Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ময়মনসিংহ যেন ছিনতাইকারীদের শহর

আরিফুল ইসলাম
২৯ মে ২০২২ ১৮:০১

দুপুর একটা বেজে কয়েক মিনিট, নগরীর নজরুল সেনা বিদ্যালয়ের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন শফিক(ছদ্মনাম)। এসময় কয়েকজন ছেলে এসে পথ আগলে দাঁড়ালো এবং মুহুর্তেই সর্বস্ব হারাতে হলো শফিককে। পেটে চাকু ঠেকিয়ে নেশা করার জন্য টাকা চাইলো এই বখাটে ছেলেগুলো এবং প্রাণের ভয়ে শফিক নিজের পকেটে থাকা ৩৫০০টাকা ওদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হলো। বর্তমানে বিভাগীয় নগরী ময়মনসিংহ এর নিয়মিত ঘটনা এই ছিনতাই। আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে আগের তুলনায় আরো বেশি সক্রিয় হয়েছে ছিনতাইকারী চক্রগুলো।

বিজ্ঞাপন

ছিনতাই এই শহরে নতুন কোন ঘটনা নয়, তবে সম্প্রতি ছিনতাইয়ের ঘটনা অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। আগে যেখানে রাতের বেলায় বা সন্ধ্যার পর ছিনতাই হতো এখন সেটা দিনদুপুরেই। ঈদ-সহ অন্যান্য উৎসব ঘনিয়ে এলে অপতৎপরতা বেড়ে যায় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকগুন। আগে শহরের নির্দিষ্ট কয়েকটি স্থানে মাঝেমাঝে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও বর্তমানে যেকোন স্থানে যেকোন সময় হরহামেশাই হচ্ছে ছিনতাই।

কোথায় হচ্ছে?

নগরীর বাঘমারা, ব্রীজ মোড়, পাটগুদাম, বাউন্ডারী রোড, গাঙ্গিনারপাড়, রেলওয়ে স্টেশন ও চরপাড়া এলাকায় পকেটমার ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে অনেক আগে থেকেই। শহরের ব্যস্ততম এই জায়গাগুলোতে বিভাগের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে নিয়মিত লোকসমাগম হয়। তাই দুষ্কৃতিকারীদের টার্গেট থাকে এসব এলাকা। তবে সম্প্রতি শহরের প্রতিটি রাস্তায় ও গলিতে ছিনতাইয়ের কথা শোনা যাচ্ছে। নগরীর চরপাড়া এলাকায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য ক্লিনিক ও ডায়গনস্টিক সেন্টার। এসব হাসপাতাল-ক্লিনিকে চিকিৎসার জন্য শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ সহ উত্তরবঙ্গের অনেক জেলা থেকে মানুষজন এসে ভিড় করেন। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রোগীর সাথে থাকা লোকজনের কাছ থেকে হরহামেশাই ঘটছে ছিনতাই।

কেন হচ্ছে?

মূলত দারিদ্রতাই চুরি, ছিনতাইয়ের প্রধান কারণ হলেও ময়মনসিংহে সবচেয়ে বেশি ছিনতাই এর ঘটনা ঘটে নেশাগ্রস্তদের দ্বারা। নেশা করার জন্য পর্যাপ্ত টাকা না থাকলে কয়েকজন মাদকাসক্ত মিলে তৈরি করছে একেকটি ছিনতাইকারী চক্র। নেশার টাকা পেয়ে গেলেই তারা চলে যায় নেশা করতে, আবার পরেরদিন নেশা করার জন্য তারা একই কায়দায় অন্য কারো কাছ থেকে ছিনতাই করে থাকে। এসব নেশাখোর ছাড়াও বিভিন্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে সক্রিয় হয় নিয়মিত চোর-ছিনতাই-পকেটমার চক্রগুলো। আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষ্যে জনগণ যখন কেনাকাটা সহ বিভিন্ন ধরনের শপিং এর জন্য বের হচ্ছে তখন তাদেরকে টার্গেট করছে এসব চক্র। পরিবারের সদস্যদের জন্য কেনাকাটার স্বপ্নগুলো থেকে যাচ্ছে অধরা।
ছিনতাইয়ের সংখ্যা না কমে বরং বেড়ে যাওয়ার পেছনে আরেকটি প্রধান কারণ হলো বিচারহীনতা। এদেশে যেখানে খুন-ধর্ষণের মতো বড় বড় অপরাধের আসামীরা জামিন পেয়ে ঘুরে বেড়ায় এবং পুনরায় এসব অপরাধে লিপ্ত হয় সেখানে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনার দ্রুত বিচার প্রত্যাশা করা বোকামী ছাড়া কিছু হয়। আর আইনের এই সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে বারবার চুরি-ছিনতাই করে যাচ্ছে এসব চক্র। প্রশাসন কর্তৃক অভিযানের ফলে কিছুদিন ছিনতাই বন্ধ থাকলেও কিছুদিন পর আবারও তারা দ্বিগুন উদ্যমে ছিনতাই করে থাকে। প্রশাসনিকভাবে আইন-প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কার্যকর কোন পদক্ষেপ না নিলে এই অপরাধ প্রবণতা দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে ধারণা করছেন নগরীর সাধারণ মানুষ।

বিজ্ঞাপন

মাদকের সহজলভ্যতা

মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের প্রশাসন জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করলেও কমানো যাচ্ছে না মাদক সেবন ও বিক্রির পরিমাণ। আগে নগরীতে কয়েকটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব মাদক কেনা-বেচা চললেও এখন অলিতে-গলিতে অবাধে পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য। ছোট ছোট সিন্ডিকেট বা খুচরা বিক্রেতার মাধ্যম মাদক পৌঁছে যাচ্ছে সবার হাতের নাগালে। গাঁজা, দেশি মদের পাশাপাশি ইয়াবা, হেরোইন, বিদেশী মদ, গাম, ফেনসিডিল সহ সকল ধরনের মাদকে সয়লাব আমাদের প্রিয় শহরের অলিগলি। তরুণ প্রজন্মের বিপথগামী সদস্যদের বিশাল চাহিদা যোগান দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় মাদক সাপ্লাইকারীদেরও। মাঝেমাঝেই শোনা যায় মাদকের জন্য নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-হাতাহাতির ঘটনা। মাদকের সহজলভ্যতা কমাতে পারলে মাদকসেবীদের দ্বারা সংঘটিত ছিনতাইয়ের সংখ্যা হয়তো কিছুটা কমে আসবে।

জনগণের অভিমত

ময়মনসিংহের জনপ্রিয় অনলাইন কমিউনিটিগুলোতে নিয়মিত প্রতিবাদ জানাচ্ছে তরুণ নাগরিকগণ। ক্ষোভ প্রকাশ করে রুমেল আহমেদ নামের একজন লিখেন পড়াশোনা করে চাকরির পিছনে না ঘুরে ছিনতাইকেই পেশা হিসেবে নেয়া উচিত কেননা এটাই এই শহরের একমাত্র লাভজনক ব্যবসা। জিয়াদ তালুকদার নামের একজন শিক্ষার্থী ছিনতাইমুক্ত ময়মনসিংহ গড়ার দাবী জানিয়েছেন। অন্যান্য নাগরিকগণও চুরি-ছিনতাই প্রতিরোধে পুলিশ, র‍্যাবসহ অন্যান্য প্রশাসনিক উদ্যোগের আহবান জানিয়েছেন। তবে কেউ কেউ জনগণের দিকে আঙ্গুল তুলে তাদের দায়িত্বহীনতাকেও দেখিয়ে দিচ্ছেন। ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো পুলিশকে সাধারণ ডায়েরীর মাধ্যমে জানাতে অনুরোধ করেন তারা। তাহলেই ছিনতাইয়ের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে প্রশাসন অবগত হবে এবং দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে আগ্রহী হবে বলে তাদের ধারণা।

কয়েকটি ঘটনা

এই ছিনতাইয়ের ঘটনা যে শুধু অন্যদের সাথে ঘটছে তা নয়, আমি নিজেও এর ভুক্তভোগী। ২০১৪ সালে আমি সর্বপ্রথম ছিনতাইয়ের শিকার হই, আমার ফোন-মানিব্যাগ সবকিছু ছিনিয়ে নেয়া হয়। এরপর বেশ কয়েক বছর সাবধানে চলাচল করায় এই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়নি। তবে ২০২০ সালে এসে আবারও ছিনতাইয়ের শিকার হতে হয়। আমার সাথে আরো ২ জন ছোট ভাই থাকা সত্ত্বেও ওদের কাছে অহসায় আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিলো। এরপর ২০২১ এবং ২০২২ সালে আবারও ছিনতাইয়ের শিকার হই। সর্বশেষ মাস দুয়েক আগে আমার ছোটবোনের স্মার্টফোন ও টাকা ছিনতাই হয়। থানায় সাধারণ ডায়েরী করেও এর কোন প্রতিকার পাইনি। আমার মতো এমন অনেকেই আছেন যারা বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ জানিয়েও কোন ফল পাননি তাই অনেকেই এখন আর অভিযোগ জানাতে আগ্রহ পান না।

নিহার সরকার নামের একজন শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক চরপাড়া এলাকায় একাধিকবার ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছেন বলে জানান। এছাড়া ২০২০ সালের রমজানে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তৌহিদকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো কতিপয় ছিনতাইকারীদের হাতে। ছুরিকাঘাত করে আহত করা, হাতাহাতির ঘটনা এখানে নিয়মিত ঘটে। তাই প্রাণ ভয়ে সবাই অসহায়ভাবে ওদের হাতে নিজের সাথে থাকা টাকা-পয়সা ও মোবাইল ফোন তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছে। গত সপ্তাহে মুক্তাগাছা থেকে ময়মনসিংহে আসা সাজিদুর রহমান এবং ঈদের কেনাকাটা করতে যাওয়া তাইফ আহমেদ নগরীর নতুন বাজার রেল ক্রসিং এলাকায় দিনদুপুরে ছিনতাইয়ের শিকার হন অথচ আশেপাশে থাকা কোন মানুষ ভয়ে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।

জনগণের দাবি

প্রভাবশালী চক্র ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বারবার পার পেয়ে যাওয়া এসব ছিনতাইকারীদের অত্যাচারে অতিষ্ট নগরবাসী সিটি করপোরেশনের মেয়র, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, রেঞ্জ ডিআইজি, গোয়েন্দা সংস্থা সহ সংশ্লিষ্ট সকলের কাছে ছিনতাই থেকে বাঁচার আকুতি জানিয়ে বলেন- আমাদের সবার প্রিয় এই শহরকে যারা কলুষিত করছে তাদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এদের এহেন কার্যক্রমের জন্য ময়মনসিংহ সম্পর্কে যেন কারো মনে নেতিবাচক ধারণা জন্মাতে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করতে দেয়া যাবে না। নগরবাসী চুরি-ছিনতাইমুক্ত শান্তিপ‚র্ণ একটি শহর গড়ার জন্য সকলের প্রতি অনুরোধ জানান।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, ই-মেইল: ariful.cse9.knu@gmail.com

সারাবাংলা/এজেডএস

আরিফুল ইসলাম ময়মনসিংহ যেন ছিনতাইকারীদের শহর

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ইনজুরিতে মৌসুম শেষ রদ্রির
২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১০:২৮

সম্পর্কিত খবর