Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করমুক্ত আয়ের সীমা ৫ লক্ষ টাকা করা হোক

আনোয়ার ফারুক তালুকদার
৮ জুন ২০২২ ১৪:৩৩

আগামী ৯ জুন ২০২২ সালে জাতীয় সংসদে পেশ হতে যাচ্ছে ২০২২-২৩ সালের বাজেট। পত্র পত্রিকার খবরে জানা গেছে এ বছরের বাজেট হতে যাচ্ছে ৬ লক্ষ ৭৯ হাজার ৩৫০ কোটি টাকার মত। বরাবরের মত এবাবের বাজেটও বিশাল অঙ্কের ঘাট দাঁড়াচ্ছিল ঠিক তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যেন সবকিছু তছনছ করে দিচ্ছে। দেশে দেশে মুদ্রাস্ফীতি মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। লাফিয়ে লাফিয়ে কমছে মুদ্রার মান।

আমাদের দেশে বিগত কয়েকদিনের মধ্যে টাকার মান অফিসিয়ালি কমতে কমতে ৬ জুন তারিখে ৯১ টাকা ৯৫ পয়সায় উঠেছে। মানুষের ক্রয় ক্ষমতা চরমভাবে কমে যাচ্ছে। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্রের দাম বাড়ছে। দরিদ্র থেকে মধ্যবিত্তের প্রতিদিনের বাজারে কাটছাঁট করতে হচ্ছে। অর্থনীতি দুরাবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যে সুখবর হচ্ছে ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর শুভ উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে এই পদ্মা সেতুর দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোর অর্থনীতির পালে বেশ হাওয়া লাগবে। তাতে করে দেশের উন্নয়নে বেশ জোরালো ভূমিকা রাখবে এটা প্রায় নিশ্চিত করে বলা যায়।

বিজ্ঞাপন

দেশের এই প্রেক্ষাপটে আমাদের বাজেট ঘোষিত হতে যাচ্ছে, যদিও ইতিমধ্যে বাজেট কেমন হওয়া উচিত তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। আমি শুধু একটি বিষয়ের উপর জোর দিতে চাই। তাহলো জনগনের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর উপায়। যদিও বর্তমানে বেতন বাড়ানো হয়তো চ্যালেঞ্জিং হবে। সেক্ষেত্রে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর উপায় হচ্ছে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো।

গত আট অর্থবছরের বাজেট বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে করমুক্ত আয়ের সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩ লক্ষ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে করমুক্ত আয়ের সীমা ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে করমুক্ত আয়ের সীমা ছিল দুই লাখ ২০ হাজার টাকা। এর আগে ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২ লাখ টাকা ও ২০১৩-১৪ তে ছিল ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। অবশ্য ২০১৫-১৬ পর প্রতি অর্থবছর গড়ে ৫ শতাংশের বেশি মূল্যস্ফীতি থাকলেও করমুক্ত আয়সীমা তেমন বাড়ানো হয়নি। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় এ সীমা বাড়াতে পেশাজীবী, ব্যবসায়ী সংগঠনসহ সব মহল থেকে এবারও দাবি জানানো হয়েছে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত করমুক্ত আয়সীমা দ্বিগুণ বাড়িয়ে ৫ লাখ রুপি করেছে। এমতাবস্থায় আয়করে বর্তমানে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়সীমা ৩ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লাখ টাকা করার জোর দাবি আসছে বিভিন্ন মহল থেকে।

বিজ্ঞাপন

প্রসঙ্গত, চলতি অর্থবছরে ব্যক্তিশ্রেণির করমুক্ত আয়ের সীমা ৩ লাখ টাকা। এর বেশি বার্ষিক আয় থাকলে এলাকাভেদে ন্যূনতম ৩-৫ হাজার টাকা আয়কর দেয়ার বিধান আছে। মহিলা ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের ৩ লাখ টাকা, প্রতিবন্ধী করদাতারা ৪ লাখ টাকা ও গেজেটভুক্ত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা করদাতারা ৪ লাখ ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়করমুক্ত। বর্তমানে এলাকাভেদে ন্যূনতম কর হারে পার্থক্য আছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের জন্য ন্যূনতম কর ৫ হাজার টাকা, অন্য সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ৪ হাজার টাকা এবং জেলা শহরের করদাতাদের ৩ হাজার টাকা কর দিতে হয়।

অন্যদিকে আয় অনুযায়ী কর নির্ধারিত আছে। ৩ লাখ টাকার পরবর্তী ১ লাখ টাকার জন্য ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৩ লাখের জন্য ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৪ লাখের জন্য ১৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লাখের জন্য ২০ শতাংশ এবং অবশিষ্ট আয়ের ওপর ২৫ শতাংশ হারে কর নির্ধারিত আছে। আমরা কেন ব্যাক্তিশ্রেনির করসীমা বৃদ্ধি করতে বলছি তার কারণ নিম্নে সন্নিবেশ করছি-

ব্যাক্তিশ্রেনির করসীমা ৩ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লক্ষ টাকায় উন্নীত করা হোক। আমাদের দেশের একটি পরিবার চালাতে আয় করেন মাত্র একজন। গড়পড়তা পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪-এর উপরে। তার উপর বাবা, মা, ভাইবোনদের প্রায়শই সংসার চালানোর খরচ দিতে হয়। এতে করে ধরি একজন লোকের আয় বাড়িভাড়ার খরচ ছাড়াও মাসে যদি ২৫ হাজার হয় তবে তাকে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হয়। তাই ২৫ হাজার টাকা বেতনের একজন লোকের পক্ষে আয়কর দেয়া দিবাস্বপ্নের মত। আবার বাড়িভাড়ার বিষয়ে রয়েছে জটিল হিসাব । মাসে ২৫ হাজার টাকা বাড়িভাড়া বা বছরে ৩ লক্ষ টাকা একজন লোক কর অব্যাহতি পায়। কিন্তু যার বাড়ি ভাড়া বাবত আয় মাসে ২৫ হাজারের কম তার জন্য এখানে রেয়াতের বিষয় থাকছে না। তাই আমাদের প্রস্তাব সাধারণ মানুষের অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ৫ লক্ষ টাকার সাথে বাড়ি ভাড়ার ৩ লক্ষ টাকা ব্যক্তিশ্রেনির কর মুক্ত সীমার মধ্যে আনা হোক। আমাদের করমুক্ত সীমা শুরু হয় ৩ লক্ষ টাকা থেকে এবং করহার শুরু হয় ৫ শতাংশ থেকে এবং ৫ শতাংশের ক্ষেত্রে মাত্র ১ লাখ টাকা রাখা হয়েছে, এটাকে কমপক্ষে ৫ লক্ষ টাকায় উন্নীত করা হোক।

দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে করমুক্ত সীমা এবং কর হারের দিক থেকে শ্রীলংকার পরে বাংলাদেশের অবস্থান। তাই পার্শ্ববর্তী দেশ এবং দেশের মানুষের জীবনে স্বস্তি দিতে ন্যূনতম করমুক্ত সীমা ৫ লক্ষ টাকা হওয়া সময়ের দাবী। আমরা পাশাপাশি কর হারের নিম্নলিখিত পরিবর্তন আনার প্রস্তাব করছি। ৫ লক্ষ উপর থেকে ৫ লক্ষ পর্যন্ত ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ৭ দশমিক ৫ শতাংশ, পরবর্তী ৬ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ১০ শতাংশ, পরবর্তী ৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ১৫ শতাংশ এবং সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ রাখার জোর দাবী জানাচ্ছি।

বেশী কর আদায়ের জন্য করদাতার সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। প্রতিটি জেলা উপজেলায় করজাল বিস্তৃত করতে হবে। উপজেলা এবং গ্রাম পর্যায়ে এখন এমন অনেক ব্যাক্তি আছেন যারা এখনও করের আওতায় আসেননি। তাদের কর জালে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। অনেক বাড়িওয়ালা, পেশাজীবী, ডাক্তার- প্রচুর আয় করেন। তাদের আয়কে করের আওতায় আনা যেতে পারে। করের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কর প্রদানে আগ্রহী উদ্যোক্তাদের উপর অতিরিক্ত বোঝা না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়ানো উচিত। আমাদের ১৮ কোটি মানুষের দেশে বর্তমানে ৭৫ লাখের বেশী কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী নাগরিক রয়েছেন এবং তাদের মধ্যে নিয়মিত রিটার্ন দাখিল করেন ২৫ লাখের মত করদাতা। কর আদায় আরও সহজ করতে হবে। করহার কমিয়ে করের আওতা বাড়ানোকে উৎসাহিত করে সফল হলে মোট কর রাজস্ব অনেক বাড়বে। কর প্রশাসনকে উপজেলা পর্যন্ত বিস্তৃত করার কথা বিবেচনা করা যায়।

কর আদায়ে অর্থনীতিবিদ স্মিথের চারটি নীতিহলো- করদাতা সামর্থ্য অনুযায়ী কর দেবে। কখন, কীভাবে ও কত কর দেবে, তা করদাতার জানা থাকবে। করদাতা সুবিধাজনক সময়ে কর দেবে এবং কর সংগ্রহের ব্যয় সর্বনিম্ন হবে। এইনীতিগুলো বাস্তবে পরিণত করলে কর আদায় বাড়বে বলেই আমাদের বিশ্বাস। বিদ্যমান করদাতাদের উপর করের বোঝা না চাপিয়ে বরং নতুন নতুন করাদাতা বাড়ানোর এবং প্রগতিশীলহারে কর আদায়ের পরিমাণ বাড়ানোর উপর জোর দেয়া উচিত বলে বেশীরভাগ অর্থনীতিবিদরাই মনে করেন। এছাড়া নিয়মিত করদাতাদের জন্য ভবিষ্যতে সর্বজনীন পেনশন সুবিধায় আনার চিন্তা ভাবনা শুরু করা যেতে পারে। তাতে করে করদাতারা আরও উৎসাহিত হবেন বলে আশা করা যায়।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় ব্যাপক হারে বেড়েছে। কিন্তু সেই হারে দেশের করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়নি। মূলত কর ছাড় দিয়ে নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতেই করমুক্ত আয়সীমা একলাফে দ্বিগুণ করেছে ভারত। আমাদেরও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ফি বছর করমুক্ত সীমা বাড়ানো উচিত। আমরা আশা করছি মাননীয় অর্থমন্ত্রী আমাদের দাবিগুলো বিবেচনায় নিয়ে করের নিম্নসীমা এবং করহার সমন্বয় করবেন।

লেখক: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

আনোয়ার ফারুক তালুকদার করমুক্ত আয়ের সীমা ৫ লক্ষ টাকা করা হউক মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর