Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইদের আনন্দ বয়ে যাক শ্রমিকদের ঘরে ঘরে

রাশেদুজ্জামান রাশেদ
২৬ এপ্রিল ২০২২ ১৮:৪৮

আসন্ন ইদুল ফিতর মানে মুসলিম ধর্মবলাম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। বাঙালির নিজস্ব ধর্মের প্রতি আবেগ, অনুভূতির আর ভালোবাসার কোনো কমতি থাকে না। নিজ নিজ অবস্থান থেকে ধর্মীয় উৎসব পালন করে সবাই। তবে আমাদের দেশে মুসলিম ধর্মবলম্বী বেশি থাকার কারণে ইদ ভিন্ন আবহে আসে। প্রধান আলোচনার বিষয় হয় ইদ। বিশ্লেষণ করা হয় মানুষ কেমন করে ইদ পালন করছে? ইদের যাওয়া-আসাতে কত মানুষ সড়কে আহত-নিহত হয়েছে। নানামুখী সমস্যা তুলে ধরা হয়। আবার কেউ যানজটের কারণে গ্রামের বাড়িতে ইদ করতে পারে না। কারো আর্থিক সংকটের কারণে ইদের আমেজ ঘরে আসে না। কেউ ইদের আগে বেতন-বোনাস না পেয়ে মানবেতর ইদ উদযাপন করে। কেউ পথে পথে অন্যের কাছে টাকা চেয়ে ইদ পালন করেন। বিশেষ করে শহরের প্রধান সড়ক, টার্মিনাল কিংবা রেলওয়ে স্টেশনে গেলে চোখে পড়ে বৃদ্ধ, বৃদ্ধা, পথ শিশু মলিন চোখে চেয়ে বসে ‘স্যার কয়েক টাকা দেন আমি ইদের কাপড় কিনব’। ফলে ইদ ধর্মীয় উৎসব হলেও রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে সংযোগ রয়েছে। আমাদের দেশের চিরায়ত সংকট আর সমস্যার দৃশ্য না পাল্টাতে পারলে যদিও মুখে বলি- ইদ মানে আনন্দ আর খুশি। কিন্তু বাস্তবে তাদের ইদ মানে আনন্দ-উল্লাস যারা সম্পদ লুণ্ঠন করে টাকার পাহাড় গড়ে তুলেছে। আর দেশের নানা কাঠামো দিনের পর পর তাদের সহযোগিতা করে এসেছে। সুযোগ দিয়েছে অর্থনৈতিক বৈষম্য করতে। রাষ্ট্র তখনই উৎসবে মেতে উঠবে যখন মানুষ তার মৌলিক অধিকার পাবে। ধনী-গরিবের বৈষম্য থাকবে না তখনি যে কোনো ধর্মীয় উৎসবে আনন্দ ভাগাভাগি করতে পারবে।

বিজ্ঞাপন

আমাদের দেশে কত বিচিত্র মানুষ দেখা মেলে ফুটপাত কিংবা রেলওয়ে স্টেশনে। তাদের জীবন ও জগৎ-সংসারের চিত্র দেখে উদ্বিগ্ন হতে হয়। প্রসঙ্গক্রমে আসন্ন ইদে একজন গ্যাস বেলুন বিক্রি করা শিশু শ্রমিকের ইদ পালন করার পূর্বে তার পরিশ্রম দেখে হতবাক হতে হয়। ‘একটা ময়ূর নিয়ে যান, একটা প্লেন নিয়ে যান’ এভাবে জয়পুরহাট রেলওয়ে স্টেশনের উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে চিল্লায়ে গ্যাস বেলুন বিক্রি করছে। শিশু বেলুন বিক্রেতার নাম সোহেল। তার বাড়ি জয়পুরহাট জেলা সদরের টুকুর মোড়ের। এবারে সে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। পরিবারে দুই ভাই আর বাবা-মা। তার বাবা চা বিক্রেতা। ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হওয়া তার জন্মগতভাবে পরিবার থেকে পাওয়া একটা অভিজ্ঞতা। কিন্তু তারপরও তো এই ছোট্ট ছেলে। সে থাকার কথা তার পাড়া কিংবা মহল্লার খেলার সাথীদের সাথে। হৈ-হুল্লোড় আর উল্লাসে সারা বাড়ি দৌঁড়ে বেড়ানোর কথা। মাটির তৈরী পুতুল, ঘোড়া, পাখি, বাঘ, ভাল্লুক নিয়ে বন্ধুদের সাথে খেলা করার কথা। বেশি কিছু হলে পোড়ামাটির হাড়ি ও পাতিল দিয়ে রান্না করার খেলায় মত্ত থাকার কথা। ব্যাগে বই, খাতা ও কলম নিয়ে স্কুলের শ্রেণিকক্ষে থাকার কথা। এমন ভাবনা শেষ হওয়ামাত্র দেখলাম সে রেলওয়ে স্টেশনের মেঝেতে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে। ওর দুচোখে একটা প্রতিবাদী ছাপ আছে। কারণ কোনো বিক্রেতা যদি কোনোভাবেই তার ময়ূর কিংবা প্লেনের দাম কম দিতে চেয়েছে তখনি পাল্টা উত্তর দেয়। আপনাকে এসব কষ্ট করে কিনতে হবে না। কিন্তু সোহেল নিজেই যে কষ্টের সাগরে ডুবে আছে তা একবারের জন্যও তার মনে থাকে না। হাঁসিখুশি মন তার। পাশে থাকা জেরিন বলছে দেখেন ছোট্ট একটু ছেলে। তার অবস্থা দেখছেন? কত ধরনের ফ্যাশন! মানে তার পরনে জিন্সের প্যান্ট হাটুর নিচে ছেঁড়া। চুলগুলো স্টাইলে কাটানো। কণ্ঠের আওয়াজ খুব উচ্চ স্বরে। জেরিনের চিন্তা সাময়িক অর্থে সঠিক হলেও চিন্তারাজ্য প্রবেশ করলে দেখা যাবে সোহেলের আচার-আচরণ কেমন করে হলো? কোথায় থেকে শিখেছে? বনের পশু জন্মগ্রহণ করে পশু হতে পারে কিন্তু মানুষ জন্মগ্রহণ করে মানুষ হতে পারে না কারণ তাকে মানুষ হতে হলে পরিবেশ থেকে সুশিক্ষা গ্রহণ করতে হয়। যার ফলে একজন শিশু পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হলে তার পরিবারের এবং সমাজের পরিবেশ অনুকরণ করে শৈশবকাল থেকে গড়ে ওঠতে থাকে। ফলে সোহেল সেই পরিবেশে বেড়ে ওঠেছে ফলে সেই পরিবেশের আচার-আচরণ, নিয়ম-কানুন ইত্যাদি সে আয়ত্ত করছে। বিশ্রামরত অবস্থায় তাকে জিজ্ঞেস করলাম গ্যাস বেলুন দিনে কত টাকা বিক্রি করো?

বিজ্ঞাপন

সে আমার প্রশ্নের উত্তরে বলে পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজার বিক্রি করি। তার কথা শুনে একটু আশ্চর্য হয়ে বললাম এত টাকা প্রতিদিন উপার্জন করো তাহলে তাহলে খুব সুখেই আছো। সে হঠাৎ চুপ করে থেকে বলে আমি প্রতিদিন ৫০ টাকার মতো পাই আবার কোনোদিন পাই না। তার কারণ জানতে গিয়ে সে বলে অন্যের বেলুন সে বিক্রি করে দেয়। তার বিনিময়ে সে ওই পঞ্চাশ টাকা দিয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ চালায়। ইদের স্কুল ছুটির কারণে সে প্রতিদিন বেলুন বিক্রি করে টাকা জমিয়ে নিজের জন্য নতুন পোশাক আর মায়ের জন্য নতুন শাড়ি কেনার স্বপ্ন দেখছে। শিশু মানেই পরিবারের আদোরের সাত রাজার মানিক রতন। শিশু মানেই পিতামাতা ভবিষ্যৎ আলোর বাতি। দেশের সম্ভাবনাময় মানবসম্পদ। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেই মানবসম্পদ আজ কোন পথে? স্বাধীনতার ৫১ বছরে আমরা কি শিশুশ্রম বন্ধ করতে পেরেছি? ছিন্নমূল পথহারা শিশুদের জন্য বিনামূল্যে কি শিক্ষার আয়োজন করতে পেরেছি। উত্তর হচ্ছে না পাইনি। বড় বড় দালান-কোঠা নির্মাণ হয়েছে কোটিপতিদের সম্পদের পাহাড় গড়ে ওঠেছে কিন্তু সেই গ্যাস বেলুন বিক্রি করা শিশু শ্রমিক সোহেলের মতো হাজারো শ্রমিক তাদের স্বপ্নগুলো আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। দিনের পর দিন তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আসন্ন ইদে তারা কী ইদ উৎসব করতে পারবে? দেশের শিশুশ্রম কমিয়ে আনতে হলে প্রয়োজন সুনির্দিষ্টভাবে আইনের প্রয়োগ ও কঠোর শাস্তির বিধান। ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে (১৯৮৯) স্বাক্ষরকারী ও অনুসমর্থনকারী প্রথম রাষ্ট্রগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। ১৯৯৪ সালে জাতীয় শিশুনীতি প্রণয়ন করা হয় বটে কিন্তু আদৌ কি সুনির্দিষ্টভাবে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। না, কারণ স্বল্প মজুরিতে অধিক মুনাফা পাওয়ায় আশায় আমাদের দেশের পুঁজিবাদীরা শিশু শ্রম বন্ধে অনীহা প্রকাশ করে। যার ফলে শিশু শ্রমকে জিইয়ে রাখে। অপরদিকে আমাদের দেশের শ্রমিকের শ্রমই যে অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি এই সত্যটি সবার সামনে স্পষ্ট হয়েছে করোনার দুই বছরে। তবে দেশের সবচেয়ে আলোচিত শিল্প পোষাক শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি ২০১০ সাল থেকে পরবর্তী ৯ বছরে বৃদ্ধি পেয়েছে ৫০ শতাংশ একই সময়ে তাদের খাদ্য বাবদ ব্যায় বৃদ্ধি পেয়েছে ৬০ শতাংশ আর আবাসন ব্যায় বেড়েছে ১১০ শতাংশ। ২০১৮ সালের সর্বশেষ মজুরি ঘোষণার পর থেকে বার্ষিক পাঁচ শতাংশ হারে মজুরি বৃদ্ধিতে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে ২০ শতাংশ আর খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের মুল্যবৃদ্ধি হয়েছে ৭০ থেকে ১২০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি, আবাসন-চিকিৎসা ব্যায়সহ জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি কমে যাচ্ছে। ফলে মালিকের অর্থ হুহু করে বাড়ছে আর শ্রমিক ন্যায্য মজুরি না পেয়ে অপুষ্টিতে ভোগছে। এতে করে শ্রমিকদের জীবনমানের মারাত্মক অবনতি হচ্ছে।

আমাদের দেশে শ্রমিকদের জন্য কলঙ্কিত অধ্যায় রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির ৯ বছর পূর্ণ হলো। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে ধসে পড়েছিল নয় তলা ভবনটি। এটি ছিল দেশের পোশাকশিল্পে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি। ভবন ধসে প্রাণ হারিয়েছেন এক হাজার ১৩৮ শ্রমিক এবং আহত হয়েছেন দুই হাজার ৪৩৮ শ্রমিক। আহতদের অনেকেই পঙ্গু হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। মালিকের অবহেলায় দুর্ঘটনা ঘটেছে তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে। তাহলে দীর্ঘ নয় বছরেও অপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে না কেন? তাহলে আমরা ধরে নিব রাষ্ট্রযন্ত্র মালিকদের স্বার্থে কাজ করে। বিশেষ করে আমাদের দেশের মুসলিম ধর্মবলাম্বীদের বড় উৎসব ঈদুল ফিতর। ইদ মানে আনন্দের উৎসব আর উল্লাস কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে শ্রমিকদের কি উৎসব হবে? ইদে তার পরিবারের জন্য কি নতুন পোশাক দিতে পারবে? নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা সেই বাড়িতে কি ফিরে ইদ পালন করতে পারবে? এমন শত প্রশ্ন মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। পূর্বে আমরা দেখেছি পরিবহন সংকট আর ইদের আগে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস না দেওয়ার কারণ চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। একই চিত্র যে আমাদের বারবার দেখতে না হয় তার জন্য ইদের ছুটির পূর্বেই সকল শ্রমিকের বকেয়া বেতন-ভাতা, চলতি এপ্রিল মাসের বেতন ও পূর্ণ উৎসবভাতা পরিশোধ করতে হবে। ডাল, তেল, পিয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লামাগহীন উর্ধ্বগতি বন্ধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। মুনাফালোভী বাজার সিন্ডিকেটকে প্রশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতাকারীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধ কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। গ্রাম-শহরের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বেসরকারি বাণিজ্য বন্ধ করে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য বৃদ্ধি করতে হবে। বাজার মনিটরিং জোরদার করা করতে হবে। টিসিবি’র পণ্য বিক্রির ট্রাকের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। গ্রাম পর্যন্ত ওএমএস এর বিক্রি সম্প্রসারিত করতে হবে। গ্রাম-শহরের শ্রমজীবী জনগণের জন্য আর্মি রেটে রেশনিং ব্যবস্থা করতে হবে। কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ করতে হবে। যে সব মালিক শ্রমিক ছাঁটাই ও কারখানা লে-অফ করেন সে সকল মালিকদের চিহ্নিত করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সাধারণ মানুষ যেন ইদযাত্রা স্বস্তিতে ও নিরাপদে করতে তার ব্যবস্থা করতে হবে। রানা প্লাজার ভবন মালিকসহ সকল দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। জনগণের ট্যাক্সে দেশ চলে। তাই দেশটা সবার, ইদের আনন্দ হোক সবার। ইদের আমেজ ছড়িয়ে দেওয়ার রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

ইদের আনন্দ বয়ে যাক শ্রমিকদের ঘরে ঘরে মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর