ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্বে গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমকর্মীর ভূমিকা
৪ মে ২০২২ ১৪:৫৬
রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকেই বিশ্বের নজর সেদিকে। কখন কী ঘটছে সে নিয়ে চিন্তিত সকলে। আর সেই খবর যারা সাহসিকতার সাথে, জীবন বাজী রেখে সংগ্রহ করছেন তারা সাংবাদিক। অনেকেই যুদ্ধাক্রান্ত অঞ্চলে কাজ করতে গিয়ে অপহরণ,মৃত্যুর শিকার হন। আমরা ঘরে বসেই যে খবর পড়ি বা দেখি তা সংগ্রহ করতে হয় অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে। তবুও কিছু সাহসী মানুষ এটা করেন।
সারা বিশ্বেই সাংবাদিকরা সাহসী ভূমিকা পালন করেন। কারণ যখন কারও কোনো দুর্নীতির খবর প্রকাশিত হয় তখন তা সংগ্রহ করতে সাহস এবং বুদ্ধি দুইয়েরই প্রয়োজন হয়। সাহসী এবং ঝুঁকিপূর্ণ পেশাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সাংবাদিকতা। প্রতিনিয়ত এই চ্যালেঞ্জিং পেশার চ্যালেঞ্জ নিতে নতুন প্রজন্ম আগ্রহী হয়ে উঠছে। একটি সত্য ঘটনা সমাজের সামনে তুলে আনার চ্যালেঞ্জে আজ তরুণ প্রজন্ম আগ্রহী হয়ে উঠছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে গণমাধ্যমের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে এই করোনা মহামারীর সময়ে গণমাধ্যমই ঘরের বাইরের তথ্য জানার একমাত্র উপায়। এই কাজটি যারা ঝুঁকি নিয়ে করছেন সাংবাদিক। এসব দেশে গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমকর্মীদের ব্যপক জোরালো ভূমিকা পালন করতে হয়।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ৪র্থ স্তম্ভ বলা হয়। সে হিসেবে এই স্তম্ভটি হওয়া উচিত অত্যন্ত শক্তিশালী। কোন দেশের উন্নয়নে মুক্ত গণমাধ্যম অন্যতম শর্ত। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিচালিত রাষ্ট্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়া উচিত। ‘কারণ গণমাধ্যম রাষ্ট্রের পরিচালিত ব্যবস্থার খুটিনাটি দিকগুলো চিহ্নিত করে এবং তা বিশ্লেষণ করে সমাধানের পথ বাতলে দেয়। আবার সাংবাদিকরা বিশ্ব জুড়েই নানাভাবে হয়রানি,নির্যাতন এবং মৃত্যু বরণের ঘটনাও ঘটছে। একটি তথ্যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গণমাধ্যমের প্রকার এখন বিস্তৃত। টেলিভিশন চ্যানেল, প্রিন্ট পত্রিকা এবং রেডিওর সাথে সাথে অনলাইন পত্রিকা,অনলাইন টিভি এবং অনলাইন রেডিও রয়েছে প্রচুর। প্রতিনিয়তই নতুন নতুন পত্রিকা গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত হচ্ছে। আজ দেশে জাতীয় এবং স্থানীয় মিলে প্রচুর পত্রিকা রয়েছে।
হলুদ সাংবাদিকতা নিয়ে আজ প্রায়ই সমালোচনা হয়। গাড়িতে প্রেস লিখে অনেকে অপকর্মের সাথে যুক্ত হচ্ছে। পকেটে পাওয়া যাচ্ছে একেবারে অচেনা কোন নামসর্বস্ব পত্রিকার পরিচয়পত্র। অনেক পত্রিকার পরিচয় ফেসবুকে খবর শেয়ারের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ। যারা গণমাধ্যমের নাম দিয়ে কেবল অসৎ উপায়ে টাকা উপার্জন করতেই এসেছিল বা নিজের পিঠ বাঁচাতে এসেছিল। এসব প্রতারণা থেকে সাবধান থাকতে হবে। কারণ এরা হুট করে এসে আবার হারিয়ে যায়। গণমাধ্যমে কাজ করার আগ্রহ তৈরি হচ্ছে দেশের শিক্ষিত শ্রেণির ভেতরেও। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে অনেকেই গণমাধ্যমে কাজে আগ্রহী হচ্ছে। বিশেষ করে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো তাদের আকর্ষণ করছে। এছাড়া নারীদের একটি বড় অংশ এখন গণমাধ্যমে কাজ করছে। দিনদিন এই সংখ্যা বেড়ে চলেছে। কারণ আজকাল নিয়োগ দিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করে অনেকে। সেই কর্মীর প্রতি এর বাইরে আর কিছু করার প্রয়োজন পরে না। বেতন-ভাতা তো পরের কথা নূন্যতম পকেট খরচও অনেক গণমাধ্যমকর্মীর কপালে জোটে না। এই ব্যর্থতার কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আর এই ব্যর্থতা ঢাকতে অন্য কাউকে নয় গণমাধ্যমকেই এগিয়ে আসতে হবে।
পত্রিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশই হলো মফস্বল সংবাদ এবং মফস্বল সাংবাদিক। মফস্বল সাংবাদিকরাই গণমাধ্যমের প্রাণ। এসব পত্রিকায় কাজ করছে লক্ষাধিক সাংবাদিক। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করছেন এবং পত্রিকায় পাঠাচ্ছেন। কিন্তু এর বিনিময়ে তারা কি পাচ্ছেন? যারা উপজেলা পর্যায়ে কাজ করেন তাদের বেশিরভাগই ন্যূনতম সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
আজ হরহামেশাই পত্রিকায় জেলা এবং উপজেলা প্রতিনিধি নিয়োগের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখা যায়। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোতে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি শব্দটি দ্বারা মূলত একজন দক্ষ ব্যক্তিকে চাওয়া হয় যেখানে সেই ব্যক্তিকে তার উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেওয়া উচিত। কিন্তু তা কি হচ্ছে? নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্তে প্রতিনিধিকে সংবাদ সংগ্রহের পাশাপাশি বিজ্ঞাপন দেওয়ার বাধ্যবাধকতা বেধে দেওয়া হয়। কিন্তু সম্মানী দেওয়া খুব একটা চোখে পরে না বরং তার বিনিময়ে বিজ্ঞাপন থেকে একটা অংশ দেওয়ার কথা বলা হয়। আর যদি সেটি কোনো প্রিন্ট পত্রিকা হয় তাহলে এসবের সাথে সাথে পত্রিকা নিজ উপজেলায় নিদির্ষ্ট কপি দেওয়ারও শর্ত থাকে। অর্থাৎ সংবাদ সংগ্রহের পাশাপাশি তাকে নজর দিতে হয় বিজ্ঞাপনে এবং সেই সাথে পত্রিকা পাঠকের কাছে পৌঁছানো। এত দায়িত্ব পালন করার পরেও তাকে আর্থিক সুবিধা কতটুকু দেওয়া হচ্ছে? এতসব শর্ত থাকা সত্ত্বেও কিন্তু প্রচুর আগ্রহী দেখা যায়। তারা সেই পত্রিকায় ঝুঁকি নিয়েই কাজ করছে। তারা দূর দুরান্ত থেকে সংবাদ সংগ্রহ করছে এবং পত্রিকাগুলোতে পাঠাচ্ছে। এটা করতে গিয়ে অনেক সময় স্থানীয় ক্ষমতাশালীদের সাথে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় কিন্তু এর বিনিময়ে পত্রিকা কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে তাকে একটি নূন্যতম বেতন দেওয়া হয় এমন পত্রিকার সংখ্যা হাতে গোণা।
যদি ধরে নেই যে বিজ্ঞাপন থেকে একটি অংশ আয় হিসেবে থাকছে সেক্ষেত্রে প্রশ্ন হলো একটি উপজেলায় বর্তমানে বিজ্ঞাপন প্রাপ্তির তুলনায় সাংবাদিকের সংখ্যা অনেক বেশি। এবং প্রতিনিয়তই এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে কারণ গণমাধ্যমের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একজন সাংবাদিকের প্রধান কাজ হলো সংবাদ সংগ্রহ করা এবং আমার মতে সেই কাজটি যদি দক্ষতার সাথে করতে সক্ষম হয় তবে তার বিনিময়েই সেই সাংবাদিককে একটি সম্মানযোগ্য সম্মানী দেওয় প্রয়োজন। একথা একারণে বলছি যে যে হাতে গোণা পত্রিকা উপজেলা প্রতিনিধিদের সম্মানী দিয়ে থাকে তার বেশিরভাগই অতি সামান্য।
আবার জেলা প্রতিনিধিদেরও প্রায় একই অবস্থা। অর্থাৎ এই ঝুঁকিপূর্ণ এবং পরিশ্রমের কাজটি করে মফস্বল সাংবাদিককে অন্য পেশায় নিয়োজিত থাকতে হয় তার আর্থিক চাহিদা মেটানোর জন্য। তাহলে উপজেলা পর্যায়ে যারা সাংবাদিকতা করেন তাদের কি এটা কোনো পেশা হতে পারে? পেশা শব্দটি জীবন ও জীবিকার সাথে জড়িত।
তাহলে মফস্বল সাংবাদিকতা করার প্রতি এই ঝোঁক কেন? এর প্রধান কারণই হলো সম্মান। কারণ সাংবাদিকতা একটি অতি সম্মানজনক অবস্থান। হতে পারে তারা আর্থিক দিক থেকে স্বচ্ছল নয় কিন্তু সত্যিকার অর্থে তাদের অবস্থান অনেক সম্মানের। যদিও তারা এটা জানে যে এখান থেকে কোন আর্থিক সুবিধা পাওয়া যাবে না। সাংবাদিকতা বা গণমাধ্যমের সাথে যুক্ত থাকা সম্মানের জন্যই মূলত এত আগ্রহ দেখা যায়। সংবাদ সংগ্রহের বিপরীতে তাদের আর্থিকভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত এসব দেশ এবং বিদেশের সংবাদ প্রকাশ এবং বিশ্লেষণ করে জনগণকে সচেতন করে। এছাড়া বিনোদন এবং শিক্ষামূলক কাজেও গণমাধ্যম যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে প্রতিনিয়তই। প্রান্তিক জনগণের আশা আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটে। তাদের সাফল্য বা কষ্টের সংবাদও আমরা এসব মফস্বল প্রতিনিধিদের মাধ্যমেই পেয়ে থাকি। গণমাধ্যম তখনই সার্থকতা পায় যখন জনগণের উপকারে এসে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে পারে।
জানার ইচ্ছা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এই সহজাত প্রবৃত্তি পূরণের জন্যই গণমাধ্যমগুলো কাজ করে। এর সাথে যুক্ত কর্মীরা প্রতিনিয়ত মানুষের তথ্য জানার আগ্রহকে গুরুত্ব দিয়ে তা সংগ্রহ এবং প্রচার করছে। এই তথ্য জানানোর কাজটি সবক্ষেত্রে সহজ হয় না। অনেক সময় ক্ষমতাশালীর রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করেই তাকে তার কাজ করতে হয়। ঝুঁকি বৃদ্ধি পাচ্ছে কিন্তু সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকের ভবিষ্যত সুরক্ষিত করতে গণমাধ্যমগুলো কি ভূমিকা পালন করছে? অথচ পত্রিকার পাতায়, অনলাইনে, টেলিভিশনে উঠে আসছে মফস্বল থেকে পাঠানো প্রতিনিধিদের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। যে সংবাদের জন্যই একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে সেই পত্রিকার গ্রহণযোগ্যতা আরও বৃদ্ধি পায়। নিজের এলাকার সংবাদের প্রতি আগ্রহ সবারই থাকে। আর এর সাথে যে সংবাদকমী জড়িত থাকেন তার সম্মানও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। এ কথা সত্যি যে অনলাইন পোর্টালের এই ধারায় সাংবাদিকতা মাঝেমধ্যেই সমালোচনার মুখে পরছে। নামস্বর্বস্ব অনলাইন খুলে সাংবাদিক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হচ্ছে। নিয়োগ দেওয়া সংবাদকর্মীর লেখার বা সংবাদ সংগ্রহের দক্ষতা অনেক সময় যাচাই করা হচ্ছে না। কারণ একজন সাংবাদিক যখন নিয়োগ দেওয়া হয় তখন সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হলো সংবাদ সংগ্রহ এবং লেখার যোগ্যতা ও বস্তুনিষ্ঠতা। কার্ড নয় সংবাদ লেখার দক্ষতাই সাংবাদিকতার মূল পরিচয়। মোট কথা একজন মফস্বল প্রতিনিধিকে তার প্রাপ্য সম্মানীটুকু দিতে হবে যাতে সেই সংবাদকর্মী উৎসাহবোধ করে এবং দক্ষ সংবাদকর্মীরা এই কাজে আসতে পারে।
লেখক: শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক
সারাবাংলা/এজেডএস