নিরাপত্তা আইনে অনিরাপদ
১২ জুন ২০২২ ১৫:২২
অস্তিত্ব টিকে রাখার জন্য কে-ই না নিরাপদ জায়গা খোঁজে? পৃথিবীতে যে ছোট্ট প্রাণীটি সেও নিরাপদ জায়গা খোঁজে নেয়। সারাদিন এক গাছ থেকে আরেক গাছের ডালে খাবারের সন্ধানে কিংবা জীবনের তাড়নায় ঘুরাঘুরি শেষ হলে পাখি ঠিকই রাত কাটানোর জন্য নিরাপদ জায়গা খুঁজে নেয়। প্রচন্ড তাপে জলীয়বাষ্প হয়ে মেঘে গিয়ে নিজেকে অনিরাপদ মনে করে দিনশেষে বৃষ্টি হয়ে সমুদ্রের বুকে নেমে যায়। কারণ পানি নিরাপদ স্থান সমুদ্রকেই মনে করে। অন্যান্য জীবের চাইতে মানুষের নিরাপদ জায়গা বেশি প্রয়োজন। কারণ পৃথিবী এখন মানুষের দখলে, মানুষের শাসনে শাসিত হচ্ছে পৃথিবী। মানুষের মতো অন্য কোনো জীব এতো সম্পদ সঞ্চয় করে না, ক্ষমতার দাপট দেখায় না। মানুষের মতো আর অন্য কোনো জীব নিজেকে ক্ষমতার উৎস প্রমাণ করার, পৃথিবীর সবকিছুই তার করে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নামে না। মানুষ এসবে নেমেছে এবং প্রতিনিয়ত নামছে বলেই নতুন নতুন আইন কানুনের প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে।
সমাজে তথা রাষ্ট্রে আইনের প্রয়োজন যে একেবারেই নেই তা বলাটা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। কিন্তু কিছু কিছু আইন তৈরি হয়েছে যা নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে গিয়ে হাজারো মানুষের বাকস্বাধীনতার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যেই আইনে নিজেকে নিরাপদ রাখতে গিয়ে অগণিত মানুষ অনিরাপদ হয়ে পড়ছে, যেই আইনে নিজের কথার নিরাপত্তা দিতে গিয়ে হাজারো মানুষের সত্য বলার বাকস্বাধীনতা খর্ব হচ্ছে সেই আইনের আদতে প্রাসঙ্গিকতা আছে কি? আইন যদি মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য না হয়ে সম্মিলিত মানুষের জন্য হয়ে থাকে তবে এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আর আইনে থাকেনি বরং বেআইনে পরিনত হয়েছে।
মানবসভ্যতার ইতিহাস থেকে জানা যায় মানুষ আগে এরকম সভ্য ছিলো না। আজকে যে পুঁজিবাদী সমাজে বসবাস করছি এই পর্যায়ে আসতে সমাজকে চারবার পরিবর্তিত হতে হয়েছে তথা মানুষ পরিবর্তন করেছে। আদিমগোষ্ঠিবদ্ধ সমাজ থেকে মানুষ দলবদ্ধভাবে বসবাস শুরু করে। তখন মানুষ এরকম অত্যাধুনিক জীবনযাপন করতো না। মানুষ থাকতো বনে-জঙ্গলে, পাহাড়-পর্বতে কিংবা গুহায়। তারা সবাই খাদ্য শিকারে অংশগ্রহণ করতো এবং এক জায়গায় রেখে সমানভাবে বণ্টন করতো। সাম্য চিন্তা থেকে বের হয়ে মানুষ যখনই ব্যক্তি চিন্তায় ঢুকলো তখনই মানুষের ব্যক্তি নিরাপত্তার কথা ভাবনায় আসলো। সমাজ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে জগৎ পরিবর্তন হয়ে আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক হয়েছে। ফলে আদিম সমাজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা আর এখনকার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা আকাশ-পাতাল।
সমাজের নিরাপত্তার জন্য সামাজিক আইন তৈরি হয়েছে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য সংবিধান তৈরি হয়েছে আবার রাষ্ট্রের বাইরে গেলে পররাষ্ট্রনীতি তৈরি হয়েছে। ডিজিটালাইজেশনের ফলে তৈরি করা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। সাংবাদিকেরা বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ফেঁসে যাচ্ছে, রাজনৈতিক নেতারা জনগণকে সচেতন করতে গিয়ে কিংবা গণমানুষের দাবি আদায়ের মিছিলে গেলে জেলে ঢুকতে হচ্ছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ব্যক্তি কেউই নিরাপত্তা আইনে নিরাপদ না।
সমাজের বিত্তবান বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি প্রকাশ করলেই সংবাদকর্মীদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হচ্ছে। দেশের প্রচলিত দণ্ডবিধি আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এসব মামলা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংবাদিক ফজলে এলাহীকে নিরাপত্তা আইনে মামলার কারণে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কারণ এলাহী আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ফিরোজা বেগম চিনুর দুর্নীতির খবর প্রচার করেছিলেন। এলাহীকে গ্রেপ্তার করার সময় ফেইসবুকে লিখে গেছেন, ‘ফিরোজা বেগম চিনু ও তার মেয়ের মামলায় আমার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার ওয়ারেন্ট দেখিয়ে থানায় নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। সাংবাদিকতার এই প্রতিদান? আমার মৃত্যুর জন্য চিনু ও তার মেয়েকে দায়ি করে গেলাম।’ এলাহীর এমন জীবন শঙ্কায় পড়া লেখনির মধ্য দিয়ে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকসহ প্রতিবাদী মানুষেরা কতটা অনিরাপদ।
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস)এর মতে, আইনটি চালু হওয়ার পর থেকে কথিত সাইবার অপরাধ সম্পর্কিত দায়ের করা মামলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১৩ সাল থেকে প্রাথমিকভাবে তথ্য ও যোগাযোগ আইন- এর অধীনে এবং পরবর্তী সময়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে সাইবার ট্রাইব্যুনালে করা মোট মামলার সংখ্যা ৪ হাজার ৬৫৭টি। এর মধ্যে ৯২৫টি মামলা দায়ের করা হয়েছে ২০১৮ সালে। ১ হাজার ১৮৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছে ২০১৯ সালে এবং ২০২০ সালে দায়েরকরা মামলার সংখ্যা ১ হাজার ১২৮টি। ১ জানুয়ারি ২০২০ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ সাল পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর অধীনে ১ হাজার ৫০০টিরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভিন্নমতের বিরুদ্ধে এ কঠোর আইন ব্যবহার করেছে।
২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২৬ মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মোট মামলা হয়েছে ৮৯০টি। এতে আসামি করা হয়েছে ২ হাজার ২৪৪ জনকে। এর মধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে ৮৪২ জনকে। অভিযুক্তদের শীর্ষে রয়েছে রাজনীতিবিদ। যার সংখ্যা ২৫৪ জন। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সাংবাদিক। নিবর্তনমূলক আইনের আওতায় এই সময়ে ২০৭ জন সাংবাদিককে অভিযুক্ত করা হয়। সিজিএস এর মতে, ২৬ মাসের মধ্যে ১৪ মাসের হিসাব পৃথকভাবে উপস্থাপন করে বলা হয়, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ৪২৬টি মামলায় প্রায় ৯১৩ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এদের মধ্যে আটক করা ২৭৩ জন। প্রতি মাসে গড়ে আটকের হার ছিল ১৮ জন। অন্যদিকে পরবর্তী ১১ মাসে ৪৬৪টি মামলায় ১ হাজার ৩৩১ জনকে অভিযুক্ত করা হয় এবং আটক করা হয় ৬০৯ জনকে। প্রতিমাসে গড়ে ৬৭ জনকে আটক করা হয়। ক্যালেন্ডারে মাস এবং বছরের সংখ্যা যত বাড়ছে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতারের সংখ্যা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ৯৪ ভাগ সাংবাদিক যখন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে অনিরাপদ মনে করছেন তখন এই আইন বাতিলের দাবি যৌক্তিক নয় কি? না কি গণমানুষের কথা চিন্তা না করে মুষ্টিমেয় মানুষের দুর্নীতি, লুটপাট, একনায়কতন্ত্র কায়েম করার হাতিয়ার হিসেবে এই আইন যৌক্তিক?
আমরা যারা মুক্তচিন্তা প্রকাশের জন্য কলাম লিখছি তারাও আজ নিরাপত্তা আইনে অনিরাপদ। এই আইন হওয়া উচিৎ ছিল দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাট, ক্ষমতার দাপটের বিরুদ্ধে যারা কথা বলে সংবাদ প্রচার করে তার উপর আক্রমণ আসলে সেই আইন প্রয়োগ করা। কিন্তু আমরা দেখছি ঠিক তার উল্টোটা।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জনমনে ভীতির সঞ্চার করছে। এ আইনের মারপ্যাঁচে গ্রেপ্তার করা হয় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সিরাজুম মুনিরাকে, লেখক মুশতাক, কার্টুনিস্ট কিশোরসহ অনেক শিল্পী, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীকে। রাষ্ট্রদ্রোহ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও মানহানি-এই তিনটির মতো অস্পষ্ট বিষয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার বেশি হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি জনগণের স্বার্থে নয়, শাসকদের স্বার্থে করা হয়েছে। তাই অবিলম্বে এই আইন বাতিল করতে হবে।
লেখক: কলাম লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি