পরিবারচ্যুত সন্তান ও আদর্শহীন রাজনীতি
২৫ এপ্রিল ২০২২ ১৬:০৫
সতের এপ্রিল গণমাধ্যম থেকে জানা যায়, সদ্য নবগঠিত কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণকে ২০১৯ সালেই পরিবার থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল- এই দাবি করে যশোরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে রওনকুলের বাবা মুক্তিযোদ্ধা কাজী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ও আমার পরিবারের সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। শুধু ছোট ছেলে রওনকুল বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। কাজী রওনকুল আমার সন্তান হলেও রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে আমাদের পরিবারের কারও সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো যোগাযোগ নেই। নিজের আয়ে সে চলে। পারিবারিক বিয়ে বা কোনো অনুষ্ঠানাদিতেও আসে না। আমরাও তার কাছে যাই না।’
আর ‘আ.লীগ বাবার পরিবারচ্যুত সন্তান হলেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি’- গণমাধ্যমের এই শিরোনামের ভেতর একটি আদর্শ প্রতীয়মান যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। উদীয়মান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে নতুন করে ভাবতে সহযোগিতা করেছে যে, বাংলাদেশের রাজনীতি কিসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে!
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত দুইভাগে বিস্তার লাভ করেছে। এক. মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘আদর্শ’ কেন্দ্রিক রাজনীতি, দুই. অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে সেটি ধরে রাখার জন্য ‘ক্ষমতা’ কেন্দ্রিক রাজনীতি। আবার কিছু সংগঠন বিভিন্ন দেশের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য সে দেশের নেতাদের আদর্শকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে রাজনীতি করেন, রাজনৈতিক সংগঠনও গড়ে উঠেছে।
কিন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী সময় ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত মাঠের রাজনীতিতে সরকারের আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও মূল রাজনীতিতে ‘আদর্শ’ ছিলো। কিন্তু ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে শুধু আদর্শ কেন্দ্রিক রাজনীতিকেও হত্যা করেনি, বাহাত্তরের সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে ‘ক্ষমতা কেন্দ্রিক’ রাজনীতির সাথে সুকৌশলে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বলে ধর্ম ভিত্তিক ‘সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’-ও চালু করা হয়েছে।
উপ-মহাদেশের প্রাচীনতম ও শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’র বিষয়ে প্রখ্যাত লেখক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক জনাব মহিউদ্দিন আহমদের ‘আওয়ামী লীগ : উত্থানপর্ব ১৯৪৮-১৯৭০’ বই থেকে জানা যায়, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হওয়ার পরে ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাওলানা আকরাম খান এবং খাজা নাজিমুদ্দিন। আর সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী যে প্রোগ্রেসিভ [উদারপন্থী] নেতারা ছিলেন, তারা তখন সেখানে নিজেদের অবহেলিত মনে করছিলেন। তখন তারা মোঘলটুলিতে ১৫০ নম্বর বাড়িতে একটি কর্মী শিবির স্থাপন করেছিলেন। সেখানে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা চিন্তা করছিলেন। কলকাতা থেকে এসে শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সাথে যুক্ত হন।
তখন টাঙ্গাইলে প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ পদত্যাগ করার কারণে শূন্য হওয়া একটি উপনির্বাচনে দুই দফায় মুসলিম লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী এবং শামসুল হক। কিন্তু তাদের দুজনের নির্বাচনী ফলাফলই অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। আর তখন তারাও এসে এই মুসলিম কর্মীদের সঙ্গে মিলে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করার কথা ভাবতে শুরু করেন। তারা একটি সভা ডাকেন। সেই সভা ডাকার প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান।
কিন্তু সেই সভা করার জন্য কোন অডিটোরিয়াম পাওয়া যাচ্ছিলো না। তখন কে এম দাস লেনের কাজী হুমায়ুন রশীদ তার মালিকানাধীন রোজ গার্ডেনে সভা করার আহবান জানান।
মুসলিম লীগের প্রগতিশীল একটি অংশের উদ্যোগে ২৩ জুন বিকাল বেলায় রোজ গার্ডেনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকসহ তৎকালীন আড়াইশো-তিনশো নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে বাঙালি জাতির মুক্তির লক্ষ্যে গঠিত হয়েছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’।
প্রতিষ্ঠাকালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দলটির সভাপতি, শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং কারাবন্দি শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “কোথাও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন সাহেবের রোজ গার্ডেনের বাড়িতে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছিল।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন, “সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হল- ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে।”
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার ‘মুকুল’ প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
লেখক ও গবেষক জনাব মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘‘আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ার জন্য তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে অনুরোধ করেছিলেন শেখ মুজিব। কিন্তু মানিক মিয়া তাতে রাজি হননি, কারণ তিনি লেখালেখি নিয়ে থাকতে চেয়েছিলেন। জাস্টিস মোহাম্মদ ইব্রাহিম নামের সাবেক একজন মন্ত্রীকেও অনুরোধ করা হয়েছিল, কিন্তু তিনিও সভাপতির দায়িত্ব নিতে রাজি হননি।’’
‘‘তখন ১৯৬৪ সালের কাউন্সিল সভায় মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে পুরোপুরি সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদক থেকে যান।’’
‘‘কিন্তু ১৯৬৬ সালে ছয় দফা কর্মসূচী ঘোষণা করার পর মাওলানা তর্কবাগীশসহ অনেকেই তার বিরোধিতা করেন।’’
‘‘ওই বছর মার্চ মাসে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল মিটিংয়ে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ। যারা ছয় দফার বিরোধিতা করেছিলেন, তাদের অনেক নেতাই আওয়ামী লীগ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন।’’
এই আওয়ামী লীগ শুরুর দিকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি, এক ব্যক্তির এক ভোট, গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের দু’অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণের মত প্রধান দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছে।
এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘসময় এই দলটি সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন করে জনগণের মধ্যে একটি আস্থার জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হয়। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা যাকে বাঙালির মুক্তির সনদ নামে অভিহিত করা হয়। আর ওই ৬-দফার ভিত্তিতেই ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে।
ঐতিহাসিক ঘটনা কিংবা ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায়, একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’; যে-সংগঠন একটি অসাধারণ রাজনৈতিক দর্শনকে ধারণ করে সংঘটিত হয়েছে। আওয়ামী মুসলীগ থেকে ‘মুসলিম’ বাদ দিয়ে একটি সার্বজনিন রাজনৈতিক সংগঠনের স্বপ্ন নিয়েই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আর সেই স্বপ্ন-স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বিনির্মাণে তিঁনি দীর্ঘ ২৪ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে শুধু ঐক্যবদ্ধই করেননি, যুদ্ধের রণকৌশলও দিয়েছেন, দিয়েছেন অলিখিত-অনানুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণাও।
বাংলাদেশের স্থপতি, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর জিয়াউর রহমান একদিকে প্রধান সামরিক কর্মকর্তা, অন্যদিকে নিজেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে অবৈধভাবে দখল করেন। আর এই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্যই তার রাজনৈতিক সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং শুরুতেই ‘জাগদল’ দিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক পটভূমি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, জিয়া রাজনৈতিক দল তৈরির আগেই একটি রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠনের চিন্তা করেন, যাতে করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটা বিস্তৃত প্লাটফর্ম বানানো যায়। একটা নির্দিষ্ট দর্শন ও কর্মসূচীর চেয়ে তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল ক্ষমতাট্যুত আওয়ামী লীগের পাল্টা একটা বড়সড় মঞ্চ তৈরী করা।
চতুর জিয়া তার রাজনৈতিক দল তৈরির প্রক্রিয়াটিও রীতিমত রহস্যময় করে তুলেন। জিয়া সব কটি ডিম যেন এক ঝুড়িতে রাখতে চাননি। দল তৈরির কাজে অনেক ব্যক্তি ও মাধ্যমকে তখন ব্যবহার করেছেন। আর তখনকার সেনাবাহিনীর প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশুর অফিসে রাতের বেলায় রাজনৈতিক দলের বেশ কিছু শীর্ষ নেতারা আসতেন এবং আলাপ-আলোচনা করতেন। জিয়াও মাঝে-মধ্যে সেখানে উপস্থিত থাকতেন। অন্যদিকে জিয়ার একান্ত সচিব কর্ণেল অলি আহমদের সাথে তখন মাঠ পর্যায়ের অনেক নেতারই বেশ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল যা এই সুযোগও তিনি কাজে লাগিয়েছেন।
জিয়াউর রহমান একদিকে তার ‘সমমনা’ রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে একটি রাজনৈতিক জোট তৈরির কাজ করছেন, অন্যদিকে তিনি নিজস্ব একটা রাজনৈতিক দল তৈরির বিষয়টিও খুব গুরুত্বের সাথে দেখলেন। জিয়ার মনে হলো, জোটের মধ্যে শতভাগ অনুগত একটা দল না থাকলে জোটকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। আর সে লক্ষে ১৯৭৮ সালের ফেব্রুারি মাসে ‘জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল’ বা ‘জাগদল’ নামে নতুন একটি রাজনৈতিক দল তৈরির ঘোষণা দেন। জিয়া নিজে থাকলেন তার নেপথ্যে।
বলা হয়, জিয়ার নতুন এই ‘জাগদল’ তখনকার রাজনীতিতে তেমন একটা ঢেউ তুলতে পারেনি। রাজনৈতিক মাঠের চেনা মুখগুলোও জাগদলে খুব কমই যোগ দিয়েছিল, যা জিয়াউর রহমান চেয়েছে, তা আর হয়ে উঠেনি!
১৯৭৮ সালের ২৮ এপ্রিল জিয়াউর রহমান নিজেই নিজেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে পদোন্নোতি দিলেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে এমনভাবে ক্ষমতা দখলের নজির নেই। আর ১৯৭৮ সালের ১ মে জিয়াউর রহমানকে চেয়ারম্যান করে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট‘ ঘোষণা করা হলো।
আর ওই ঘোষণার মধ্য দিয়ে সেনাবাহিনীর প্রধান থেকে জিয়া হয়ে গেলেন পুরাদস্তুর একজন রাজনীতিবিদ!!
জিয়াউর রহমানের উদ্দেশ্য ছিলো স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের রাজনীতিকে কলুষিত করা, টাকার বিনিময় রাজনৈতিক নেতবৃন্দ তৈরি বা রাজনৈতিক নেতাদের ক্রয় করা। আর এই উদ্দেশ্য-উপলব্ধি থেকে জিয়া বলেন,‘‘আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকা’’। অর্থাৎ তিনি রাজনীতি কঠিন করে দেবেন।
বর্তমানে আমরা তাই দেখছি…!
নানা বিধি-নিষেধের বেড়াজালে অনেকের জন্যই তখন সত্যিই রাজনীতি কঠিন হয়ে যায়। কিন্তু জিয়া রাজনীতিতে তাঁর উত্তরণ ঘটান খুব সহজেই। রাজনীতিবিদ হতে হলে মাঠে-ঘাটে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতে হয়, হাতের তর্জনী তুলে গর্জন করতে হয়, জনগণের সাথে মিশতে হয় যা জিয়া ছিলো এ বিষয়ে একেবারেই নবীন।
এদিকে মশিউর রহমান যাদু মিয়ার ভাই মোখলেসুর রহমানের (সিধু ভাই) একটি সাক্ষাতকারকে উদ্ধৃত করে লেখক, গবেষক জনাব মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর ‘বিএনপি সময়ে-অসময়ে’ বইয়ে লিখেছেন,‘‘জিয়া বাংলা লিখতে-পড়তে জানতেন না। প্রথম দিকে তিনি বাংলায় যে বক্তৃতা দিতেন, সেগুলো উর্দুতে লিখতেন। তারপর সেটি দেখে বক্তৃতা দিতেন। তিনি ভালো করে বক্তৃতা দিতে পারতেন না। দিতে গেলে খালি হাত-পা ছুড়তেন।’’
যা হোক, জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গ্রুপের একটা প্ল্যাটফর্ম। তাঁদের একত্রিত হওয়ার একটাই ভিত্তি ছিল, তারা সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এককাট্টা। নানান মত ও পথের এ ফ্রন্ট নিয়ে জিয়াউর রহমান খুব বেশি স্বস্তিতে ছিলেন না। তিনি ‘একমনা’ বা ‘সমমনা’ লোকদের নিয়ে আলাদা একটি দল তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন।
দল তৈরির জন্য যাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করা হচ্ছিল, তাঁদের অন্যতম ছিলেন তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী। তিনি দলের নাম ‘জাস্টিস পার্টি’ রাখার প্রস্তাব করলেও জিয়ার কাছে এটি পছন্দ হয়নি, গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। দলের নামের সাথে জাতীয়তাবাদী থাকাটা জরুরী মনে করেন জিয়া। আর এই সিদ্ধান্তে শেষমেশ স্থির করে জিয়াই দলের নাম ঠিক করে রাখেন ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ বা বিএনপি।
১৯৭৮ সালের ২৮ আগষ্ট ‘জাগদল’ বিলুপ্তির ঘোষণা করেন। আর ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার রমনা রেস্তোরাঁ প্রাঙ্গনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’ বা ‘বিএনপি’র প্রধান হিসেবে দলের নাম, গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচী আনুষ্ঠানিক দল ঘোষণা করেন।
আর ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার সে সময় জেনারেল এরশাদ সেনাপ্রধান ছিলেন। তখন ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন এবং তাঁর নেতৃত্বে বিএনপিরই সরকার গঠিত হয়েছিল।
কিন্তু বিএনপি’র সেই সরকার বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি।
হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও জিয়াউর রহমানের পদ-পন্থা অনুস্মরণ করে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। আর এই অবৈধভাবে দখল করা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা টিকেয়ে রাখার জন্য ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি ‘জাতীয় পার্টি’ গঠন করেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদও।
অর্থাৎ দেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের গঠন পক্রিয়া ও তাদের আদর্শ-দর্শনগত বিষয়টির ইতিহাস থেকে জানা যায়, একমাত্র ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ যা ১৯৪৭ সাল থেকেই স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে, বিশে^র বুকে বাঙালি জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠিত করেছে। আর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ তাদের অবৈধভাবে দখল করা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য দর্শনহীন রাজনৈতিক ব্যক্তি, যারা শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি পছন্দ করেন, তাদের দিয়ে রাজনৈতিক সংগঠন গঠন করেন।
তার মানে আপনি ইচ্ছে করলেই যখন-তখন আওয়ামী লীগ হতে পারবেন না। কারণ, আওয়ামী লীগ একটি আদর্শ-দর্শনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সংগঠন।
আওয়ামী লীগ করা যতটা সহজ, আওয়ামী লীগার হওয়া ততটাই কঠিন। কারণ, একটি আদর্শ বা অসাম্প্রদায়িক মানবিক দর্শন মানব সন্তান তার পরিবারের কাছ থেকেই প্রথমত পেয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত শিক্ষা, শিল্প, সাহিত্য, সংগীত, সাংস্কৃতি, ধর্ম, বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে ওই মানব সন্তান তাঁর পরিপূর্ণতা অর্জন করে।
তাহলে এখানে কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের নবগঠিত সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণের মুক্তিযোদ্ধা বাবা কাজী রফিকুল ইসলামের সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্য পর্যালোচনা করলে প্রতীয়মান হয়, ‘‘কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ মূলত ‘আদর্শচ্যুত’ হওয়ার কারণেই ‘পরিবারচ্যুত’ হয়েছেন’’।
আদর্শচ্যুত নিয়ে প্রখ্যাত সাংবাদিক, গবেষক, কলামিস্ট আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী একটি চমৎকার কথা মনে পড়ে গেল যেমন, ‘বিলেত বাংলা’র একটি ভিডিও স্বাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘বিএনপি মানে কি? বিএনপি মানে হচ্ছে ১২-আনা রাজাকার, ৪-আনা সাবেক দেশপ্রেমিক’।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
কবীর চৌধুরী তন্ময় পরিবারচ্যুত সন্তান ও আদর্শহীন রাজনীতি! মুক্তমত