ক্ষণকালের পল্টু হলো চিরকালের বন্ধু
১২ মে ২০২২ ১৩:৩৮
কীর্তিমানদের কাছে আমি সবসময়ই ইনোসেন্ট হই, অবুঝ শিশুর মতো কাছে বসে থাকি, দেখি, শুনি এবং তাদেরকে পড়ি। সে তিনি লেখক, কবি, সাংবাদিক, শিল্পী যা-ই হউন না কেন। তবে আমার বিশেষ মনোযোগ থাকে তাদের প্রতি, যারা দৃষ্টি থেকে সৃষ্টি করেন।
ঠিক প্রথম দেখা কবে হয়েছিল দিনক্ষণ মনে নেই, তবে বেলায় বেলায় বহুদিন। একহারা গড়ন, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, পুরুষ্ঠ ঠোঁটে ঢেকে আছে সামান্য উঁচু দাঁত, যেখান থেকে সারাক্ষণই বেরিয়ে আসে দুষ্টুমি মাখা মধুময় হাসি, সাদা- কালোয় মেশানো মাথাভর্তি চুলের এক যুবক। আদরকাড়া নাম, পল্টুর কথাই বলছিলাম। চারুশিল্পী পল্টু। এই প্রথম কোন সৃষ্টিশীল মানুষকে সম্মানের জায়গায় রেখে তার মধ্যে আদর ঢেলে কাছে টেনে নিলাম।
শিল্পী আমি নই কোনকালেই, তবে শিল্পে আকৃষ্ট হই অকাতরে। তখন আমাদের বেশ আড্ডা হতো শাহবাগের ছবির হাটে। আড্ডা না বলে আমরা বলতাম প্রাণের মিলন, আর আঙ্গিনাটা ছিল আমাদের মিলনের উঠোন। প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় আড্ডা জমতো, ছুটির দিন কিংবা শুক্রবারে তা হয়ে যেত রীতিমতো মচ্ছব। অপার আনন্দ, অসীম তৃপ্তি নিয়ে দেখতাম শিল্পী পাগলদের তুলির আঁচড়ের পাগলামো। চায়ের কাপ আর সিগারেটের ভাগাভাগিতে আত্মার অদলবদল হতো আমাদের। শুরুরদিকে নিজেকে একটু আলগা করে রাখার স্বভাব আমার অনেকদিনের, এখানেও তাই ছিলাম। মার্গীয়দের কাছে নিজেকে কিছুটা অন্যরকম লাগতো বলেই একটু দূরেই বসতাম, ব্যাপারটা চোখে পড়লো এই ছেলেটার। কাছে এসে বসলো, প্রথম কথাতেই একটা সিগারেটের জন্য হাত বাড়ানো! সে এক অপার্থিব দৃশ্য ছিল আমার চোখে, আমি তার বাড়ানো হাতে যে বন্ধুত্বের ফুলের তোড়া দেখেছিলাম, দেখেছিলাম আপন করে নেওয়ার আহবান। আমরা এক হলাম, আমি দাদা, আর সে আমার পল্টু, আমার ছোট ভাই। আমাদের সম্পর্ক হলো মাপজোখের বাইরে, হিসেবের পাতায় যার জায়গা হতো না।
ঘুড়ি উৎসবে গেলাম বারকয়েক, ঘুড়ি ওড়াতে একেবারেই কাঁচা হাত আমার, নিজে যেমন কোনকিছুর নিয়ন্ত্রনে থাকি না, রাখতে পারিনা অন্য কিছুকেও, আর সীমাহীন আকাশে উড়ন্ত ঘুড়ি কেন বাঁধ মানবে আমার! এর ওর কাছ থেকে বেছে বেছে চেয়ে নেই শান্ত ঘুড়ি, অবাক ব্যাপার দেখতাম, আমার হাতে এলেই শান্ত ঘুড়ি বেয়ারা হয়ে যেত! আকাশের এমাথা-ওমাথা ছুটে বেড়াতো প্রচন্ড বেগে, গোত্তা খেতে চাইতো, চাইতো অন্যের ঘুড়ির সাথে প্যাচ খেলতে। সেবার সেন্টমার্টিনের সীমানা পেরিয়ের বিচে আমরা। ঘুড়ি নিয়ে যখন আমার নাজেহাল অবস্থা, পেছন থেকে একটা হাত আমার কাঁধে, অন্যটা নাটাইয়ে। ‘দাদা, আপনাকে দেখে আকাশে বানকুড়ালী এসেছে, এই নেন আমারটা, বানকুড়ালী একে ধরতে পারবে না’। লেজ বিশিষ্ট এক শান্ত ঘুড়ি ধরিয়ে দিল পল্টু। অসীম আকাশে আমার শান্তু ঘুড়ি উড়ছে আর আমি ইচ্ছেমতো সূতো ছাড়ি। সূতোর পাকে পাকে মিশে থাকে আমার মনের দুরন্ত ওড়াউড়ি ।সন্ধ্যে ঘনিয়ে এলে গান আর গেলাসের আড্ডায় মাতি আমরা, গানের তালে তালে আমার পিঠে তাল বাজায় পল্টু। কী ছন্দ আর মায়াময় তাল ছিল তার হাতে। যেন আমি যন্ত্র, আর পল্টু যন্ত্রী।
আবু জাফর স্বপনের সংগী হয়ে প্রতিবছরই পহেলা বৈশাখের মংগল শোভাযাত্রায় যেতাম, সেবার শোভাযাত্রা শেষে আমরা তিনজন উঠে বসলাম এমন এক জায়গায় যেখানে বসে অনেক ফটো শিকারীর শিকার হয়েছিলাম। চারুকলা ইন্সটিটিউটের গেইটের গার্ডদের ছাদে আমরা। অনেকেই শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন নিচে দাঁড়িয়ে, মোবাইল ক্যামেরা তাক করে আমাদের ছবি তুলছেন, এদের মধ্যে ললনাদের সংখ্যাই ছিল বেশি, আমার সে কী পুলক। নিজেকে তারকা ভাবতে ভালোই লাগছিল। একটু পরেই আমার ভ্রম ভাংগলো, তারকা আমরা ছিলাম না, তারকা ছিল এই ছেলেটি, পল্টু। সেদিন বুঝলাম, কতজনের মনের তারকা আর প্রাণের বান্ধব ছিল পল্টু।
এবছরে পহেলা বৈশাখের আগের রাতে। চারুকলায় গেলাম, দেখা হলো পল্টুর সাথে। এক গাল হাসির দ্যুতি ছড়িয়ে পল্টুর আত্মিক আহবান, দু’হাত বাড়িয়ে দিল। তখনো এক হাতের আংগুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। আমি কপট রাগ দেখালাম, ‘এখনও সিগারেট! তোর না হার্টে সমস্যা! ছাড়িসনি এখনো!’ আরে মুরুব্বী দাদা, আমার সমস্যা তো হাতে, হার্টে না তো! পল্টু যখন আমাকে ‘মুরুব্বী দাদা’ ডাকতো, এখানেও একটা প্রচ্ছন্ন দুষ্টুমি থাকতো। ‘মুরুব্বী’ শব্দটা উচ্চস্বরে আর ‘দাদা’টা ইচ্ছে করেই ক্ষীণ স্বরে বলতো, সেদিনও তাইই ছিল, আমি তার পিঠে একটা থাপ্পড় বসিয়ে বললাম ‘ফাজিল’। ‘দাদা আপনার এই মাইরটা আমার দারুণ লাগে!’ হাত ধরে বসালো ছোট পন্ডের রেলিং এ, ‘অঞ্জনদা, রবীন্দ্রনাথ নিয়ে আমার একটা আনকোরা ভাবনা আছে, কাউকে বলিনি, আমার ভাবনাটা আপনার বইতেই প্রকাশ করবো, আপনার পরের বইয়ের কাভার পেইজের কাজটা আমি করব’।
এবারের ইদের ছুটিতে গেলাম শান্তিনিকেতনে, রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে পরের কাজের প্রথম সোপানে পা রাখবো বলে। ওখানে থাকাকালীন কতবার যে পল্টুর কথা মনে মনে বলেছি, ছেলেটা জেনেই গেল না! আমি ঢাকা আসার আগেই পালিয়ে গেল, ছুটে গেল মহাকালের ডাকে সাড়া দিয়ে। বাসের সর্বশেষ সিটের সারিতে একলা আমি। একা একা কান্নার উত্তম পরিবেশ। চোখের জলে ঈশ্বরকে শাপ-সম্পাত করতে এই পরিবেশটাই উপযুক্ত। মনের অজান্তে শুধু একটা কথাই বেরিয়ে আসছিল, ‘পল্টুরে, ক্ষণকালের পল্টু তুই আমার চিরকালের হয়ে গেলি রে!’
পল্টু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার পুরাতন ছাত্র হলেও সে ছিল আজম্ম নতুন, কত ছাত্র-ছাত্রীর প্রাণের পল্টু ভাই, যেন সকলের সুখ দুঃখের শেষ ঠিকানা, প্রতিবছরের মংগল শোভাযাত্রার আসল মাঝি, যে কখনোই এই শোভাযাত্রার নৌকা ডুবি হতে দেয়নি। আজকের এই দিনে মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করবো, হে ঈশ্বর, তুমি আমাদের পল্টুর নাও পল্টনে ভিড়িও না, তাকে ভাসতে দাও, চলতে দাও নিজের গতিতে, পল্টুর যাত্রাপথ মঙ্গলে মংগলে ভরিয়ে দাও। পল্টু যে চলার নাবিক, তার শেষ ঠিকানায় তার ইচ্ছেমতো যেতে দাও। এই পল্টু আমার পল্টু, আমাদের পল্টু, আমাদের হাসিমুখকে বেদনায় নীল করে দেয়া চিরহাসিমুখের পল্টু। অম্লান থাকুক তার হাসি।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি