কামলার জীবন ও সংগ্রাম আমরা কি বুঝি
১৬ মে ২০২২ ১৭:২৬
শহরের মানুষ প্রতিবেশীকে চেনে না। কখনও নিজের আত্মীয় স্বজনকে চেনে না। শহরের মানুষ বেড়ে ওঠে আন্তকেন্দ্রীক ভাবে। বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবী গ্রামে পরিণত হওয়ার কারণে শহরের মানুষের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই সমাজ। অপর দিকে গ্রামে অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত থাকার কারণে শহরের মত করে ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোয়া এখনও লাগেনি। ফলে গ্রামের মানুষের জীবনযাপনের চিত্র শহর থেকে পুরোটাই উল্টো। গ্রামে একজনের খবর অন্যজন রাখে, কার গরু কয়টা, কে ইটের বড় বাড়ি দিলো, কার সন্তান-সন্ততি কয়টা, কার জমি কম কিংবা বেশি ইত্যাদি সব তথ্য গ্রামের একজনকে জিজ্ঞেস করলেই পাওয়া যায়। গ্রামের মানুষের সামাজিক দায়বদ্ধতা খুব দৃঢ় তা বুঝা যায় যখন গ্রামের কোনো এক বাড়িতে আগুন লাগলে খুব দ্রুত পাড়াপ্রতিবেশিরা দৌঁড় আগুন নিভাতে যায়। বিশেষ করে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান গ্রামের মানুষের সামাজিক মেলবন্ধন বেশ অটুট।
গ্রামে রাস্তা দিয়ে হেঁটে কোথাও বেড়াতে গেলে মানুষ জিজ্ঞেস করে কোথায় যাওয়া হচ্ছে, কী কাজে যাওয়া হচ্ছে ইত্যাদি নানা সুখ দুঃখের গল্প হয়। যা শহরের মানুষের মধ্যে লক্ষ্য করা যায় না কারণ শহরের মানুষ এতটাই ব্যস্ত যে তার পাশে কোনো ব্যক্তি মহাবিপদে পড়লেও তাকে সহযোগিতা করা তো দূরের কথা তার প্রতি তাকানোর সময় নেই।
গত ১০ মে দুপুর ১ টায় শনিবার চিলাহাটি রেলওয়ে স্টেশনে খবরের কাগজ পড়ছি। এমন সময় খবরের কাগজে চোখ পড়ে ১০ বছর বয়সী শিশু শ্রমিক মোবারক হোসেনের জীবন সংগ্রামের কথা। সে পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করতে ছোটবেলা থেকেই প্লাস্টিকের বোতল ভাঙার কারখানায় কাজ করেন। দুঃখের বিষয় ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায় কারখানায় আসা পরিত্যক্ত বোতলগুলো থেকে অবশিষ্ট তেল সংগ্রহ করছে। ওই তেল দিয়ে তার বাসায় রান্নার কাজে ব্যবহার করা করবে। এমন চিত্র দেখে বুঝায় যাচ্ছে তেলের বোতেলে তেলেসমাতি আর বাজারে ব্যবসায়ীদের সিণ্ডিকেটের দৌরাত্বের কারণে মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে পকেট শূন্য জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। এসব ভাবতেই হঠাৎ আমাকে কেউ যেন একজন ডাকছে। তাকিয়ে দেখি রেলওয়ে স্টেশনে ৫০ বছর বয়সী চুকল্লু চাচা। আমাকে দেখে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোটে যাবু রে বাউ’ উত্তর দিলাম জয়পুরহাটে যাব চাচা। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কোথায় যাবে? তিনি বললেন আক্কেলপুরে যাইম। তিনি কেন আক্কেলপুর যাবেন জিজ্ঞেস না করে আমি ট্রেনে উঠতে যাচ্ছি। তিনি আমার পিছু নিলেন। তাকে বললাম আপনি টিকিট কাটছেন। তিনি চুপ করে থেকে বললেন, ‘বাউ রে মুই টিকিট কাটো নাই, মোক টিকিট কাউন্টারের লোক টিকিট নাদে’। তার কথা শুনে বুঝলাম ট্রেনের সিট খালি না থাকার কারণে টিকিট কাউন্টারের লোক তাকে টিকিট দেন নি। তাকে বললাম আচ্ছা তাহলে আমার বগিতে উঠেন এক সাথে গল্প করে যেতে পারব। তার পর ট্রেনের মধ্যে টিকিট কেটে নিয়েন।
ট্রেন চিলাহাটি স্টেশন থেকে চলতে শুরু করছে ডোমার, নীলফামারী ও সৈয়দপুর স্টেশন ছেড়ে পার্বতীপুর স্টেশনে রওনা দিচ্ছে। এমন সময় সাদা পোশাকের টিকিট মাস্টার এসে তার কাছে টিকিট চায়। কিন্তু তিনি টিকিট দিতে না পারায় তাকে সিট থেকে উঠায় নিয়ে বগির দরজার দিকে যায়। সেখানে অনেক কিছু কথা বলে তার কাছ থেকে একশত টাকা নেয়। তারপর তিনি সিটে বসেন জয়পুরহাট ছেড়ে আক্কেলপুর পর্যন্ত যান কখনও সিট থেকে উঠতে হয় নি কিংবা কেউ এসে বলে নি চাচা সিটটা আমার। তাহলে স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন আসে টিকিট কাউন্টার তাকে কেন টিকিট দিলেন না? সিট নেই বললেন কেন? এর জবাব ও প্রতিকার কী রাষ্ট্র করতে পারবে?
নীলফামারী, পঞ্চগড়, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট ও রংপুর অঞ্চলের মানুষ আমন ধান কাটতে যায় রাজশাহী বিভাগের জয়পুরহাট, নওগাঁ, নাটোর ও বগুড়ায়। ফলে চলতি বোরো মৌসুমে ধান কাটতে চুকল্লু চাচা পথ ধরেছে জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুরে। চুকল্লু চাচার পরনের লুঙ্গিতে বেশ কয়েকটা সেলাই দেওয়া। কাঁধে গামছা আর হাফহাতা শার্ট। হাতে কাছিদাও আর কাঁধে বাঙ্গকুয়া অর্থাৎ লোহার তৈরী কাছিদাও যা দিয়ে ধান কাটা হয় এবং বাঁশের তৈরী বাঙ্গকুয়া যা ধানের বোঝা বাড়িতে আনা হয়। তার পকেটে কয়েকশত টাকা। এগুলো নিয়ে কাজের সন্ধানে তিনি নিজ গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য জেলার কোনো এক গ্রামে। দিনমজুর হিসাবে গেরস্ত বাড়িতে কাজ করেন। যা মাইনে পায় তা দিয়ে তার পরিবারের স্ত্রী ও চারসন্তানের কাপড়চোপড় ও লেখাপড়ার খচর চালান। ট্রেনের মধ্যে বসে চাচাকে অনেক প্রশ্ন করেছি তিনি উত্তর দিয়েছেন ‘বিধাতা মোক কপালে, নেখেছে মুই কামলা। গেরস্ত বাড়িতে গদর খাটি, মুই ডোমারিয়া কামলা। মুই কপাল জোরে করে, ভাবতে ভাবতে কামোত যাওঙ্ক। মোর নিত্য দেনের সাথী। গামছা, বাঙ্গকুয়া আর কাছিদাও। বাহে চাচা, মোর মাথা হ্যাঙ্ক, পানিত বিঘা বিঘা ধান। ধান কাটিম ভার উভামিম। বাড়িত টাকা আনিম কিস্তি দিম। বাহে চাচা! মুই একটা কাথা কবার চাওঙ্ক। দ্যাশে এত তেলে দাম ক্যানে বাহে, মুই বেটা, বেটি, মাইয়াক নিয়ে মুই খাইম কেমন করে? মুই চিন্তা করির নাপাওঙ্ক, মোর চুল পাঁকছে বয়স হয়েছে।’ তার কথা গুলো উত্তরবঙ্গের রংপুর অঞ্চলের ভাষা।
পাঠক বুঝতে কষ্ট হলেও চুকল্লু চাচা বুঝাতে চেয়েছেন যে তিনি ভোর ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ধান কাটার কাজ করে দিনে ১ হাজার থেকে ১২ শ টাকা পান। টাকার অঙ্কটা একটু বড় মনে হলেও একবার ভাবুন তো একজন মানুষ এভাবে যদি দিনরাত মিলে প্রায় ১৮ ঘণ্টা কাজ করেন। দেশে শ্রমআইনের ৮ ঘণ্টা বাস্তবে কী আদৌও কার্যকর আছে? রাষ্ট্রযন্ত্র কতটা উদাসীন হলে বছরের পর ধান কাটা শ্রমিকেরা এভাবে যন্ত্রমানব হয়ে থাকবে। টানা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করার ফলে বড়জোর তারা ২০ থেকে ২৫ দিন কাজ করতে পারেন। মাস শেষে চাচার পকেটে আসে বিশ থেকে পঁচিশ হাজার টাকা। দুই মৌসুমে বাইরে আসেন ধান কাটতে। তাহলে দুই মৌসুমে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে সংসারের খরচ চালাতে হয় বছর জুড়ে। বাস্তবে ওই টাকা দিয়ে তার সংসার চলার কথা নয়। হঠাৎ পরিবারের কোনো সদস্যের বড় ধরনের রোগে আক্রান্ত হলে টাকার অভাবে ভালো ডাক্তারের দ্বারায় চিকিৎসা করতে পারে না। বাধ্য হয়ে বিভিন্ন এনজিও’র কাছ থেকে লোন নিয়ে ধুকে ধুকে জীবন কাটায়।
স্বাধীনতার ৫১ বছরের বাংলাদেশে চুকল্লু চাচার মত কোটি কোটি দিনমজুরের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় নি কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্র কখনও পরিবর্তন করতেও চায়নি। নীরবে ঘাতকের মত নীরবে শোষিত হয়েছে। ফলে দিনের পর দিন ধনী গরিবের বৈষম্য বাড়ছে। কোটি পতির সংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি সর্বহারা ও ছিন্নমূল মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে যারা সভ্য মানুষের মুখে অন্ন জোগান দেয় তারাই আজ অসভ্য। এমনি কী চাষাভুষা মফিজ নামে উপাধি পায়! এ লজ্জা দিনমজুরের নয় এ লজ্জা জাতির। আরও উদ্বিগ্ন হতে হয় যখন সারাদেশে ফসলের মাঠগুলোতে পানি জমে পাকা ধান নষ্ট হয়ে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে কৃষকের। বৃষ্টির পানিতে ডুবে যাওয়া ধান পচে চারা বের হচ্ছে কিছু জমিতে। এতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। ফসল রক্ষায় অতিরিক্ত অর্থ খরচ করেও এই বৃষ্টিতে মিলছে না শ্রমিক। ফলে ক্ষেতেই পচে যাচ্ছে ধান।
রাষ্ট্রযন্ত্র ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাঠামোগত সহিংসতা ধানচাষীরা। তাই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে করে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে কৃষকের ধান কাটা ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতি ইউনিয়নে ক্রয় কেন্দ্র খুলে সরকার নির্ধারিত দামে উৎপাদক কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতে হবে। ময়শ্চার বা ভেজা অজুহাতে কৃষকের ধান কেনা বন্ধ না করে প্রয়োজনে খাদ্য গুদাম বা ক্রয়কেন্দ্রে ড্রায়ার মেশিনে ধান শুকিয়ে উৎপাদক কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতে হবে। মোট উৎপাদিত বোরো ধান পর্যাপ্ত পরিমাণ সরকারি উদ্যোগে কিনতে হবে। খাদ্য গুদাম সংকট হলে পর্যাপ্ত পর্যাপ্ত খাদ্য গুদাম অথবা সাইলো নির্মাণ করতে হবে। আপদকালীন সময়ে বেসরকারি রাইস মিল বা চাতালের গুদাম ভাড়া নিতে হবে। গ্রাম এবং শহরে সার্বজনীন রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। দিনমজুর ও শ্রমজীবী মানুষের চিকিৎসা বিনামূল্যে করতে হবে। সয়াবিন তেল সহ নিত্য পণ্যের দাম কমায়ে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে হবে।
বাজার সিণ্ডিকেটকারী কালোবাজারি ও টিকিট কালোবাজারিদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ফলে কৃষকের স্বপ্ন যেন জলে ডুবে না যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। রাষ্ট্রকে মনে রাখতে হবে কৃষক বাঁচলে বাঁচবে দেশ।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি
কামলার জীবন ও সংগ্রাম আমরা কি বুঝি মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ