ফিরে দেখা: মহামারির বর্ণহীন দিনগুলোর বাস্তবতা
৩১ মে ২০২২ ২০:৩২
বইপত্র, সংবাদ মাধ্যমের কল্যাণে পৃথিবীতে আসা মহামারীর তথ্য আমরা সহজেই জানতে পারছি বর্তমান সময়ের তরুণ প্রজন্মরা। মানুষের দুঃখ দুর্দশা দেখে প্রাণও কেঁদে উঠছে বারবার। যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে জন-মানবের এমন বিপর্যয় আর কবে কোন শতকে হয়েছে তা জানতে হয়তো লেগে যেতে পারে কয়েকদিন। এর উত্তর হয়তো অজানাও থেকে যেতে পারে।
আমাদের এই উন্নয়নশীল দেশে করোনা’র প্রভাব চোখে পড়ার মতো অন্যান্য আধুনিক রাষ্ট্র এবং তাদের ধন-সম্পদ প্রতিপত্তির কাছে। এখানে যানজটের কারণেই প্রতিদিন নষ্ট হয় কয়েক ঘন্টা করে কর্মঘন্টা, আর অর্থনৈতিকভাবে এর মূল্য দাঁড়ায় কয়েক হাজার কোটি টাকার। এখন ভাবার বিষয়, সবকিছু স্থবির এখন দেশে তাহলে এই কয়েকমাসে কতো হাজার হাজার কোটি টাকা জলের সাথে মিশে গেল।
আমাদের পাড়া-মহল্লা গুলোতে খোঁজ করলে দেখা মিলবে প্রায় প্রতিটি পরিবার থেকে কেউ না কেউ পোশাকশিল্পের সাথে জড়িত এবং প্রতিবছর ঈদে এবং জাতীয় উৎসবগুলোতে বেতন-ভাতা বোনাস সহ ঘরে ফিরতো হাসিমুখে। করোনাকালীন অনেক পোশাকশিল্প মালিক বেতনই দিতে পারেননি তাদের শ্রমিকদের। হয়তো বিদেশে রপ্তানি বন্ধ তার অন্যতম এবং প্রধান কারণ। এই পোশাকশিল্প সীমিতসংখ্যক ভাবে খুলে দেয়ার কারণে যেমন রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাবে শতগুণে তেমনি একে রোধ করা সাধ্যের বাইরে চলে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। এসব কারণে ঈদে তাদের ঘরে না জুটেছে সেমাই-চিনি না জুটেছে একটু খাবার।
নতুন পোশাকের কথা না হয় বাদই দিলাম। উত্তরবঙ্গের খেটে খাওয়া মানুষদের কথা সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই উপক্ষিত হয়ে আসছে। বিংশ শতাব্দীর এই বাংলাদেশে তার পরিবর্তন ঠিক কতোটুকু হলো তার চিত্র একটু আশেপাশে তাকালেই বোঝা যাবে। একাল সেকালের এই পার্থক্যটা একেবারেই সীমিত। বাপ-দাদার যাদের কৃষিজমির পরিমাণ বেশি তারা বছর ঘুরলে তাও কিছু ফসল ঘরে তুলতে পারছেন। কিন্তু যাদের সম্বল বলতে বাড়ি-ভিটে তারা এই মহামারীতে কেমন আছেন বুঝতে পারলাম সাহায্য পৌঁছে দেওয়ার সেবায় নিজেকে নিযুক্ত করে তাদের তালিকাভুক্ত করতে আনাচে কানাচে ঘুরে তাদের আঙ্গিনায় উপস্থিত হয়ে।
একজন গৃহকর্তার পরনে বহুজায়গায় সেলাই করা লুঙ্গি যা ঈদের পর ঈদ যায় তবুও তা পরিবর্তন করার সাধ্য তার নেই। গৃহকর্ত্রীর পরনেও ময়লা ছেড়া কাপড় সেটাও বা কোনো ঈদে কারোর যাকাতপ্রাপ্ত। আধুনিক যুগে যেখানে জমি চাষ করার জন্য পাওয়ার টিলারের মতো যন্ত্র ব্যবহার সেখানে কারো সংসারে অন্ন জোটে গেরস্ত বাড়ির গরু দিয়ে হালচাষ করে। অন্যান্য সময় অন্যের জমিতে শ্রম দিয়ে। এরকম একজনের সাথে যখন কথা বলে ফিরছিলাম তখন আর চোখের পানি লুকোয় রাখতে পারিনি। শুধু এটুকু জানতে চেয়েছিলাম, “কেমন আছেন? কেউ সাহায্যের হাত বাড়ালো কিনা?” জবাব যেটা আসলো সেটা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। ” হামার বাড়িত একদিন ইউনিয়ন পরিষদের নোক আশি নেকি নিয়ে গেল আর কয়া গেল দশ শের করি নাকি চাইল পামো। কোটে কি। পরে শুননু পাশশো টেকা করি নিয়ে নাকি চাইলের বস্তা দিচে হামাক আর ডাকে নাই।” তাদের নাম সাহায্যের তালিকাভুক্ত করে নিলাম।
ছাত্রাবস্থায় উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন যখন টিউশনী সেটা বন্ধ থাকায় তারপরও কিছু হাতে দিয়েই বিদায় নিলাম সেই বাড়ি থেকে। আবার আরেকটি পরিবার নজরে আসলো। আকাশে মেঘ করে আসলে কেউ আনন্দিত হয় বৃষ্টিবিলাস করার জন্যে আর এই পরিবার ভীত অবস্থায় দিন কাটান। বৃষ্টি আসলে খড়ের চাল দিয়ে পানি ভিতরে টুপটাপ করে পড়ে যে একটা চৌকি তাও ভিজিয়ে দেয়। কর্তা প্রতিবন্ধী তিনবছর থেকে। খাবার পানি অন্যের বাড়ির টিউবওয়েল থেকে এনে খেতে হয় তাদের। তার অবস্থা জানতে চাওয়া হলে তিনি বললেন, ” ক্যানকা করি খাই বাবা, মাইষের থাকি চাইল হাওলাত করি আনি খান নাকছি। পতিবন্ধি ভাতা পাবার কতা তাক ক্যানা আর খোঁজে নাই, চেয়ারমেনোক কতো করি কনু মোর জন্যে একনা কিছু উপায় করি দ্যান। কয়া গেল দিবে। আর দ্যাখা নাই। ” তিনি ভেবেছিলেন হয়তো সরকারী লোক হিসেবে নাম লিখে নিতে এসেছি। পরে বুঝিয়ে বলার জন্য চোখের পানি ফেললো। অসহায় এই মানুষগুলো প্রতিনিয়ত চেয়ে থাকেন কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে তাদের দেখতে। এরকম আরো শ’খানেক পরিবার পাওয়া গেল যাদের এই মহামারীতে না শুধু স্বাভাবিক দিনেও দুবেলা খাবার জোগাড় করার মতো সামর্থ হয়ে উঠে না। প্রায় প্রতিটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষ থেকে ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের দেশের, পাড়া-মহল্লার এই নিবেদিত প্রাণ তরুণ-যুবকরা। কেউবা পৌঁছে দিচ্ছে প্রয়োজনীয় নিত্য-সামগ্রী, কেউ বা ঔষধপত্র যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুলই বলা চলে। সমাজে ধনি ব্যক্তিরা এগিয়ে না আসলে আসলে সে সমাজে তাদের থাকা না থাকা একই কথা। সমাজে দুস্থ মানুষরা আছে জন্যেই সম্পদের মাপকাঠি দিয়ে তুলনা করেই তারা উঁচু স্থানে বসে আছে। তাদেরকেও এগিয়ে আসতে হবে তাদের প্রতিবেশীদের কল্যাণে। এই উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে করোনা কতোটা মহামারী আকারে ধারণ করতে পারে তা আশেপাশে অসাবধনতা দেখতেই আন্দাজ করা যায়। সেখানে একটু পরপর সাবান দিয়ে হাত ধোয়া কঠিনতম একটা সজ্ঞায় পরিণত হয়েছে। সরকারকেই এসব বন্দোবস্ত করার এবং পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিতে হবে। নদীমাতৃক এই বাংলাদেশে বন্যা লেগেই আছে। সেই বন্যা যদি হয় ধান পাকার আগে আগে তখন কৃষকের ভেতরের আর্তনাদ বুঝবার মতো প্রতিনিধি কবে বাংলাদেশের মানুষ পাবে আমরা বরং সেই সময়ের অপেক্ষা করি।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এজেডএস