Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন নিম্ন-মধ্যবিত্তরা

মো. রায়হান আলী
৮ জুন ২০২২ ১৮:০৮

দীর্ঘ দুবছর করোনার ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে এখন কিছুটা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। প্রাণন্তর প্রচেষ্টা করে যাচ্ছি কিভাবে সংসারের হাল পূর্বের ন্যায় ফিরে পাই। কিভাবে সংসারের অর্থনৈতিক ফিল্ড পরিচর্যা করা যায়, সেটা নিয়েই ব্যস্ত। সংসারে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দতা না থাকলে পরিবার ও সমাজের কাছেও তেমন দাম, মান-মর্যাদা থাকে না। তখন সমাজের কাছে হতে হয় যশ-খ্যাতিহীন এক ব্যক্তি মাত্র। কবির ভাষায় তখন বলতে ইচ্ছে হয় অভাব যখন দরজায় এসে দাঁড়ায়, ভালবাসা তখন জানালা দিয়ে পালায়। পরিবারের কাছে যতই প্রিয় হোন না কেন, সাজতে হয় তখন আমরা কাঁঠের ঢেঁকি!

বিজ্ঞাপন

সব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করেও যখন চিন্তা করছি পরিবারের সুখের কথা তখন আবার গুড়ে বালি, অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বমুখী দাম। দিশেহারা মন, সংসার চালানোর কোন পরিকল্পনাই যেন আর কাজে আসছে না। শুরু হয়েছে নাভিশ্বাস! একদিকে করোনায় হারিয়েছে চাকুরী, অন্যদিকে নতুন কর্মসংস্থানের খোঁজে দিশেহারা। তারপরেই রয়েছে নিত্যপণ্যের ক্রয় ক্ষমতার সীমার চিন্তা। মোটামুটিভাবে যে যেভাবে পাড়ছে পরিবার নিয়ে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে।

বিজ্ঞাপন

সব চেষ্টারেই যেমন একটা সীমা থাকে তেমনি এটারও একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অভাব আর দারিদ্র্যের কশাঘাতে জনজীবন দুঃখ ও হাহাকারে একাকার। সাধারণ মানুষের ওপর চেপে বসেছে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির অভিশাপ। নিত্যপণ্যের প্রতিটি জিনিসের অগ্নিমূল্য। চাল, ডাল, আটা, মাছ, মাংস, তেল, শাক-সবজি, ফলমূল, চিনি, লবণ, গম, আটা, রুটি, বিস্কুট ইত্যাদি দ্রব্যের মূল্য আগের তুলনায় কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েক দফা বিদ্যুৎ,গ্যাসের দামও বেড়েছে। কোনটার দাম বাড়ছে না এমন পণ্য খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর এমন প্রশ্ন জনমনে।

নিম্নমধ্যবিত্তরা যেন নিত্যপণ্যের চড়া দামের কাছে তারা অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে। জেঁকে বসেছে তাদের চেহারায় হতাশার ছাপ, দুশ্চিন্তার ছাপ। কিভাবে এ সংসারের গুরুদায়িত্ব পালন করবে এটা নিয়ে বিপাকে পড়েছে। ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও মেটাতে পাড়ছে না পরিবার, সন্তান ও অধিনস্তদের মৌলিক চাহিদা। ভাল স্বভাবের মানুষটাও একসময় দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে প্রতিবাদী বা চড়াও হয়। পরিবারের সাথে ভাল আচরণ করার ইচ্ছা থাকলেও এমন কারনে মেজাজ হয়ে যাচ্ছে খিটমিটে। অনিচ্ছাকৃতভাবে নিয়ন্ত্রণহীন আচরনের দিকে দিন দিন ধাবিত হচ্ছে অনেক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পরিবার প্রধান। যার ফলে পারিবারিক সহিংসতা বাড়ছে। সেই সাথে নানান অপরাধ নারী নির্যাতন, সামাজিক অবক্ষয়মূলক অপরাধের হার ঊর্ধ্বমুখী।
সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থা ও সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে অপরাধপ্রবণতা বাড়ে-কমে বলে উল্লেখ করেছেন সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। তিনি বলেছেন, দেড় বছর ধরে অতিমারির কারণে সামাজিক অস্থিরতাগুলো বেড়েছে। মানুষের দারিদ্র্য কিছুটা হলেও বেড়েছে। কর্মজীবী মানুষের আয়-উপার্জন কমে গিয়েছে। এসব কারণেই কিন্তু দেখা যায়, পারিবারিক সহিংসতাগুলো বৃদ্ধি পেয়েছে”।(সূত্রঃ প্রথম আলো, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২১)।

গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলছে, মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় চাপে পড়েছে গরীব মানুষ আর এ অবস্থায় তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উচ্চমূল্য নিয়ন্ত্রণ করাই বাংলাদেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে শুধু বাংলাদেশই নয়, গত এক যুগের মধ্যে পুরো বিশ্বই এখন সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির সামনে আছে। আর বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ার কারণ হিসেবে প্রধানত করোনাভাইরাস মহামারির প্রভাব, ইউক্রেন যুদ্ধ, জ্বালানী তেলের উচ্চমূল্য, পরিবহণ খরচ ব্যাপক বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে। আর এমন সুযোগ হাতছাড়া করছেন না অসাধু মজুদদার সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীরা। পণ্যের অবৈধ মজুদে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ভোক্তাদের জিম্মি করছে। তাই বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন সাধারণ মানুষজন।

২০০০ সালে বাংলাদেশে দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০০৫ সালে তা নেমে এসেছিল ৪০ শতাংশে। এরপর ক্রমান্বয়ে দারিদ্র্যের হার কমে গিয়েছিল। তারপর কোভিড পরিস্থিতির আগে সরকারি হিসাবে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু করোনা মহামারিতে কত মানুষ নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে, এর কোনো সরকারি সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার মহামারি শুরুর আগে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশের মোট আয়ের ৭ দশমিক ৭২ শতাংশ করত ২০ শতাংশ দরিদ্র মানুষ। আর ১৫ দশমিক ৮২ শতাংশ করত শীর্ষ ধনীদের ৫ শতাংশ। কিন্তু করোনার প্রভাবে দরিদ্রদের আয় কমেছে। বেড়েছে ধনীদের আয়। এখন দেশের মোট আয়ের ১৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ করেন ধনী ৫ শতাংশ মানুষ। দারিদ্র্য ২০ শতাংশ মানুষ এখন আয় করেন ৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ। বর্তমান পরিস্থিতে দরিদ্রতার হার দেশের সার্বিক অর্থনীতির প্রতিকূলতার কারনে অনেকাংশে বেড়ে গেছে।

প্রকৃতিগত সমস্যার মোকাবেলা করে নতুন করে সংসারের পরিচর্যা করা নিম্নমধ্যবিত্তের গলায় কাটার মত হয়ে গেছে। এত সমস্যার পরেও সিলেটের হাওর অঞ্চলের মানুষজন ডুবছে বন্যার পানিতে। কৃষকদের স্বপ্ন ভাসতে বানের পানিতে। হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানির নিচে। স্বাভাবিক জীবন-যাপনে সংশয় বিরাজ করছে তাদের। এমনিতেই কৃষি প্রধান এ দেশে কৃষকদের প্রাকৃতিক নানান কূল-প্রতিকূল অবস্থার মধ্যদিয়ে ফসল ফলাতে হয়। সার্বিক দিক বিবেচনায় কৃষকরাও ভাল নেই।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি ড.আবুল বারকাতের এক গবেষণা প্রতিবেদনে প্রাপ্ত তথ্য মতে, করোনা প্রতিরোধে সরকার ঘোষিত লকডাউনের আগে দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে দরিদ্র ২০ শতাংশ, মধ্যবিত্ত ৭০ শতাংশ ও ধনী ছিল ১০ শতাংশ। লকডাউনের পর দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৪০ শতাংশ, মধ্যবিত্তের হার কমে ৫০ শতাংশ এবং ধনীর হার আগের মতো ১০ শতাংশ রয়েছে। অর্থাৎ,করোনার থাবার মধ্যেও ধনীর হার ১০ শতাংশ অপরিবর্তিত রয়েছে। কিন্তু মধ্যবিত্তের ২০ শতাংশের আয় কমে তারা দরিদ্রের মধ্যে চলে গেছে। ফলে মধ্যবিত্তের হার ২০ শতাংশ কমেছে। দারিদ্র্যের হার ২০ শতাংশ বেড়ে ৪০ শতাংশ হয়েছে। করোনার এক বছরে দেশের ১৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ মানুষের জীবনমান নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৬০ লাখ ধরলে করোনার প্রভাবে দুই কোটি ৪৫ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছেন। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা ও করোনা পরবর্তী দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারনে এর হার হয়তবা আরো কয়েকগুন বেড়ে গেছে।

আমাদের দেশের মানুষ এখন অনেক কিছু কূল-প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও জীবন-যাপনে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। দেশের মানুষের বহুমাত্রিক সমস্যাগুলি হয়তবা দীর্ঘতর হবে না। সমস্যাগুলি নিরসনে সরকার নানান পদক্ষেপে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সরকারকে আরো দ্রুত পদক্ষেপ ও পর্যবেক্ষনের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের লোকজনের উদ্ভুত সমস্যাগুলি চিহ্নিত করে তা নিরসনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি সাধারণ জনগণকেও সমস্যাগুলি নিরসনে সচেষ্ট থেকে এগিয়ে নিতে হবে দেশের অর্থনৈতিক চাকা।

লেখক: আইনজীবী জজ কোর্ট, খুলনা
email: [email protected]

সারাবাংলা/এজেডএস

বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন নিম্ন-মধ্যবিত্তরা মো. রায়হান আলী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর