অর্থনীতিতে সতর্কতা অবলম্বন করতেই হবে
৩ জুন ২০২২ ১৪:৫৯
বিশ্বব্যাপী মরণব্যাধি করোনাভাইরাসের পর শুধু অর্থনৈতিক কেন মানুষের মনোজগতেও বিরাট একটা ধাক্কা লেগেছে । পৃথিবীব্যাপী জনস্বাস্থ্যের বিরাট ক্ষতি করে গেছে মরণঘাতী কোভিড-১৯ সাথে নিশ্চিতভাবে অর্থনীতির। ধনী-দরিদ্র, পরাশক্তি,স্বল্পশক্তি,কোন শক্তিই এ আঘাত থেকে রেহাই পায়নি। এর রেশ কাটতে না কাটতেই রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ পৃথিবীকে আবার টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে । এই যে বড় বড় পরাশক্তিদের নিজেদের প্রেস্টিজ ও শক্তিমত্তা ঠিক রাখতে যুদ্ধের মতো অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহন করে তার কুফল ভোগ করতে হয় সমগ্র মানবজাতিকে। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট এই দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠা তাই কারো কারো জন্য বা কোন কোন দেশের জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। বলা চলে এ এক সম্মিলিত বিপর্যয়। যেখান থেকে উৎরাতে হবে সম্মিলিতভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। কোভিড পরবর্তী বিশ্ব পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব দেশকেই সবার জন্য সাধ্যমত এগিয়ে আসতে হবে। বৈশ্বিক এই সমস্যা কোন দেশের একার না। এর মোকাবেলা করার শক্তিমত্তা সব দেশের একও না।
কোভিড যেতে না যেতেই মানবসৃষ্ট আরেক দুর্যোগ রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কার দোষ কার দোষ না এ বিচারে না গেলেও সমগ্র বিশ্বের লক্ষকোটি মানুষের যে কোন চাওয়াই ছিল না এই যুদ্ধ, তাতে কোন সন্দেহ নাই। তাহলে তাঁরা কেন উৎকন্ঠিত, ক্ষতিগ্রস্ত এ প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশ্ব রাজনীতির ঘোর প্যাঁচে কোন দেশ কোনো না কোনো দেশের সাথে বন্ধুত্বে বা ঘনিষ্ঠতায় অথবা স্বার্থসংশ্লিষ্টতায় জড়িয়ে আছে। কিন্তু হলফ করে বলা যায় এতে সাধারণ মানুষের কোন চাওয়া নেই। তাঁরা তাঁদের মত তাঁদের দেশে নিরাপদে নির্বিঘ্নে শান্তিপূর্ণভাবে সুন্দর জীবনযাপন করতে চায়। তারা বড়জোর যুদ্ধের খবর পরে উদ্বেলিত হয় কিন্তু কোনভাবেই যুদ্ধের অংশ হতে চায় না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় চার যুগ আগে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে দীপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন”আমরা শান্তি চাই,শান্তি আমাদের কাম্য বিশ্ববাসীর কাম্য, ঐ সব বৃহৎ শক্তিবর্গকে বলি অস্ত্রের মহড়া বন্ধ করে সেই অর্থ নিপীড়িত মানুষের জন্য ব্যয় করুন,কারণ বুলেট শুধু রক্ত ঝরাতে পারে,পারে না কোন নিরণ্নকে অন্ন দিতে”। এতদিন পরে এই কথা এখনো শতভাগ প্রযোজ্য।
ইউক্রেন যুদ্ধের এই ডামাডোলে ও কোভিড পরিস্থিতির পর উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বা ক্ষেত্রবিশেষে উন্নত দেশেও অর্থনীতির অবস্থা খারাপ যাচ্ছে। দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষকরে দক্ষিণ এশিয়ার তুলনামূলক দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলো কিছুটা সংকটে পড়েছে। এক্ষেত্রে স্ব স্ব দেশের কিছু ভুল অর্থনৈতিক পলিসিও দায়ী। বর্তমানে এর প্রকৃষ্ঠ উদাহরন সার্কভুক্ত দেশ শ্রীলঙ্কা। প্রায় আড়াই কোটি লোকসংখ্যার পর্যটন অর্থনীতি নির্ভর এই দেশটি এখন অফিসিয়ালি দেউলিয়ার পথে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর শিক্ষিত এই দ্বীপ রাষ্ট্রটির অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল পর্যটন খাত। সাথে ছিল বিদেশি রেমিটেন্স ও কিছু দেশজ সম্পদ। মোটাদাগে কোভিড কালীন সময় থেকে অনিবার্যভাবে পর্যটন খাতে বিপর্যয় ও শাসকগোষ্ঠীর বিলাসিতা ও কিছু ভুল অর্থনৈতিক পদক্ষেপের কারনে বা ঋণ করে ঘি খাওয়ার কারণে ও ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ আমদানি নির্ভর দেশ হিসেবে শ্রীলঙ্কার এই অবস্থা তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। কোভিডকালীন পরবর্তী এই দেশটির অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের প্রথম এই দেশটি থেকে অন্যান্য দেশের কিছু শিক্ষা নেয়া বা সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত এবং এতে কোন দোষের কিছু নাই।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশও সেই একই অবস্থায় পড়তে যাচ্ছে তাতে বর্তমান সরকারের অবস্থাও শ্রীলঙ্কার সরকারের অবস্থার মত হবে ভেবে যাদের চেহারায় রোশনাই দিয়েছে বা যারা পুলকিত বোধ করছেন তারা সরকারের বিরোধিতা করতে গিয়ে সরকারের অমঙ্গল কামনা করতে গিয়ে দেশেরই অমঙ্গল কামনা করছেন। আল্লাহ না করুক এই দেশের শ্রীলঙ্কার মত অবস্থা হলে বর্তমান সরকার পরে যাবে বা বর্তমান সরকারের অবস্থা শ্রীলঙ্কার সরকারের মত হবে আর তথাকথিত বিরোধী এই অপশক্তিগুলো ক্ষমতার মসনদে বসে দেশ উদ্ধার করে ছাড়বে এইসব যারা ভাবছে তারা প্রকৃত অর্থে দেশপ্রেমিক না দেশের মঙ্গল চায় না। তারা যেকোন প্ৰকারে বর্তমান সরকারের পতন চায় এবং যেকোন উপায়ে ক্ষমতায় যেতে চায়। তারাও জানে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থা আর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এক না। যে শ্রীলঙ্কার বর্তমান অবস্থার সাথে অনেকেই বাংলাদেশকে মেলাচ্ছেন সেই শ্রীলঙ্কাকে কিছুদিন আগে বাংলাদেশ প্রথমবারের মত বিশ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল। বাংলাদেশ কোন সময় শ্রীলঙ্কার মত হবে না। বাংলাদেশের অর্থনীতি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি থেকে অনেক মজবুত। এই মজবুতের কারণও ভিন্ন। বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান খাত কৃষি। কোভিডকালীন সময়ে ও তারপরে অদম্য গতিতে এগিয়ে যাওয়া তৈরি পোশাক খাতসহ অন্যান্য রপ্তানিখাত ও বিপুল পরিমাণ বিদেশি রেমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি। কোভিডকালীন সময়েও এসব খাতে সরকারের দূরদৃষ্টি সম্পন্ন পদক্ষেপে অর্থনীতি তার গতিশীলতা আগের মতোই ধরে রেখেছিল। হঠাৎই ইউক্রেন রাশিয়ার যুদ্ধ অনেককিছু আমদানি নির্ভির এই দেশে অন্যান্য দেশের মত আমদানি করা অনেক পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে হয়তো কিছুটা চাপে ফেলেছে। এসব বিষয়ে সরকার নিশ্চয়ই উদাসীন না বরং অনেকটা সতর্ক, সচেতন।
বড় বড় প্রকল্পের সফল বাস্তবায়ন ও সময়মতো বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ধারাবাহিকতা ঠিক রাখা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রাখা ও জিডিপি বা দেশজ উৎপাদন সন্তোষজনক পর্যায়ে রাখা গতিশীল অর্থনীতির পরিচয় বহন করে। পাশাপাশি রপ্তানি ও কৃষিখাত পরিপূর্ণভাবে সচল থাকায় অন্যকোন দেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সাথে কোনভাবেই বাংলাদেশের অর্থনীতি মেলানো যাবে না। তবে একথা ঠিক অন্যের খারাপ অবস্থা দেখে নিজের স্বার্থে শিক্ষা নেয়া বা সতর্ক হওয়া দোষের কিছু নাই বরং তা হবে নিজের জন্য মঙ্গলজনক। বর্তমান বাস্তব অবস্থায় সেই সতর্কতা শুধু বাংলাদেশ কেন এরকম অর্থনীতির প্রায় সব দেশই নিচ্ছে বা নেয়া উচিত। বিরোধীরা কি বলছে বা না বলছে অথবা কি উদ্দেশ্যে বলছে এসবের ধার না ধারলেও একটি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যে বিশ্ব চলছে তাকে আমলে নিয়ে আমাদেরকে আরো অধিক সতর্কতা ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই পরিস্থিতিকে সফলভাবে মোকাবেলা করতে হবে।
ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ,অপ্রয়োজনীয় বিলাসী পন্য আমদানির লাগাম টেনে ধরা,সরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর বন্ধ করতে হবে। এই মুহূর্তে অপ্রয়োজনীয় বড় প্রকল্প গ্রহণ না করা, বিদেশে টাকা পাচার কঠোর হস্তে দমন করা এবং দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। সরকারি পর্যায়ে থেকে কম অভিবাসন খরচে অন্ততঃ পক্ষে আরো পঞ্চাশ লক্ষাধিক লোককে বিদেশ প্রেরনের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। যারা ইতিমধ্যেই বিদেশে আছে তাঁদের ঐসব দেশে থাকার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। হুন্ডি বাদে সরকারি ভাবে বিদেশ থেকে প্রেরিত রেমিটেন্স দেশে আনার কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। দক্ষ ও কর্মমুখী জনবল তৈরি করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি রপ্তানিখাত ও কৃষিখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আরো বেশি সচল ও কার্যকর রাখতে হবে। সর্বত্র কৃচ্ছতা সাধন করতে হবে। দ্রব্য মূল্যের উর্ধগতির লাগাম টেনে ধরতে হবে। সন্তোষজনক রাজস্ব আদায় করতে হবে। আসছে বাজেটে সরকার এ বিষয়ে নিশ্চয়ই পদক্ষে গ্রহণ করবে। নিন্দুকের কথায় কান না দিয়ে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে ও আগামীর যেকোন বিশ্ব সংকটে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় ও মজবুত করতে সব ধরনের সতর্কতামূলক ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সতর্কতা ও অন্যের যেকোন খারাপ পরিস্থিতি থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেরা ভালো থাকায় দোষের কিছু নাই। বরং শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি দেখে আমাদের আরো সতর্কতা অবলম্বনে দোষ কি? হয়তো সরকার এই বিষয়ে যথেষ্ট সতর্কই। যা হওয়াই উচিত।
লেখক: কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ
সারাবাংলা/এজেডএস