকে কাজে লাগিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি করে নিজ স্বার্থ হাসিল করতে চায়।
টিপ পরায় পুলিশি ইভটিজিং, বিজ্ঞান বোঝাতে গিয়ে ধর্ম অবমাননা, স্কুলড্রেসের জন্য শাসন করায় হিজাব টেনে এসে হেয়-প্রতিপন্ন! এসবই একই ফর্মুলায় সিদ্ধ। আর তা হলো সাম্প্রদায়িক বিষ ছিটিয়ে বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদের মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িকতাকে হত্যা করার চেষ্টা। বৃটিশরা ভারবর্ষে এসে সেই চেষ্টা চালিয়ে প্রায় দুইশত বছর শাসন করে শৃঙ্খল ভেঙে দিয়ে বৃহত্তর ভারতবর্ষকে টুকরো টুকরো করে দিয়ে গেছে।
দেশের রাজনীতিতেও দিনে দিনে সাম্প্রদায়িক চর্চা বেড়ে চলেছে যা খুবই হতাশাজনক। দাবি করা প্রাচীন অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ধর্মভিত্তিক সংগঠনগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে রমজানকে স্বাগত জানিয়ে মিছিল শোভাযাত্রা করেছে। কখনো তো দুর্গাপূজা, বৌদ্ধ পূর্ণিমা ও খ্রীস্টানদের বড় দিনকে স্বাগত জানিয়ে কখনো মিছিল শোভাযাত্রা করেনি। ছাত্রলীগের এমন কর্মসূচি পালনের মধ্যদিয়ে দেশে নতুন করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্ম দিচ্ছে না তো? টিএসসির পাশে মসজিদ থাকার পরেও টিএসসিতে মসজিদ নির্মাণ করার দাবি তুলেছে একপক্ষ। এসব দাবি কিসের ইঙ্গিত বহন করে?
সাম্প্রদায়িকতার বিপদকে রুখতে হলে অসাম্প্রদায়িকতার চর্চাকে জোরদার করতে হবে। বই পড়ে, শিক্ষা নিয়ে; সেই শিক্ষায় মানুষ জীবনযাপন করে। পাঠ্যবই থেকে সাম্প্রদায়িক লেখা মুছে ফেলে অসাম্প্রদায়িক লেখকের লেখা ছাপাতে হবে। একটি স্বাধীন দেশকে টিকিয়ে রাখতে হলে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার বিকল্প নেই। অসাম্প্রদায়িক চেতনা হলো এমন একটি বিষয় বা আদর্শিক ভাবাদর্শ, যেটি দেশ-কাল-পাত্রভেদে পারস্পরিক সৌহার্দ্য, ঐক্য, শ্রদ্ধা এবং সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করে। ধর্মনিরপেক্ষ একটি সমাজব্যবস্থার অন্যতম চালিকাশক্তি হিসাবে কাজ করে অসাম্প্রদায়িকতা। অসাম্প্রদায়িক চেতনা উদার সংস্কৃতিকে ধারণ করে, যার মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের মানুষরা পারস্পরিক সম্প্রীতি ও শ্রদ্ধার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনার সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার এক নিবিড় বন্ধন রয়েছে। স্বাধীনতার একান্ন বছর পার করে আমরা সেই বন্ধনে পৌঁছাতে পেরেছি কি? ধর্মকে ব্যবহার করে যারা ফায়দা লুটতে চায়, তাদেরকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সঙ্গে যারা জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে গড়িমসি কেন?
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এএসজি
জাফর হোসেন জাকির মুক্তমত সাম্প্রদায়িকতার জাল ছিঁড়তে না পারলে অশনি সংকেত