‘সর্বে ভবন্তু সুখিন, সর্বে সন্তু নিরাময়া’
১৫ মে ২০২২ ২০:০৮
ডঃ বাসু, বলছিলাম ডঃ সুব্রত বাসুর কথা। সত্তোরর্ধ একজন স্বাপ্নিক মানুষ। পেশাগত জীবনে একজন ডাকসাইটে আমলা ছিলেন। অংগুলির ইশারায় তিন রাজ্যের রাজস্ব কর্মকর্তাগণ উঠ-বস করার কথা, চোখের নজরে এফোঁড়-ওফোঁড় হওয়ার কথা আর্থনৈতিক দুর্বৃত্তদের। কিন্তু না, কারন তিনি যে ডঃ বাসু। পেশাকালীন সময়ে তার দু’চোখ ভরে থাকতো দুই রকমের নিষ্ঠা। এক চোখে প্রশাসন, অন্য চোখে অন্বেষণ। খালের কিনারা, নদীর পাড়, গহীণ জংগল, অকূল মরুতে ঘুরে বেরিয়েছেন আর কুড়িয়ে এনেছেন অমূল্য কিছু সম্পদ। ছোট ভাই চিশতির কল্যাণে এবারের ভারত ভ্রমণে দেখা হলো বসু দম্পতির সাথে। প্রাতঃরাশে আপ্যায়িত হবার কথা থাকলেও আমাদের কথার তোড়ে কখন যে বেলা গড়িয়ে মধ্যাহ্ন ভোজের কাঁটায় এসে ঘড়ি জানান দিল, টের পাইনি। আমার দুধ চা পছন্দ বলে সে কী উল্লাস এই জ্ঞানী মানুষটার! অম্বলের জ্বালায় দুধকে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন অনেক আগেই, তবে আমাকে পেয়ে পুরনো নেশা যেন আবার ডানা ঝাপটে এলো, স্ত্রী আর গৃহপরিচারিকাকে জানিয়ে দিলেন, ‘আজ আমি মুক্ত হলাম, আমি বেহিসেবী হবো চা পানে, কারন অঞ্জন এসেছে, সে দুধ চা পান করে, আমিও করবো যতবার ইচ্ছে, কেউ বারণ করবে না, বলে রাখছি’। এতবড় একজন মানুষ কীভাবে সাধারণে নেমে এসে অসাধারণ হতে পারেন, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করার মতো শক্তি আমার আগে ছিল না, বরং আমাকে বুঝিয়েছেন ‘গ্রহণ আর প্রকাশন- reception আর Transmission-এর সুক্ষ দুরত্বের মাঝে বিশাল পার্থক্যের কথা’। বলা চলে সমৃদ্ধ হয়েই এলাম।
শান্তিনিকেতনের সোনাঝুড়ির হাট, কেউ বলে শনিবারের হাট, কেউবা খোয়াই-এর হাট। এই হাট থেকে কয়েক কদম এগুলেই রাস্তার ডানদিকে এক প্রকাণ্ড ফটক। ফটকের গ্রিলে অক্ষরগুলি ঝুলে আছে, যাদেরকে সন্নিবেশ করলে পড়া হবে ‘প্রকৃতি ভবন’। কম বেশি ৪০০ পাথুরে স্থাপত্য আর বাটাল-খুন্তির ছোঁয়াবিহীন অবিকল আদলের গাছের শেকড় ডাল-পালার সংগ্রহশালা এই মিউজিয়াম। এসব প্রস্তর খণ্ড আর ডালপালার মধ্যে অনুসন্ধিৎসু চোখ খুঁজে খুঁজে বের করে এনেছে দেখা আর তাকানোর পার্থক্যের সুস্পষ্ট পার্থক্যকে। পথের ধারে অবহেলায় ফুটে থাকা ভাট ফুলের অনাবিল সৌন্দর্য দেখে চলন্ত পথিক যেমন তার চলন্ত পা কে থামাবেন, আমি নিশ্চিত, এই প্রকৃতি ভবনে এলে দর্শণার্থীরা মুগ্ধতার আকর্ষণে তাদের ঘড়ির কাঁটাকে থামিয়ে দেবেনই। এই প্রকৃতি ভবনেরই স্বপ্নদ্রষ্টা আর বাস্তবায়নের ওস্তাগর ডঃ সুব্রত বসু। একান্ত নিজস্ব পাগলামীর ফসল এই অনিন্দ্য আর সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা।
এতোসব প্রস্তর খণ্ডের মধ্যে একটা পাথরের কাছে এসে আমি চলৎশক্তি হারিয়েছিলাম অনেকক্ষণ! লাল ইটের বেদীর উপরে শুয়ে আছে একটা পাথর। যেন স্বয়ং বুদ্ধদেব। ডঃ বাসুর দৃষ্টিতে এখানেই বুদ্ধদেব তার শেষ শিষ্যকে দীক্ষা দিয়েছিলেন, পেতেছিলেন ‘মহা পরিনির্বাণ শয্যা’। এই বিশাল পাথরটি তিনি কুড়িয়ে এনেছিলেন হায়েদ্রাবাদের গহীণ জংগল থেকে। জাগতিক পংকিলতা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার এক অদ্ভুত ভাবনাকে এই পাথরের মধ্যে দিয়ে দেখিয়েছেন তিনি। বুদ্ধদেব তার শরীরটাকে জগতের দিকে ঘুরিয়ে রেখেছেন ঠিকই, কিন্তু পংকিলতা থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছেন বিপরীত দিকে, মেটে সিঁদুরে আঁকা দু’খানা চোখ যেন সেই কথাই বলছেন।
প্রকৃতি ভবনের পেছনের দিকে একটা ভাতঘর আছে। মায়ের হাতের রান্নার মতো সুস্বাদু খাবার আপনাকে তৃপ্তি দিবেই। এই রসুই ঘরের খুন্তি – কড়াইয়ের অধিকর্তৃ – গীতা’দি । সাইনবোর্ডে এভাবেই লেখা আছে। একজন সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। গীতাদি’র ভাত ঘর ছাড়িয়ে এক মিনিট এগুলেই আপনি থমকে দাঁড়াবেন, হাতের ডানে পাঁচিল ঘেরা উম্মুক্ত স্থানে ধ্যানে বসে আছেন একজন। শুভ্র বসনে সৌম্যকান্তি এক মহাপুরুষ। সুউচ্চ বেদীতে বসে আছেন, যার মুদিত নয়নে উদ্ভাসিত হচ্ছে ‘সর্বে ভবন্তু সুখিন’ নামক আশীর্বাদ। তিনি আর কেউ নন, পরমেশ্বর বুদ্ধদেব। সাদা ধবধবে ৩৪ ফুট উচ্চতার পরমেশ্বর। এত বড়ো মহামূর্তি যার হাতে নির্মিত, তিনি আর কেউ নন, তিনি সেই আটপৌরে রমনী গীতা’দি।
আজ সবাইকে জানাচ্ছি শুভ বুদ্ধপূর্ণিমার মৈত্রেয় শুভেচ্ছা। ‘সর্বে ভবন্তু সুখিন, সর্বে সন্তু নিরাময়া, সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু, মা কশ্চিদ দুঃখ মাপ্নুয়াত, ওম শান্তি শান্তি শান্তি’।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি