ইদযাত্রার ভোগান্তি থেকে মানুষ কবে মুক্তি পাবে?
২১ এপ্রিল ২০২২ ১৯:০১
মুসলিমদের জন্য সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হচ্ছে ঈদুল ফিতর। ঈদ মানে আনন্দ, খুশি। আর সেই আনন্দ ভাগাভাগি করতে পরিবারের পাশে থাকতে চায় সকলে। যারা দূরে থাকেন তারাও শহর-নগর ছেড়ে শিকড়ের টানে পরিবারের কাছে ছোটে। এটি এক চিরায়ত দৃশ্য। অন্তত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এমনটা হয়ে থাকে সবসময়। বলা যায় এদেশের মানুষের আবেগ, ভালোবাসা, টান এসব বেশিই।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ইচ্ছা করলেই এই বাড়ি ফেরা কিংবা পরিবারের কাছে ফেরাটা স্বস্তির সাথে হয় না। ঈদপূর্ব যাত্রায় সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশপথে চলাচল নির্বিঘœ থাকে না। বিশেষ করে সড়কপথে যাতায়াতে চরম ভোগান্তির শিকার হতে সাধারণ মানুষের। এবার সেই অবস্থা যে আরো কঠিনতর হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর অবশ্য একটা বড় কারণও আছে। করোনার কারণে গত দুই বছর বাংলাদেশের মানুষের কাছে ঈদ অনেকটা অখুশিতেই কেটেছে। অনেকেই পরিবারের কাছেও যেতে পারেননি। অনেকে নিজ থেকেই যাননি। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখার কারণে গত দুবছরের ঈদ আনন্দ থেকে বিরত থাকা মানুষগুলো এ বছর ফিরবেন পরিবারের কাছে। একসাথে উদযাপন করবেন ঈদ আনন্দ। যেহেতু যানবাহন চলাচলে নেই কোনো বিধিনিষেধ তাই এবারের ঈদযাত্রায় মানুষের ঢল নামবে এমনটাই সন্দেহ করছেন অনেকেই।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, দেশের চারটি প্রধান মহাসড়কে এখনো শৃঙ্খলা ফিরেনি। সড়ক দুর্ঘটনা এখনও এসকল সড়কের নিয়মিত বিষয়। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে ট্রাফিক পুলিশরাও দায়িত্ব পালনে হিমশিম খায়। সে ক্ষেত্রে ঈদযাত্রায় যান চলাচল স্বাভাবিক রাখা তাদের পক্ষে কতটা সম্ভব সেটাও ভাবার বিষয়।
ধারণা করা হচ্ছে এবারের ঈদে যাত্রীদের বড় অংশ যানবাহনের সংকটে পড়বে। এর সঙ্গে যোগ হবে পথের ভোগান্তি ও দুর্ঘটনার ঝুঁকি। এর সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে মহাসড়কগুলো এই ভার বহন করার জন্য মোটেও প্রস্তুত নয়। ঈদযাত্রা নির্বিঘœ করতে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর ২০ এপ্রিলের মধ্যে সব মহাসড়ক চলাচলের উপযোগী করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু হতাশার খবর, ১৫ এপ্রিলের মধ্যে রাস্তা মেরামতের নির্দেশ দেওয়া হলেও তা আদৌ বাস্তবায়ন হয়নি। এ ছাড়া ঈদের সময় অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশায় ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো হাইওয়েতে চলাচল করে। সঙ্গে যোগ হয় অতিরিক্ত গাড়ির চাপ। যার ফলে সৃষ্টি হতে পারে বড় ধরনের যানজট। এতে ঘর ফেরা মানুষের ভোগান্তি উঠবে চরমে। যানজটে নাকাল হয়ে ছয় ঘণ্টার পথ ১০ থেকে ১২ ঘণ্টায়ও পৌঁছা যায় না অনেক সময়।
বলাবাহুল্য, বিগত দুবছর করোনা মহামারির কারণে অনেকেই নিজ পরিবার পরিজনের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে দেশে যেতে পারেননি। এবার করোনার প্রকোপ না থাকায় অনেকেই ঈদ করতে গ্রামমুখী। কিন্তু সড়কপথে বলুন আর রেলপথেই বলুন অথবা পানি বা আকাশপথ সব পথেই রয়েছে নানা বিড়ম্বনা। আকাশপথে ভ্রমণের সক্ষমতা অনেকেরই নেই। যাদের আছে তারা হয়তো নির্বিঘ্নে যাতায়াত করবেন। কিন্তু পানিপথে আর সড়কপথে মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাদাগাদি করে গন্তব্যে পৌঁছাবার এই চেষ্টা এদেশের মানুষের আর কতকাল করে যেতে হবে সেটাই প্রশ্ন।
ঈদযাত্রায় প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা, সড়কের বেহাল দশা, দীর্ঘ যানজট, টিকিট কালোবাজারি, নিয়ন্ত্রণহীন ভাড়া বৃদ্ধি, ছিনতাই-ডাকাতি ও চাঁদাবাজি, জালনোট, সড়ক ও নৌপথে দুর্ঘটনা এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণে সড়ক অবরোধসহ বিভিন্ন ঘটনায় জনদুর্ভোগ যখন চরমে ওঠে, তখন ঘরমুখো মানুষের মনে হতাশা জন্ম নেয়।
অতীতের ঘটনা থেকে প্রমাণিত, দেশের কোনো পথই ঘরমুখো মানুষের ঈদযাত্রার জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। সড়কপথ, নৌপথ, রেলপথ ঈদের আগে সবখানেই পোহাতে হয় ভোগান্তি।
এছাড়া ঈদযাত্রায় মৃত্যুর মিছিল তো আছেই। শুধু গত বছরের ঈদযাত্রায় সড়ক দৃর্ঘটনার পরিসংখ্যান তুলে ধরলে অনেকের চোখ কপালে উঠবে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুযায়ি, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দূরপাল্লার গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও পবিত্র ঈদুল ফিতরের যাতায়াতে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ৩১৮টি দুর্ঘটনায় ৩২৩ জন নিহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় ৬২২ জন আহত হয়েছেন। সড়ক, রেল ও নৌপথে সম্মিলিতভাবে ৩২৩টি দুর্ঘটনায় ৩৩১ জন নিহত এবং ৭২২ জন আহত হয়েছে।
এছাড়াও ঈদে ঘরে ফেরা যাত্রীদের ক্ষতি করতে বিভিন্ন চক্র ওঁৎ পেতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এসব চক্রের সঙ্গে পরিবহন কর্মচারীদের যোগসাজশও থাকে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে উৎসব-পার্বণে যাত্রী ও ক্রেতাকে বিশেষ ছাড় দেওয়া হলেও আমাদের দেশে হয় উল্টো। প্রায় সব পরিবহনেই টিকেটের দাম বৃদ্ধি করা হয়। যাত্রীর কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়, যা সত্যি দুঃখজনক।
ঈদ উপলক্ষে স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে যে কয়েকগুণ বেশি মানুষ চলাচল করে, তাদের নিরাপত্তা নিয়ে কর্তৃপক্ষ আদৌ কতটা গুরুত্ব দেন সেটা নিয়েও আমার প্রশ্ন আছে। ঈদের আগে কিছু ট্রেনের বগি বাড়িয়ে, সড়কে লোক-দেখানো কাজ করেই তারা দায়িত্ব শেষ করে দেন। ফলে ঈদযাত্রায় সাধারণ মানুষজন শুধু দুর্ভোগেরই শিকার হয় না, বহু পরিবারে ঈদের আনন্দ বিষাদেও পরিণত হয়। প্রকৃতপক্ষে ঈদের সময় বর্ধিত বিপুলসংখ্যক যাত্রীর চলাচল সামাল দিতে প্রয়োজন টেকসই ও কার্যকর পদক্ষেপ। কিন্তু এরূপ পদক্ষেপ কখনও দেখেনি দেশের মানুষ, আর দেখবে বলেও বিশ্বাস করতে পারছে না তারা।
এরপরও সাধারণ মানুষ চায় তাদের ঈদযাত্রা যেন নির্বিঘœ হোক। স্বস্তিতে, নিরাপদে মানুষ আপনজনের কাছে ফিরতে চায়। ঈদ শেষে আবার স্বস্তিতে কর্মক্ষেত্রে ফিরে আসতে চায়। এই নিশ্চয়তা তাদের এখনও দিতে পারছে না প্রশাসন। এটাই বড় দুঃখের বিষয়।
পরিশেষে বলতে চাই, ঈদের আনন্দ হোক সবার জন্য। প্রশাসনের নিকট প্রত্যাশা ঈদের আনন্দ যেন বিষাদে রূপ না নেয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়াও আমাদের সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে আমাদেরকেও সচেতন হতে হবে। মনে রাখতে হবে জনসচেতনতাই পারে এগিয়ে নিয়ে যেতে। ঈদযাত্রায় সকলের জন্য রইলো দোয়া।
লেখক : শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
আজহার মাহমুদ ঈদযাত্রার ভোগান্তি থেকে দেশের মানুষ মুক্তি পাবে কবে? মুক্তমত