Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কবি নজরুলের সাম্যের বাঁশি বেজে উঠুক বিশ্বজুড়ে

রাশেদুজ্জামান রাশেদ
২৫ মে ২০২২ ১৯:১৩

পৃথিবীতে মানবজাতির বসবাস। ভাবুন তো মানুষের জন্য পৃথিবীকে বসবাসের উপযুক্ত করতে কতই না ত্যাগ তিতিক্ষা আর সংগ্রাম করতে হয়েছে। যারা পৃথিবীকে বদলে দিয়ে গিয়েছেন তারাই পৃথিবীতে স্মরণীয় হয়ে থাকবে- পৃথিবী যত দিন টিকে থাকবে ততদিন। পৃথিবীর মানুষ বিশেষ করে বাঙালিদেরকে মনুষ্যত্ববোধের শিক্ষা দিয়েছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম যা বাঙালি জাতির অনন্য দলিল হিসাবে থাকবে।

রেলওয়ে স্টেশনে কিংবা বাসস্ট্যান্ডে কোনো কুলি মজুরকে যখন দেখি মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পেটে অন্ন জোগায় দিনের পর দিন শোষিত হয় ঠিক তখনি কবি নজরুলকে মনে পড়ে যায়। জরাজীর্ণ দেহ নিয়ে যখন দেখি ভিখারি ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দুয়ারে দাঁড়ায়ে- তখনও কবি নজরুলকে মনে পড়ে। যখন দেখি ধর্মের গর্ব করে ভিন্ন মতের মানুষের গায়ে আগুন দিয়ে পুড়ে মারে ঠিক তখনি কবি নজরুলকে মনে পড়ে যায়। যখন দেখি ফুটপাতে না খেতে পড়ে থাকে, হিন্দু বলে কেউ মুখে খাবার তুলে দেয় না ঠিক তখনি কবি নজরুলকে মনে পড়ে।

বিজ্ঞাপন

কবি নজরুল বাঁশি বাজাতেন। কেমন ছিল সেই বাঁশির সুর? বাঁশির সুরে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম গেয়েছেন সাম্যের গান, দুনিয়ার মজলুমের অধিকার চেয়েছেন বাঁশির সুরে, সে বাঁশি বাজে আজি কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতী, কামার, কুমারের ঘরে। প্রথাগত কুসংস্কারের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িকতার সুরে, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই মানুষ পরিচয় দিয়ে গেছেন। শাসকের বন্দীত্বের শিকল ভেঙে দিয়েছে বাঁশির সুরে। সমাজের প্রত্যেক মানুষের কর্তব্য আজি নজরুলের বাঁশি বাজিয়ে মানবসভ্যতা গড়ে তুলি। কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঁশির সুরে বলেছেন-
‘গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে
সব বাধা-ব্যবধান।
যেখানে মিশেছে
হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলিম, খ্রিস্টান।’

বিজ্ঞাপন

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রথমে পৃথিবীকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন তার পর পৃথিবীকে বদলাতে চেষ্টা করেছেন। তিনি যখন দেখলেন পৃথিবীতে মানুষ মানুষকে শোষণ করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলে, তখন তিনি সাম্যবাদী চেতনার আদর্শ প্রতিফলন করতে চেয়েছিলেন তার বাঁশির সুরে সাম্যের গান দিয়ে। তিনি যখন দেখেন জমিদার ও মহাজনদের বাড়িতে কৃষকের নির্যাতিত কণ্ঠ তখন কবিতার শব্দ ছিল বিদ্রোহের। কাটমোল্লা কিংবা ধর্মের নামে লেবাজ পরা মৌলবাদীরা যুগে যুগে সাধারণ নিরীহ মানুষ বোকা বানিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিল করে এসেছিল। অসহায়, নির্যাতিত, নিপীড়িত জনগণকে পবিত্র কালি ও কলম দিয়ে উদ্বুদ্ধ করেছেন কেমন করে কালপিটদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হয়।

জন্মেছি সবুজ শ্যামল সোনার মত দেশে। চারিদিকে মায়া বন্ধনে ঘেরা বাঙালির দেশে। জন্মে দেখি প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য দেশে তো বঠেই। তবে তা হয়ে গেছে মগের মুল্লুক। তাই বলি ভাই, জন্মেছি শোষণের দেশে, শোষণ আর শাসন মিলে পুঁজিবাদীদের উন্নয়ন ঘটে। বড় হয়েছি দুঃখের সঙ্গে সংগ্রাম করে। কষ্ট মানুষকে কেমন করে কঠিন করে তা বুঝলাম জন্মের পর থেকে। চারপাশে ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার। এমন কথা হঠাৎ বললাম যে কারণে তা হলো আজ যেই মানুষটার ১২৩তম জন্মবার্ষিকী পালিত হচ্ছে এ বাংলা থেকে ওপার বাংলায়। কে সেই মানুষ, কী বা তার জন্ম পরিচয়, কেন তাকে নিয়ে মহাকাব্য? দারিদ্র্যকে সঙ্গে করে যিনি বড় হয়েছেন তিনি হলেন, সাম্যের কবি, জাতীয় কবি, বিদ্রোহী কবি, মানবতার কবি, মানব মুক্তির পথ দেখানোর কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

দুঃখ ছিল তার নিত্য সঙ্গী বলেই তার ডাক নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। তিনি ১৮৯৯ সালের ২৫ মে বাংলা ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মে ছিলেন। কবির পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ ও মাতা জাহেদা খাতুন। পিতা ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম। কবি শৈশব থেকেই লেটো দলের বাদক, রুটির দোকানের শ্রমিক এভাবেই পেরিয়ে গেছে তার শৈশব–কৈশোর। পরে কাজ করেছেন সৈনিক হিসেবে। সাংবাদিকতা করেছেন। কাজ করছেন এইচএমভি ও কলকাতা বেতারে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে পথে নেমেছেন। পাশাপাশি সাহিত্যসাধনা তো প্রখর। শাসকের কোপানলে পড়েছেন, কারারুদ্ধ হয়েছেন কিন্তু নত হয়নি নজরুলের উচ্চ শির।

কবি নজরুল জীবন সংগ্রাম, অভাব-অনটন, নানা প্রতিকূলতা, জেলজুলুম ও হুলিয়ার মধ্যেই তার সাহিত্যচর্চার সময় ছিল মাত্র ২৪ বছর (১৯১৯-১৯৪২)। এর মধ্যে তিনি লেখেছেন ২২টি কাব্যগ্রন্থ, সাড়ে তিন হাজার, মতান্তরে সাত হাজার গানসহ ১৪টি সংগীত গ্রন্থ, তিনটি কাব্যানুবাদ ও তিনটি উপন্যাস গ্রন্থ, তিনটি নাটক, তিনটি গল্পগ্রন্থ, পাঁচটি প্রবন্ধ, দুটি কিশোর নাটিকা, দুটি কিশোর কাব্য, সাতটি চলচ্চিত্র কাহিনীসহ অসংখ্য কালজয়ী রচনা।

১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তৎকালীন পিজি (বর্তমানে বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। সেখানেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।

সারা বিশ্বে যখন শোষণ মুক্তির প্রতীক ও শ্রমিক শ্রেণির রাষ্ট্র ‘সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব’ প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন থেকে কবি নজরুলের রাজনৈতিক বিকাশ শুরু হয়। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তাকে নানা ভাবে প্রভাবিত করেন। তার লাঙল ও গণবাণী পত্রিকায় কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল-এর অনুবাদ ‘জাগ অনশন বন্দী ওঠরে যত’ এবং ‘রেড ফ্লাগ’ অবলম্বনে রচিত লাল পতাকার গান প্রকাশিত হয়। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শোষণের শৃঙ্খল আহ্বান জানিয়েছেন কবিতা ও গান লিখেছেন।

অসাম্প্রদায়িক চেতনার অনন্য বাতিঘর ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। পৃথিবীতে ক্রান্তিলগ্নে নজরুলের লেখা প্রাসঙ্গিকতা এখনও রয়েছে। বসবাসের উপযুক্ত পৃথিবী যত দিন যাচ্ছে ততই যেন অযোগ্য হয়ে পড়ছে। করোনা ভাইরাসে সংক্রমণের ফলে মৃত্যুর মিছিল দেখল বিশ্ববাসী। চলছে এখনও যুদ্ধ। যে যুদ্ধ বিভিন্ন দেশের সংকট তৈরী করছে। বড় সংকট তৈরি হয়েছে মানবতা।

সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়ে দেশকে করা হচ্ছে ক্ষত-বিক্ষত। ভিন্ন ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ আর নারীর প্রতি অন্যায়-অবিচার-নির্যাতন-ধর্ষণের মাত্রা বেড়েই চলছে। মানুষে মানুষে ভালোবাসার বড় অভাব। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নিঃস্বার্থ ভালোবাসাকে স্বার্থের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে পুঁজির জন্য মানুষে মানুষে মারামারি হানাহানি যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগেই আছে। মানব জাতির এই সংকট মুহূর্তে কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাম্যের বাঁশি আর অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতিঘরের আলো ছড়ায়ে পৃথিবীকে করবে শান্ত, মানুষ হবে মনুষ্যত্ববোধের, মানুষের মাঝে থাকবে না কোনো হিংসা, বিদ্বেষ।

সমাজে কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ও কূপমণ্ডূকতাকে দূর করে একটি সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। তাই রাষ্ট্রের উচিত কবি নজরুলের লেখা সংকুচিত করা নয় বরং ব্যাপক পরিসরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে দেওয়া। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্ত করতে কবি নজরুলের সাম্যের বাঁশি বেজে উঠুক বিশ্বজুড়ে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

কবি নজরুলের সাম্যের বাঁশি বেজে উঠুক বিশ্বজুড়ে মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর