মাংকিপক্স: সতর্কতা জরুরি
১ জুন ২০২২ ১৮:৩২
করোনাভাইরাসের ধকল কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বিশ্ববাসীর জন্য হুমকি হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে মাঙ্কিপক্স। বৃটেন সহ ইউরোপের অনেক দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইসরাইলে দেখা দিয়েছে এই পক্স বা বসন্ত। বিশ্বের ১১টি দেশে অন্তত ৮০ জনের দেহে এ ভাইরাস শনাক্ত করা গেছে। মাঙ্কিপক্স ভাইরাস দ্বারা এই রোগের সৃষ্টি হয়। জলবসন্ত সৃষ্টি করে যে ভাইরাস, সেই একই পরিবারের সদস্য এই ভাইরাস। তবে এর ভয়াবহতা অনেকটা কম। প্রাণঘাতী না হলেও মাঙ্কিপক্সে কেউ আক্রান্ত হলে ত্বকে থেকে যায় ক্ষতচিহ্নের দাগ।
জায়েরে বা কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে ১৯৭০ সালে প্রথম মানুষের মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়। ওই দেশের নয় বছর বয়সী ছেলের মধ্যে পাওয়া যায় মাঙ্কিপক্স। সাধারণত এই রোগ দেখা দেয় রেইনফরেস্ট এলাকার কাছে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোর প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এই ভাইরাসের দুটি স্ট্রেইন আছে। তাহলো পশ্চিম আফ্রিকান এবং মধ্য আফ্রিকান। প্রথমেই এই রোগের লক্ষণগুলোর মধ্যে আছে জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ফুলে যেতে পারে, ব্যাকপেইন, মাংসপেশীর ব্যথা, নিঃরস ভাব। জ্বর কমে যাওয়ার পর শরীরে র্যাশ বা ফোসকার মতো দেখা দিতে পারে। কখনো কখনো তা মুখে প্রথম দেখা দিতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এসব ফোসকা দেখা দেয় হাতের তালুতে এবং পায়ের পাতায়। এসব র্যাশ ভয়ঙ্কর রকম চুলকায় এবং বেদনাদায়ক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর পরিবর্তন ঘটে। বিভিন্ন সময় এর বিভিন্ন রকম চেহারা দেখা দিতে পারে। চূড়ান্ত দফায় মাঙ্কিপক্স পরিণত হতে পারে পাঁচড়ায়। পরে আস্তে আস্তে ঘা শুকিয়ে যায়। কিন্তু তাতে ত্বকে যে ক্ষত সৃষ্টি হয় তা ভয়াবহ। এই সংক্রমণ নিজের থেকেই সেরে যায় ১৪ থেকে ২১ দিনের মধ্যে।
১৯৭০ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১১টি আফ্রিকান দেশ- বেনিন, ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, গ্যাবন, আইভরি কোস্ট, লাইবেরিয়া, নাইজেরিয়া, সিয়েরা লিওন এবং দক্ষিণ সুদানে মানুষের মাঝে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়েছে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ শনাক্ত হয়; যা ছিল প্রথমবারের মতো আফ্রিকার বাইরে কোনো দেশে এই রোগের সংক্রমণ। সংক্রমিত প্রাণীর রক্ত, শারীরিক তরল পদার্থ, ত্বকের ক্ষত বা শ্লেষ্মার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের ফলে প্রাণী থেকে মানুষের মাঝে এই রোগ ছড়ায়। সংক্রমিত রোগীর শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে, ত্বকের ক্ষত থেকে এবং নাক, মুখ ও চোখের ভেতর দিয়ে এই ভাইরাস মানুষ থেকে মানুষের মাঝে ছড়ায়। শ্বাসযন্ত্রের ড্রপলেটের মাধ্যমে সংক্রমণে সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী ফেস টু ফেস যোগাযোগের প্রয়োজন হয়। যা স্বাস্থ্যকর্মী, পরিবারের সদস্য এবং সংক্রমিত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠদের যোগাযোগকে বেশি ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। সাধারণত এই রোগের উপসর্গ দুই থেকে চার সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মাঙ্কিপক্স রোগ মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। যাদের লক্ষণ আছে এমন ব্যক্তির সঙ্গে সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে এটি হচ্ছে। মাঙ্কিপক্স সংক্রমিত কারো ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এলে সেটা অন্যের দেহে ছড়াতে পারে। ফাটা বা কাটা চামড়া, চোখ, নাক বা মুখ দিয়ে মানুষের দেহে ঢুকতে পারে মাঙ্কিপক্স। মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব এমন সব দেশে ঘটছে যেখানে এ ভাইরাসটির স্বাভাবিক আবাসস্থল নয়। আর মাঙ্কিপক্সে যারা সংক্রমিত হচ্ছেন তাদের অনেকেই সমকামী বা উভকামী যুবক। ডব্লিউএইচওর সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ডেভিড হেম্যান জানিয়েছেন, এটি যৌন সংক্রমণের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ছড়িয়েছে। এটা যৌনবাহিত রোগের মতোই সংক্রমিত হচ্ছে, যা ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী। আর আক্রান্তদের বেশিরভাগেরই যৌনাঙ্গ এবং তার আশপাশের জায়গায় গুটি হতে দেখা যাচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেন সমকামী-উভকামী পুরুষরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন তা স্পষ্ট নয়। এটা কি শুধুই ঘটনাচক্রে এমন হচ্ছে, নাকি যৌন আচরণের ফলে ভাইরাসটি সহজে ছড়াতে পারছে- তাও স্পষ্ট নয়।
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কঙ্গো প্রজাতির প্রাদুর্ভাব অত্যন্ত গুরুতর। ওই অঞ্চলে কঙ্গো প্রজাতিতে আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার ১০ শতাংশের বেশি। আর এতে বাচ্চাদের মৃত্যুর শঙ্কা বেশি। অন্যদিকে, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতির তীব্রতা তুলনামূলক কম। এই প্রজাতিতে আক্রান্তদের মৃত্যুর হার এক শতাংশের মতো। মহামারি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ সাধারণত ‘একেবারে বিরল’। যুক্তরাষ্ট্রের রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (সিডিসি) মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ বৃদ্ধির বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সতর্ক করে বলেছে, পর্তুগাল ও স্পেনের প্রাদুর্ভাবের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যেও এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এরিক ফেইগল-ডিং বলেছেন, ‘এটা একেবারে অস্বাভাবিক। তারপরও লোকজন বলছে, এটা ঠিক ফ্লুর মতো, এছাড়া কিছু নয়।’
মাঙ্কিপক্সের কোনো চিকিৎসা নেই। কিন্তু সংক্রমণ প্রতিরোধ করার মাধ্যমে এর প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। তবে গুঁটিবসন্তের টিকা এক্ষেত্রে শতকরা ৮৫ ভাগ কার্যকর বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। বলা হয়েছে, শতকরা ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রে মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধ করে গুটিবসন্তের টিকা। এরই মধ্যে বৃটেন গুটিবসন্তের টিকা কিনেছে। তবে তার মধ্যে কতগুলো প্রয়োগ করা হবে তা নিশ্চিত নয়। এক্ষেত্রে ভাইরাস বিরোধী ওষুধও সহায়ক হতে পারে।
মাঙ্কিপক্স প্রাণঘাতী না হলেও এটি যে বিরক্তিকর ভাইরাস তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। শিশুদের ক্ষেত্রে পক্সটি তুলনামূলকভাবে বেশি ক্ষতিকর। দুনিয়াজুড়ে মাঙ্কিপক্স ঝুঁকি সৃষ্টি করলেও এটি এমন এক ভাইরাস যা সহজে চিহ্নিত করা যায়। চিকেন পক্স বা গুটি বসন্তের টিকা নিলে এ ভাইরাস থেকে ৮৫ ভাগ সুরক্ষা মেলে। তবে দুনিয়াজুড়ে গুটি বসন্ত নির্মূল হয়ে যাওয়ায় এ ভ্যাকসিনের সরবরাহ একেবারে সীমিত। আফ্রিকা থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে। বানর, কাঠবিড়াল, ইঁদুরের মাধ্যমে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। মাঙ্কিপক্সে আক্রান্তের সংখ্যা একেবারে সীমিত। ফলে আতঙ্কে না ভুগে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। বিশেষ করে বিদেশ থেকে আগতদের ব্যাপারে থাকতে হবে সতর্ক।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি