স্বাধীনতা তুমি, পাওয়া না পাওয়ার যোগফল
২৩ এপ্রিল ২০২২ ১৬:৩০
‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই,আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি, ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি, আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে। দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়’ (রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্)।
মার্চ মাস শেষ হলো এই তো কিছুদিন। মার্চ মাস স্বাধীনতার মাস। এবারের এই মার্চ মাস আমাদের কতোটুকু স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছে তা উপলব্ধির বিষয়। ২৬ শে মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গৌরবময় ও পবিত্রম দিন। প্রতিবছর নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এই দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এবছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দিবসটিতে ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। সর্বস্তরের লাখো মানুষের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত হন জাতির শ্রেষ্ঠসন্তানেরা। এদিন বৈষম্যহীন একটি সমাজের প্রত্যাশায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের গভীরভাবে স্মরণ করে পুরো জাতি।
আমাদের এই স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে রয়েছে এক বিরাট ইতিহাস। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। প্রায় হাজার মাইলের দূরত্ব, ভাষা ও সংস্কৃতিসহ সকল ক্ষেত্রে অমিল থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র ধর্মীয় মিল থাকার কারণে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের একটি প্রদেশ করা হয়। তবে নতুন এ রাষ্ট্র বাংলার জনগনের জীবনে মু্ক্তির স্বাদ আনতে পারেনি। ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন থেকেই ১৯৪৭ সালে যে দেশ গঠিত হয়েছিল, মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে তার কেন মৃত্যু হলো? কেন বাঙালী স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন শুরু করে দিল? তা নিয়ে আজো বিভিন্ন গবেষণা, তর্ক-বিতর্ক চলছে।
বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসনামলের দিকে। পর্যালোচনা করতে হবে সেই ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস। পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালি ছিল শোষিত, অত্যাচারিত ও সকল ক্ষেত্রে উপেক্ষিত। দেশের অর্থসম্পদ, চাকরির সুযোগ-সুবিধা, শিক্ষা-দীক্ষা সকলক্ষেত্রেই বাঙালী বঞ্চনার শিকার হয়। তাদের কৃপার পাত্রে পরিণত হয়। প্রথমত, পাকিস্তানের ৫৬ ভাগ মানুষের ভাষা বাংলা হলেও বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেয়নি তারা। বাঙালীর মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে তাদের চিরদিনের মতো দাস করে দেয়ার এক গভীর ষড়যন্ত্রের পায়তারা করতে থাকে। এবার আসি অর্থনৈতিক বৈষম্যের দিকে। পূর্ব পাকিস্তান বৈদেশিক মুদ্রা বেশি আয় করলেও কখনোই শতকরা ২১ ভাগের বেশি অর্থ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়নি। বৈদেশিক সাহায্যের শতকরা ৩৪ শতাংশ পেত বাঙালীরা। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানি শাসনামলে রপ্তানি আয়ের ২০০০ মিলিয়ন ডলার পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হয়েছিল।
আমার এখনো মনে পড়ে যখন আমি অষ্টম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয় বইটা পড়েছি সেখানে পূর্ব বাংলা ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের বৈষম্যকে এইভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে যে, একটা গরু পূর্ব বাংলায় (আজকের বাংলাদেশে) ঘাস খাচ্ছে অথচ দুধ দোহন করে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানিরা। অর্থাৎ উৎপাদন হয় পূর্ব বাংলায় আর অর্থ চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৫৪-৫৫ অর্থাবছরে পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের GDP (Gross Domestic Products) প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৯.৬৬ শতাংশ বেশি। শুধু কি তাই; ১৯৪৭-৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের ২১১ জনের মাত্র ৯৫ জন ছিল বাঙালী। আইয়ুব খানের আমলে ৬২ জনের মধ্যে মাত্র ২২ জন ছিল বাঙালী। সামরিক অফিসার পদে মাত্র ৫ ভাগ ছিল বাঙালী। সেনাবাহিনীতে মাত্র ৪ ভাগ নেয়া হতো পূর্ব বাংলা থেকে। জাতীয় বাজেটের শতকরা ৬০ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দ থাকতো। এছাড়া প্রশাসনিক ক্ষেত্রেও ছিল ব্যাপক বৈষম্য। পাকিস্তানের প্রথম শ্রেনির পদে মাত্র ২৩ ভাগ বাঙালি অফিসার ছিলেন। অর্থাৎ সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক সকল ক্ষেত্রেই ব্যাপক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। এই ধরনের বৈষম্যের কারণে পূর্ব বাংলা ছিল অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত দেশ। একারনেই ১৯৭১ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ফাইনান্সিয়াল টাইমস কাগজে চার্লস স্মিথ লিখেছেন যে, ‘পূর্ব বঙ্গ যদি পৃথিবীর আটটি দরিদ্রতম দেশের একটি হয়, তবে তার কারণ এটি পাকিস্তানের একটা অংশ’। চার্লস স্মিথের এই কথার মধ্যেই বাঙালিদের বঞ্চনার চিত্র ফুটে উঠেছে। এসব নানা বৈষম্যের কারণে বাঙালি স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। কারণ স্বাধীনতা ছাড়া মানুষের জীবনযাপন সম্ভব না। বিখ্যাত মনীষী কাহলিল জিব্রাণ বলছিলেন, ‘স্বাধীনতা ছাড়া একটি জীবন মানে আত্মা ছাড়া শরীর’। অর্থাৎ আত্মা ছাড়া শরীর যেমন সম্ভব নয় ঠিক তেমনি স্বাধীনতা ছাড়া জীবনও অকল্পনীয়।
একেএকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮ সালের সামরিক আইন জারি, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ঐতিহাসিক আগরতলা মামলা, ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন ইত্যাদি নানা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালিরা স্বাধীনতার পথে এগোতে থাকে। সর্বশেষ ১৯৭১ সালের নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ৩০ লাখ শহিদ ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পৃথিবীর বুকে একটি নতুন স্বাধীন -সার্বভৌম দেশ বাংলাদেশের জন্ম হয়। আজ আমরা স্বাধীন জাতি। আমাদের নিজস্ব শাসনব্যবস্থা ও সার্বভৌমত্ব আছে। নির্দিষ্ট লক্ষ্যকে কেন্দ্র করে এদেশের মানুষ অনুভব করেছিল স্বাধীনতা অর্জনের।
অবশেষে অর্জিত হলো স্বাধীনতা। এখন আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি। আজ আমাদের আত্মোপলব্ধির সময় এসেছে। যে স্বাধীনতার জন্য এত সংগ্রাম, এত রক্ত, সত্যিই কি আমরা সেটা পেয়েছি। আমাদের প্রত্যাশা যেটুকু ছিল তার সঙ্গে প্রাপ্তি কতোটুকু? আমরা আমাদের সমীকরণটি মিলাতে পারছি কিনা?
১৯৭২ সালে মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্টমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার বাংলাদেশের করুন অবস্থা দেখে তখন বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র সাথে তুলনা করেছিলেন। তখন পুরো বিশ্ব ধরেই নিয়েছিল যে বাংলাদেশ কখনোই বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। সেই সময় ধরে নেয়া হয়েছিল যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ এই দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়েছে তাদের আসলে কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
কিন্তু জাতির জনক বঙ্গবন্ধু সেটা কখনোই বিশ্বাস করেননি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমার শক্তি, আমার জনগণ এবং আমাদের সবার চেষ্টায় এই বাংলাদেশ এক সময় উঠে দাঁড়াবে। সেখান থেকে বাংলাদেশ কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে আজ বিশ্বের দরবারে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ইতোমধ্যেই আমরা Millennium Development Goals -MDG) অর্জনে অভাবনীয় সাফল্য অজর্ন করেছি। বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (Sustainable Development Goals- SDG) অর্জনের স্বপ্ন দ্যাখে। স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তীতে আমরা স্ব-অর্থায়নে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, ট্যানেল, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, নৈপথ উন্নয়ন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভবন, পুরাতন রাস্তা-ঘাট পুননির্মাণ ইত্যাদি নানাদিক থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়েছি। বিভিন্ন দেশে বর্তমানে বাংলাদেশের তৈরিকৃত পোষাক শিল্পের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। জাতিসংঘে সামরিক বাহিনীতে সৈন্য পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান উল্লেখযোগ্য। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্মের সময় পৃথিবীর অন্যতম দারিদ্র্যপীড়িত দেশ ছিল বাংলাদেশ। সেইসময় মোট জনসংখ্যার ৮০ ভাগ মানুষ ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। বর্তমানে স্বাধীনতার ৫১ বছরে এসেও ২০ ভাগ মানুষ আজও রয়েছে দারিদ্র্যসীমার নিচে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধি লাভ করলেও থেকে গেছে ধনবৈষম্য। অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায়, বাংলাদেশে বর্তমানে তিনটি স্তরের সৃষ্টি হয়েছে। প্রথম স্তরে রয়েছে ১৫ শতাংশ মানুষ যারা দেশের মোট সম্পদের ৮৫ ভাগের মালিক। দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে ৫০ শতাংশ মানুষ যারা বাকি ১৫ শতাংশ সম্পদের মালিক। এরা হলো নিম্ন মধ্যবিত্ত স্তরেরে মানুষ। তৃতীয় স্তরে রয়েছে ৩৫ শতাংশ মানুষ যাদের কোনো সম্পদই নেই। এরা হলো চরম দরিদ্রের নিম্ম স্তরের লোক।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য যার ফলে পূর্ব পাকিস্তান দেশের সম্পদের ন্যায্য অংশ পেতনা। স্বাধীনতা লাভের ৫১ বছর পর এখনো দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে সমাজের ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে বৈষম্য আরো অনেক প্রকট ও তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে। বেশ কিছু লোক এখানে সম্পদের পাহাড় সৃষ্টি করেছে। অথচ দেশের প্রায় অর্ধেক লোকই দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করছে। মার্চ মাস আসলেই আমরা দেশপ্রেমের বুলি আওড়াতে থাকি, কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার হাঁড়ের মধ্যে যে ক্ষয় ধরেছে;তার কি কোনো প্রতিষেধক আছে? স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে এখনো ফুটপাতে ঘুমায় মানুষ, অনাহারে দিনাপতিত করতে হয় মানুষের। বিনা চিকিৎসায় মানুষ মারা যায়। ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মানুষ তাদের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে এসবের স্বপ্ন নিয়ে নয়। স্বপ্ন ছিল দেশের মানুষ অনাহারে থাকবে না। থাকবে না কেউ বাসস্থানহীন, মারা যাবে না বিনা চিকিৎসায়। এখানে এসে প্রশ্ন থেকেই যায় যে, স্বাধীনতার অর্জনের ৫১ বছরে এসেও আমরা আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমীকরণটা মিলাতে পেরেছি কিনা? আজ দেশে অপসংস্কৃতির চর্চা হয়। বেহায়াপনায় ভরে গেছে দেশ। স্বাধীনতা মানে শুধু দেশকে দুষ্টচক্রের কবল থেকে ছিনিয়ে আনা নয়। কবির ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়-
‘বলো, উলঙ্গতা স্বাধীনতা নয়
বলো, ক্ষুধা স্বাধীনতা নয়
বলো, ঘৃণা স্বাধীনতা নয়’।
স্বাধীনতা মানে দেশকে সব আগ্রাসন থেকে রক্ষা করা। স্বাধীনভাবে মানুষের চলাফেরা, অত্যাচার, জুলুম- নির্যাতন ও সাম্প্রদায়িক চেতনা সব কিছুর পাহাড় ভেঙে শান্তি-সুখে দেশ গড়া। কথায় আছে যে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। সকল বৈষম্য ভুলে সৌহার্দ-সম্প্রতীর নিয়ে দেশ এগিয়ে যাক। স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ জেনে তাই স্বাধীনতা নিয়ে বাঁচতে চাই। পরিশেষে বলবো-
‘স্বাধীনতা তুমি দীর্ঘজীবী হও,
তুমি বেঁচে থাকো আমার অস্তিত্বে
স্বপ্নে, প্রেমে, বল পেন্সিলের যথেচ্ছ অক্ষরে।
শব্দল, যৌবনে, কবিতায়।’
লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি