পদ্মা সেতু হতে চলেছে দারুণ এক গেম চেঞ্জার
১৬ জুন ২০২২ ১৮:০১
বর্তমানে আমাদের প্রজন্মটা আক্ষরিক অর্থেই একটা বিভ্রান্তির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেক লম্বা সময় ধরে ঔপনিবেশিক শোষণের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে আমাদের পূর্বের প্রজন্ম একটা পর্যায়ে পশ্চিমা দর্শনকেই নিজেদের দর্শন হিসেবে ধরে নিয়ে বসে আছে। আশির দশক থেকে শুরু করে বর্তমানে বেড়ে ওঠা দের অধিকাংশই প্রাচ্যের ধারণাকে ভুলে গিয়ে পশ্চিমা ধারণাকে নিজেদের ধারণা হিসেবে মনে ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় পাশ্চাত্য সভ্যতায় ড্রাগণকে হিংস্র পশু হিসাবে ভালো চোখে দেখা হয় না। কিন্তু প্রাচ্য দর্শনে ড্রাগণকে সকল প্রাণীর আত্মার সম্মিলনে (চীনা পুরাণ মতে ৯ টি প্রাণীর সম্মিলনে ড্রাগন গঠিত) সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে ভক্তিভরে দেখা হয়৷ ঠিক একইভাবে পশ্চিমা দর্শনে ‘সাদা হাতি’ অলাভজনক বা অপচয়ের কারণ বুঝায়; যেখানে প্রাচ্য বা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রাচীন কাল থেকে সাদা হাতি সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে৷
পৃথিবীর পশ্চিমাংশে হাতি নেই, এটি সনাতন ভাবেই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সম্পদ। এই দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে সাদা হাতির রয়েছে সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব । সাদা হাতিকে মহামতি গৌতম বুদ্ধের অবতার মনে করা হয়; আর তাই বৌদ্ধ ধর্মীয় মতে সাদা হাতি খুব শুভ বলে বিবেচিত হয়। কথিত আছে- মায়াদেবী বুদ্ধকে জন্ম দেওয়ার আগেই একটি সাদা হাতির স্বপ্নে দেখেছিলেন। ভারতীয় সনাতন ধর্মেও হাতির গুরুত্ব অপরিসীম । সনাতন হিন্দু ধর্ম মতে স্বয়ং মহাদেব সাদা হাতির বেশে মর্তে অবতরণ করেছিলেন। ঐরাবত নামে যে সাদা হাতিটি সম্পর্কে আমরা কমবেশি সকলেই শুনেছি, সেটি স্বর্গের রাজধানী অমরাবতীর প্রবেশদ্বার এর রক্ষী ও ইরাবতীর সন্তান। ঐরাবত হলো হিন্দু দেবতা ইন্দ্রের বাহন। এটিকে শুধু ভারতেই নয়, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, লাওস, শ্রীলংকা, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ইত্যাদি দেশেও ভক্তি করা হয়ে থাকে। থাই ভাষায় ঐরাবতকে এরাওয়ান বলা হয়। ভারতের প্রাচীন আমলের রাজাগণ হাতির পালে সাদা হাতি রাখতেন সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে। এমনকি মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আরাকান আক্রমণের অন্যতম প্রধান একটি কারণ ছিল আরাকানের মারাক-ঊ বংশীয় রাজা মিন খামাউ(৪ জুলাই ১৬১২ সাল – ১৪মে ১৬২২সাল) এর দখলে থাকা একটি দুষ্প্রাপ্য সাদা হাতির অধিকার লাভ।
বাংলাদেশের শুরুর দিকের কয়েকটি ই.পি.জেড গুলোর মধ্যে অন্যতম ‘রূপসা’ ই.পি.জেড খুলনায় অবস্থিত ৷ বর্তমানে খুলনা থেকে রেলপথে যশোর-চুয়াডাঙ্গা-বাহাদুরাবাদ হয়ে ঢাকায় পৌঁছাতে হয় ৷ একিইভাবে সড়কপথেও অনেক সময় ব্যয় হয়। ফলে খুলনার মংলা সমুদ্র বন্দরের’ নিকটে অবস্থান স্বত্ত্বেও রূপসা ই.পি.জেড অর্থনীতিতে আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে পারছে না । খুলনার বর্ডারের অন্যপাশে ভারত অংশে কলকাতা শহরের পাশেই ভারতের ব্যস্ত ডায়মন্ড হার্বার ও হলদিয়া বন্দরের অবস্থান ৷ খুলনা থেকে মংলা বন্দর যতদূর তারচেয়েও কম দূরত্বে অবস্থিত কলকাতার হলদিয়া স্থল বন্দর। এক্ষেত্রে কোনভাবে যদি কলকাতা রেলওয়ে জংশনের সাথে যুক্ত হওয়া যায় তবে ভারতের শক্তিশালী রেলওয়ে নেটওয়ার্কের কারণে পুরো ১০০কোটি জনসংখ্যার ভারতের সাথে সরাসরি সংযোগ স্থাপন হয়ে যায়; যার ফলে দক্ষিণাঞ্চলে আরো কয়েকটি ই.পি.জেড গঠনের সুযোগ তৈরী হবে৷ তবে ভারত যদি কখনো মায়ানমারের সাথে তার ‘কালাদান’ প্রকল্পটি (মায়ানমারের সিত্তে/সিথওয়ে বন্দর হয়ে ভারতের মণিপুর করিডোর) সম্পন্ন করে ফেলে তবে বাংলাদেশের এই প্রকল্পটির আন্তঃআঞ্চলিক গুরুত্ব কমে যেতে পারে! মায়ানমারের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থার কারণে যেহেতু ভারত কালাদান প্রকল্পের কাজ শুরু করেনি সেহেতু পণ্যপরিবহনে ভারতকে পদ্মা সেতু ও এর নিচ দিয়ে নির্মিতব্য রেল সংযোগ লাইন ব্যবহারের সুযোগ করে দিলে পণ্যবাহী পরিবহনের চালকরা এই পথে পণ্য পরিবহনে অভ্যস্থ হয়ে যাবে; এতে করে তাদের দীর্ঘ অন্য কোন রাস্তা দিয়ে ঘুরে যেতে হবে না এবং এই সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশও ন্যায্য মাসূল আদায় করতে পারবে৷
ঢাকা থেকে পদ্মা সেতুর নিচ দিয়ে শরীয়তপুর, নড়াইল হয়ে যশোর সরলরৈখিক রেলপথটি যদি সম্পন্ন হয়ে যায় তাহলে ভারতের কলকাতার সাথে বাংলাদেশের ৪র্থ এক্সিটটি (আখাউড়া) যুক্ত হওয়া সহজ হয়ে যাবে ৷ তখন সাতক্ষীরা-যশোর-খুলনা থেকে আগত মালবাহী রেল আখাউড়া-আগরতলা দিয়ে সরাসরি প্রবেশ করতে পারবে ভারতের ত্রিপুরায়, যা বর্তমানে ভারতের হলদিয়া বন্দর থেকে চিকেননেক-দার্জিলিং-শিমলা ও নেপাল-ভূটান এর বর্ডার ঘুরে মিজুরাম হয়ে ত্রিপুরায় পৌঁছায় প্রায় ১৫৭৮.৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে৷ কিন্তু পদ্মাসেতুর নিচ দিয়ে নির্মাণাধীন রেল লাইনটির ফলে হলদিয়া বন্দর থেকে আগত পণ্য ত্রিপুরায় পৌঁছাতে বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে মাত্র ৩০৮.৭ কি.মি. এর কাছাকাছি পথ অতিক্রম করতে হবে৷ এ দূরত্ব হ্রাসের কারণে ভারত নিজেদের পণ্য পরিবহণের সুযোগ লুফে নিবে! কারণ ভারতের পূর্বাংশে সেভেন সিস্টার অঞ্চলে প্রায় ৪৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার কাছে দ্রুত নিজেদের উৎপাদিত পণ্য পরিবহনে এরচেয়ে ভাল অন্য কোন সাশ্রয়ী বিকল্প তাদের হাতে নাই৷ পদ্মাসেতুর নিচ দিয়ে যাওয়া নির্মাণাধীন ছোট এই রেলপথ রিজিওনাল কানেক্টিভিটি বা আঞ্চলিক যোগাযোগে যে ভূমিকা রাখবে, ফলে বাংলাদেশের ভিতরেও এই রেলপথকে কেন্দ্র করে অনেক উৎপাদনশীল শিল্প-কারখানা গড়ে উঠবে শুধুমাত্র বাংলাদেশের এই অঞ্চলের সস্তা শ্রমের উপর ভর করে৷ এতে করে খুলনার পুরনো অনেক ই.পি.জেড পুনঃরায় আরো বহু মাত্রায় উৎপাদন মুখী হবে শুধুমাত্র আসাম-ত্রিপুরা সহ সেভেন সিস্টার অঞ্চলের সহজ বাজারটি ধরতে৷ খুব সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে পদ্মাসেতুর নিচ দিয়ে নির্মাণাধীন রেল লাইন প্রকল্পটির মারাত্মক ভূ-অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে যা বাংলাদেশের জন্য হতে পারে দারুণ এক গেইম চেঞ্জার; যা স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় লাভজনক প্রকল্প হতে চলেছে এবং এর লাভের রিটার্ন হতে পারে দুই থেকে তিনগুণ! এর ফলে শিল্প-কারখানা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের নতুন উদ্যোক্তা শ্রেণীর বিকাশ ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে অধিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ বাংলাদেশে ‘শ্রম ঘন্টার’ মজুরী মূল্য ভারতের আসাম-ত্রিপুরা অঞ্চলের চেয়ে কম; তাছাড়া বাংলাদেশে যে পরিমাণ সংযোগ রাস্তা ও সড়ক রয়েছে তা ভারতের সেভেন সিস্টার অঞ্চলে নাই ৷ এসব দিক বিবেচনায় ভারতের পূর্বাঞ্চলের চেয়ে বাংলাদেশের পশ্চিম-দক্ষিণাঞ্চল বিনিয়োগের জন্য তুলনামূলক বেশী উপযোগী ৷ তাছাড়া কলকাতা, মাদ্রাজ ও বেঙ্গালুরু থেকে সেভেন সিস্টার অঞ্চলের জন্য আগত বিভিন্ন পণ্যের আদায়কৃত মাসূল বাংলাদেশ সরকারের রাজস্বকে সমৃদ্ধ করবে৷
খুলনা থেকে ঢাকা রেলপথটিতে ট্রেন ঢাকা পৌঁছায় খুলনা-যশোর-ঈশ্বর্দী-জামালপুর-সরিষাবাড়ি-বাহাদুরাবাদ হয়ে। একিই পথে যশোর থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন ঢাকা পৌঁছাতে প্রায় নয় ঘন্টা সময় নেয় ৷ বাংলাদেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ স্থল বন্দর যশোর ও খুলনায় অবস্থিত ৷ এই দুটি বন্দরই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ভাল ভূমিকা রেখে চলেছে ৷ সীমান্তবর্তী সাতক্ষীরার ভোমরা চেকপয়েন্ট ও ঘোজাডাঙ্গা চেকপয়েন্ট দিয়ে ব্যাপক পরিমাণ পচনশীল পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশ করে। বুঝার সুবিধার্তে একটি নির্দিষ্ট পণ্যের কথা উল্লেখ করে ঘটনা প্রবাহ বর্ণনা করছি৷ আমাদের দেশে প্রায় প্রতি বছরই পেঁয়াজকে কেন্দ্র করে হইচই শুরু হয়৷ এই হইচই ভারত বাংলাদেশকে পেঁয়াজ সরবরাহ করলেও হয়, না করলেও হয়৷ এর পেছনে বহু কারণ রয়েছে৷ ভোমরা বন্দর দিয়ে যে পেঁয়াজ আসে তা শরীয়তপুর-ভেদরগঞ্জ-চাঁদপুর হয়ে চট্টগ্রাম পৌঁছে। ভেদরগঞ্জ থেকে ফেরীতে করে পণ্যবাহী গাড়ি খাতুনগঞ্জে এসে পৌঁছায়। পরিবহনের এই দীর্ঘ সময়ে রোদে, তাপে বা বৃষ্টির কারণে ১০% এর বেশী পেঁয়াজ নষ্ট হয়ে যায়৷ পেঁয়াজ নিয়ে সঙ্কটের পেছনে এটাও একটি পরোক্ষ কারণ৷ এখন যদি ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে সাতক্ষীরা বা যশোর অথবা খুলনার সাথে সরাসরি রেল লাইন সংযোগ করা হয় তবে যশোর থেকে ঢাকায় পণ্য পৌঁছাতে সময় নিবে মাত্র তিন ঘন্টা যা বর্তমান রেলপথে নেয় ৯ ঘন্টা। পদ্মাসেতুর নিচ দিয়ে নির্মাণাধীন রেললাইন ব্যবহার করে সাতক্ষীরা থেকে আগত পণ্য খুলনা-যশোর সংযোগ রেললাইন ব্যবহার করে ঢাকায় পৌঁছাতে তুলনামূলক কম সময় লাগবে বিধায় বাংলাদেশে ভোগ্যপণ্যের বাজার শুধুমাত্র খাতুনগঞ্জে সীমিত না থেকে অন্যান্য অঞ্চলেও নতুন বাজার গড়ে উঠার সম্ভাবনা তৈরী হবে৷ ফলে খাতুনগঞ্জে আমদানীকৃত পেঁয়াজ দেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে এবং ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় আমদানীকৃত পেঁয়াজ দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে দেওয়া হলে সরবরাহ লাইন (supply chain) আরো বেশী ফলপ্রদ (efficient) হবে যা আমদানীকৃত অন্য যে কোন পণ্যের ক্ষেত্রে একিইভাবে প্রযোজ্য৷ খাতুনগঞ্জের কারণে পুরো এলাকাতে দীর্ঘদিন ধরে একটি উদ্যোক্তা শ্রেণীর বিকাশ ঘটেছে৷
দেশের সরকার অনেক প্রকল্প হাতে নেয় সংশ্লিষ্ট এলাকার জনকল্যাণ ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের স্বার্থে৷ বাস্তবায়নের পর প্রকল্পগুলো ধীরেধীরে লাভের দিকে ধাবিত হয় বা প্রকল্পগুলোকে কেন্দ্র করে সরকার রাজস্ব লাভ করতে শুরু করে৷ ‘সরকার’ একটি জনকল্যাণ মূলক প্রতিষ্ঠান; মুনাফালোভী কোন বাণিজ্যিক কোম্পানি নয়৷ এটিই সরকারের সাথে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার চরিত্রগত মূল পার্থক্য৷ বাজারে যখন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য মূল্যের দাম বেড়ে যায় তখন সরকার বাজার থেকে সেসকল পণ্য কিনে নিয়ে বিনা লাভে কিংবা ভর্তুকি দিয়ে টি.সি.বি’র মাধ্যমে সাধারণ জনগণের কাছে বিক্রি করে৷ এটি সরকারের জনকল্যাণমুখী চরিত্রের অন্যতম একটি উদাহরণ ৷ ব্যবসায়ীগণ যদিও মুনাফার উদ্দেশ্যে কাজ করেন তবে তারাও সমাজের উপকার সাধন করে; কিন্তু ব্যবসায়ীগণের কাছে দিনশেষে মুনাফাই মূখ্য। পক্ষান্তরে সরকারের কাছে মুনাফা মূখ্য নয়, সরকারের কাছে মুখ্য হলো জনকল্যাণ সাধন করা৷
আন্তর্জাতিক উষ্ণায়ন ও তার ফলশ্রুতিতে সমুদ্রের জলরাশির উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত কারণে বাংলাদেশে বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যাটি হলো দক্ষিণাঞ্চলের আবাদি জমিতে লবণাক্ততার পরিমাণ অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাওয়া । জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে বড় শিকার বাংলাদেশ। আমাদের দেশের দক্ষিণ ও পশ্চিম-দক্ষিণাঞ্চলের একটা বড় অংশ আজ স্রেফ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাস্তুহারা। অনেক বড় বড় দেশ অতীতে অনেক আশার বাণী শোনালেও এসব দুর্ভাগা মানুষের জীবনমান উন্নয়নে তেমন কিছুই করেনি । এক্ষেত্রে বিদেশীরা এগিয়ে আসুক বা না আসুক এসকল জলবায়ু উদ্বাস্তুরাও বাংলাদেশের নাগরিক, সরকার তাদের কখনোই ভুলে যায়নি, দুরেও ঠেলে দেয়নি৷ কাজেই এসব ভাগ্যপীড়িতের কল্যাণের জন্য যদি সরকার সরবরাহ লাইনকে কেন্দ্র করে কোন উদ্যোগ নেয় এবং এতে যদি সরকারের লাভ-ক্ষতি অর্থনৈতিক মানদণ্ডে হিসাব করা হয় তবে দেশের সরকারের সরকারিত্বই থাকে না। একটি দেশের সরকার কোন দালাল বা ব্যবসায়ী শ্রেণী নয়, এমনকি সরকার কোন দাদন দেওয়া মহাজনও নয়৷ সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ জনকল্যাণমুখী কাজ করা এবং এই জনকল্যাণের বড় দাবিদার সবচেয়ে ভাগ্যপীড়িত, গরিব ও উদ্বাস্তু শ্রেণী৷ জলবায়ু উদ্বাস্তুদের বাস্তুতে ফিরিয়ে দেওয়া, জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা সরকারের সবচেয়ে বড় দায়িত্বের একটি, হোক তা সরকারের কয়েকশ বিলিয়ন ডলার খরচ করে৷ কারণ উদ্বাস্তু নাগরিকদের জীবন ও সুখ ছুঁয়ে যাওয়া হাসিটিই এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ইতোপূর্বে শুধুমাত্র একটি ব্রিজের অভাবে সরাসরি ঢাকা থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সংযোগ রেল পথটি আটকে ছিল। কারণ একটি টেকসই দ্বিতল সড়ক সেতু হয়ে গেলে তার নিচ দিয়ে রেল লাইন নিয়ে যাওয়া সহজ ও সাশ্রয়ী হয়ে যায়৷ এর ফলে খাতুনগঞ্জের ন্যায় এতদ অঞ্চলেও হয়ত উদ্বাস্তুদের নিয়ে গড়ে উঠতে পারে অন্য একটি উদ্যোক্তা শ্রেণী এবং এর মাধ্যমে ভাগ্যপীড়িত এসব জলবায়ু উদ্বাস্তুরা অর্থনীতির মূল স্রোতের সাথে নিজেদের সামিল করতে পারবে৷ দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদগণ যখন বর্তমান শেখ হাসিনা সরকারের নেওয়া বিভিন্ন জনকল্যাণ ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পকে, ঢালাও ভাবে, স্রেফ আর্থিক লাভ-ক্ষতির হিসাবে মূল্যায়ন করতে চান তখন তা আক্ষরিক অর্থেই দুঃখজনক ঠেকে; আমি সত্যিই জানি না বঞ্চিত-ভাগ্যপীড়িত এসব জলবায়ু উদ্বাস্তুদের সাদা দাঁতের আনন্দময় হাসিটি কেন তাঁদের কাঠখোট্টা হৃদয়ে দাগ কাটে না?
শ্রীলঙ্কার মাহেন্দ্র রাজাপাক্সে সরকারের মতো শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার কিন্তু দেশের উন্নয়ন যজ্ঞকে নিজের পিতৃভূমিতে সীমাবদ্ধ করে রাখেননি৷ মাহেন্দ্র রাজাপাক্সে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বড় সমুদ্র ও বিমান বন্দর নির্মাণ করেছেন আবেগের বশবর্তী হয়ে নিজের জন্মের শহর হাম্বানতোতা’য়। পক্ষান্তরে শেখ হাসিনা সরকার যৌক্তিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে বাংলাদেশে পণ্যবাহী মাদার ভেসেল সরাসরি বাংলাদেশে নোঙরের জন্য গভীর সমুদ্র বন্দরটি নির্মাণ করছেন কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে এবং কক্সবাজারের অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরটি পর্যটক ও যাত্রীদের চাহিদা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মানে উন্নীতকরণের প্রকল্প হাতে নিয়েছেন৷ যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যাক্তিগত আত্মতুষ্টির জন্য কিংবা পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হতেন তাহলে শ্রীলঙ্কার রাজাপাক্সে সরকারের অনুকরণে এসব প্রকল্প কক্সবাজারের পরিবর্তে গোপালগঞ্জে বাস্তবায়ন করতেন৷ তিনি তো তা করেন নি , বরং বাংলাদেশে মোটের ওপর সুষম উন্নয়নই করে চলেছেন। সরকারকে কেন্দ্র করে বা সরকারের আশেপাশে প্রভাব খাটিয়ে অনেকে ব্যাকডোরে (অননুমোদিত পন্থায়) উচ্চাভিলাষী অপ্রয়োজনীয় অনেক প্রকল্পের প্রস্তাব নিয়ে হয়তো হাজির হয়! কিন্তু বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থায় কোন প্রকল্পই ফিজিবিলিটি স্টাডির কড়া মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হওয়া ছাড়া অনুমোদন এর সুযোগ না থাকায় বিচক্ষণ ও দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অপ্রয়োজনীয় ও অলাভজনক অনেক প্রকল্পের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন৷ তবে হ্যাঁ, প্রকল্পগুলো কে আরও বেশি জনবান্ধব করতে সরকারের উচিত প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডির জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রকল্প বিশেষজ্ঞদের সমন্বিত মূল্যায়নের আলাদা কমিটি করা এবং অন্যান্য অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের মতামত নেওয়া৷ যে এলাকায় প্রকল্প হাতে নেওয়া হয় সে এলাকার জনপ্রতিনিধিদের মতামতের একটি গুরুত্ব রয়েছে বইকি৷
বর্তমান রাশিয়া-ইউক্রেন চলমান যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি দিন দিন নাজুক হচ্ছে৷ অর্থনৈতিকভাবে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি আমেরিকা সহ প্রায় সব দেশ কঠিন সময় পার করছে এখন৷ ‘কঠিন সময়’ সবসময় দুর্দশা ডেকে আনে তা কিন্তু নয়! এই কঠিন সময়ের কারণে ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির কুটিল মারপ্যাঁচে গার্মেন্টস সেক্টরে(RMG) পশ্চিমাদের ক্রয়াদেশগুলো চীনে না গিয়ে বাংলাদেশে এসেছে৷ তাছাড়া করোনা মহামারী কালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের অবস্থান সারা বিশ্বে ৫ম ও দক্ষিণ এশিয়ায় ১ম যার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুফল বাংলাদেশ পেতে শুরু করেছে৷ আগে ভাগেই হা হুতাশ না করে, একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যাবে বর্তমানে পৃথিবীতে চলমান ‘কঠিন সময়’ বাংলাদেশের জন্য ‘শাপে বর’ও হতে পারে!
রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্পের দিকে আঙ্গুল তাক করার আগে কিছু বিষয় আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করা দরকার৷ কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম৷ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষ হিসেবে বাংলাদেশ ক্ষতিপূরণ সহ বিভিন্ন সহযোগীতা পাওয়ার আশা রাখে৷ বাংলাদেশকে জলবায়ু তহবিলের জন্যেও নিরন্তর কাজ করতে হয়৷ তাছাড়া জলবায়ু তহবিলের অনেক প্রকল্পের অন্যতম শর্ত মানতে গিয়ে বাংলাদেশকে কার্বন নির্গমনও কমাতে হচ্ছে৷ বাংলাদেশে অন্য যেসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে সেগুলো প্রচুর কার্বন নিঃসরণ করে৷ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় পর্যাপ্ত জমি নেই৷ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো বাংলাদেশে এক প্রকার ব্যর্থ৷ নিরুপায় হয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি অতিরিক্ত ব্যয়বহুল হতে যাচ্ছে এটা জেনেই বাংলাদেশ এই পথে হেটেছে!
‘ঋণের ফাঁদ’ নিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন আলোচক-সমালোচকগণ তাত্ত্বিক অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন মতামত দিচ্ছেন৷ বিরোধী রাজনৈতিক দলের এবং সরকারের সমালোচক বেশীরভাগ বিশিষ্ট ব্যাক্তি বাংলাদেশ ঋণের ফাঁদে পড়ার পক্ষেই মতামত দিয়ে চলেছেন। ব্যবহারিক অর্থনীতির ভিত্তিতে প্রশ্ন আসবে ‘ঋণের ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনাটি তৈরী হয়েছে কেন?’ এর কারণ বাংলাদেশ ঋণ নিয়েছে৷ আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত একটি কথা ‘বাংলাদেশে প্রতিটি সন্তান প্রায় ৬৮ হাজার ৩১ টাকা ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে!’ আর এ কথাটি লোকমুখে প্রচলিত আছে বলেই বাংলাদেশ ‘চীনা ঋণের ফাঁদে’ পড়বে ধারণাটা হালে পানি পাচ্ছে! কখনো কি ব্রুনাই বা সৌদি আরবের লোকেরা নিজেদের দেশ ঋণের ফাঁদে পড়বে এমনটি বলে বেড়ায়? না, বলে না৷ কারণ ওসব দেশে কেউ আমাদের মতো ঋণের দায় মাথায় নিয়ে জন্ম নেয় না৷ যেহেতু বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এ ধারণাটি প্রচলিত আছে সেহেতু ঋণের ফাঁদে পড়ার ধারণাটি অমূলক নয়; যদিও মাথাপিছু ঋণ একটি দেশের অর্থনীতির জন্য বড় কোন ইন্ডিকেটর নয়, জি.ডি.পি’ই হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম ইন্ডিকেটর। যদি আমেরিকা, জাপান বা ব্রিটেনের মাথাপিছু ঋণের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাওয়া যায় সেসব দেশের মাথাপিছু ঋণ কিন্তু বাংলাদেশের চেয়ে বহুগুণ বেশী৷ আমলে নেওয়ার বিষয় হচ্ছে ঋণ নিয়ে গড়া প্রকল্প দেশের অর্থনীতির চাকা সচল করছে কিনা এবং সেসকল প্রকল্পের কারণে জি.ডি.পি বৃদ্ধি পাচ্ছে কিনা! মাথাপিছু ঋণের কথা বলে হট্টগোল করার মানেটা হচ্ছে জনগণের মাঝে হিস্টিরিয়া (Mass hysteria) তৈরী করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা করা৷ শ্রীলঙ্কা ঋণের ফাঁদে পড়ার পেছনে অনেক প্রভাবক একসাথে মিলে গিয়েছে৷ যেমনঃ করোনা মহামারীর কারণে তাদের আয়ের প্রধান উৎস পর্যটন খাতে ধ্বস, বিদেশ থেকে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স পাঠানো প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে যাওয়া, খাদ্য-শস্য উৎপাদন হঠাৎ করেই অর্ধেকে নেমে পড়া, রেডিমেড গার্মেন্টস সেক্টরের রপ্তানি আদেশ না থাকা; হাম্বনতোতা বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজকে আকৃষ্ট করতে না পারা ইত্যাদি৷ যার সবই একটি আরেকটির সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিল৷ যদি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঋণের ঝুঁকি থেকেও থাকে তবে তা নির্বাপন করতে ঋণগুলো পর্যালোচনা করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ কিছুদিন আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মৌখিকভাবে দিয়েছেন৷ তাছাড়া মনে রাখা উচিত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ও শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পূর্ণ ভিন্ন৷
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের অন্যতম বিরোধী দলীয় সংরক্ষীত মহিলা আসনের সদস্য রুমিন ফারহানা তার সাম্প্রতিক এক লেখায় শেখ হাসিনা সরকারকে শ্রীলঙ্কার রাজাপাক্সে সরকারের মতো পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত সরকার হিসেবে উল্লেখ করেছেন যা খুবই আপত্তিকর৷ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত বর্তমান সরকারের মন্ত্রী পরিষদে তিনি ছাড়া নিজ পরিবারের দ্বিতীয় কোন সদস্য মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে নেই৷ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মন্ত্রী পরিষদ গঠিত হয়েছে গণতন্ত্রের মূল নীতি অনুসারে রাজনীতিবিদ সহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং স্ব স্ব পেশায় সফল ও অভিজ্ঞ দুয়েকজন টেকনোক্রেট মন্ত্রীদের নিয়ে৷ অথচ ২০০১-২০০৬ সালে বি.এন.পি শাসনামলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন সরকারের অন্যতম প্রভাবশালী মন্ত্রী (মা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়) ছিলেন খালেদা জিয়ার আপন বড় বোন খুরশীদ জাহান হক এবং প্রভাবশালী প্রতিমন্ত্রী (যোগাযোগ) ছিলেন খালেদা জিয়ার দূর সম্পর্কের আত্মীয়ার স্বামী সালাউদ্দিন আহমেদ যা শ্রীলঙ্কার সদ্য পদত্যাগী রাজাপাক্ষে সরকারের সাথে হুবহু মিলে যায়৷
উল্লেখ করার মতো বিষয় এই যে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অপ্রয়োজনীয় ৬টি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম ৩০০কি.মি. গতির দ্রুতগামী রেল প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছেন বর্তমানে দরকার নেই বিধায়৷ তাছাড়া ব্যয় বহুল হওয়ায় তিস্তা নদীর জন্য চীনের প্রস্তাবিত প্রকল্পটি শুরুতেই না করে দিয়েছেন৷
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সবপক্ষই আঘাত প্রাপ্ত হচ্ছে৷ ইউক্রেনকে যুদ্ধকালীন বড় মাপের অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিতে গিয়ে আমেরিকাও অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ছে৷ রাশিয়া গ্যাস-তেল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় ইউরোপীয় দেশ সমূহ নানামুখী সংকটে পড়তে যাচ্ছে৷ বর্তমান বিশ্বে চলমান এসব বিবাদের কারণে নেতৃত্বের একটা ভ্যাকিউম (শূন্যতা) সৃষ্টি হবে অদূর ভবিষ্যতে৷ আর এই শূন্য স্থানটিতে বসে বিশ্বকে নেতৃত্ব দিবে কে? এর উত্তরঃ মহামারি ও যুদ্ধের দুর্যোগকালীন এই সময়ে যার তুলনামূলক অর্থ খরচ ও ক্ষতি কম হবে সে দেশটিই এ স্থান দখলে নিয়ে নেতৃত্ব দিবে৷ সব দিক বিশ্লেষণ করে বর্তমানে চীন-ই এই সুবিধাজনক স্থানে রয়েছে৷ অথচ পুরো বিশ্বে চীনা ঋণের ফাঁদ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কমতি নেই৷ শ্রীলঙ্কার বর্তমান অবস্থার জন্য চীনা ঋণের ফাঁদকে দায়ী করা হয়৷ বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বর্তমান পরিবর্তিত বিশ্বে কিন্ত চীন থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকবার সুযোগও নাই৷ বাংলাদেশ সরকারের উচিত বর্তমান চীনের সমাজতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা, সমাজতান্ত্রিক পুঁজিবাদী দর্শন ও পলিসি নিয়ে অভিজ্ঞ এমন বিজ্ঞজনের নেতৃত্বে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান (গবেষণা কেন্দ্র বা গবেষণা ইন্সটিটিউট) স্থাপন করা যার কাজ হবে চীনের বর্তমান পরিবর্তিত দর্শন আমলে নিয়ে কোন কোন কাজ চীনের সাথে করা যাবে এবং কোন কোন কাজ চীনের সাথে করা যাবে না তা গবেষণা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে বের করা৷ কারণ বাংলাদেশে প্রচুর ভারত, আমেরিকা ও ইউরোপ বিশেষজ্ঞ আছে; কিন্তু বাংলাদেশে প্রকৃত অর্থে ভাল মানের চীনের দর্শন-অর্থনীতি-রাজনীতি বুঝে এমন কোন বিশেষজ্ঞ নাই। চীনাদের ভাষাই বা ঠিকমতো পড়তে পারেন কজন? অথচ ভারতের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর নেটিভ চীনাদের মতোই চাইনিজ ভাষা ও সংস্কৃতিতে দক্ষ। তাছাড়া বাংলাদেশের সাথে মায়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যা, “এক অঞ্চল এক পথ উদ্যোগ” সহ বিভিন্ন ইস্যুতে চীনের সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রেখেই বাংলাদেশকে সমস্যা সমাধানে কাজ করে যেতে হবে৷ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতার অভাব রয়েছে। আমাদের কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না কোরীয় ঠিকাদারের দ্বারা নির্মিত যমুনা সেতু (যমুনা বহুমুখী সেতু) উদ্বোধনের বছর খানেক পর ঠিক মাঝখানে ফাটল দেখা গিয়েছিল যা পরবর্তীতে মেরামতের প্রয়োজন হয়৷ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রয়োজন থাকলেও কয়েকমাস পরপর বিলিয়ন ডলারের অবকাঠামো নির্মাণ সম্ভব নয়৷ যমুনা সেতু নির্মাণের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই কর্পোরেশন কাজে গাফিলতি করার সুযোগ পাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ – এধরণের বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে বাংলাদেশের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, উহান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি এর ‘আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ও এক অঞ্চল এক পথ’ গবেষণাকেন্দ্রের পরিচালক ড. মোস্তাক আহমেদ গালিব বলেন ‘ভবিষ্যতে এধরণের বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিদেশে এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রকল্পের ফিজিবিলিটি বাস্তবায়নে কর্মরত অভিজ্ঞদের নিয়ে বিশেষজ্ঞ বোর্ড গঠন করা ; যেখানে সদস্য হিসেবে স্থানীয় রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি ও সমাজকর্মীরাও থাকবেন৷’
পদ্মাসেতু প্রকল্প হাতে নেওয়ার পর বিদ্রুপ ও অপপ্রচারের অংশ হিসেবে বি.এন.পি. চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কটাক্ষ করে বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানে বলেছিলেন ‘এখন পদ্মাসেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে; পদ্মাসেতু আওয়ামী লীগ এর আমলে করতে পারবে না তারা!’ নানামুখী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মিথ্যা অভিযোগ এনে বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার পর বাংলাদেশ নিজেদের টাকায় সেতুটি নির্মাণের জন্য ‘চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হলে দেশের অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি হাসি-ঠাট্টা করেছিলেন৷ প্রয়াত সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচ.এম.এরশাদ ‘চাইনিজরা সেতুর কাজ নষ্ট করে দিবে বা তারা দুর্বলভাবে পদ্মাসেতু বানাবে’ বলে মন্তব্য করেছিলেন৷ অথচ চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি চীনের সবচেয়ে বড় ব্রিজ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশে এই সংস্থার ২৫ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে৷ কোম্পানিটি ১০০ বছরের পুরনো বাংলাদেশের হার্ডিং ব্রিজকে (বাংলাদেশের প্রথম ব্রিজ) অপরিবর্তিত রেখে এর পাশে পাকসী সড়ক সেতু নির্মাণ করে দেয় যেটি এখন লালন শাহ্ সেতু নামে পরিচিত৷ এই কোম্পানিটিই বাংলাদেশের শাহ্ আমানত সেতু নির্মাণ করেছিল; এমনকি বাংলাদেশের কয়েকটি ফ্লাইওভারের কাজও এরা সফলভাবে সম্পন্ন করে৷ কাজেই চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানিকে হাল্কা ভাবে দেখার সুযোগ নেই। প্রসঙ্গত বলা উচিৎ, সম্মানিত পাঠকবন্ধুদের নিশ্চয়ই মনে আছে বিশ্বব্যাংকের কুচুটে নেতা জোয়েলিক যখন পদ্মা সেতুর ঋণ বন্ধ করে দেয়, তখন অনেক আন্তর্জাতিক ঠিকাদারই এ প্রকল্পটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। সে সময় সুযোগ বুঝে মালয়েশিয়ার দূত ভেলু সামি মহাশয় প্রায় চল্লিশ বছর ধরে সেতুটিকে চুষে খাবার অত্যন্ত আপত্তিকর প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন! একটি গঠনমূলক বিরোধীদল হিসেবে বি.এন.পি. কিন্তু তখন তাঁদের মতামত দিতে পারতেন। দেশের ভাল হয় এমন কিছু যেহেতু তারা করেন না, সেই ধারা বজায় রেখে তারা তখন ঝিম মেরে ছিলেন। বি.এন.পি ঝিম মেরে থাকলেও শেখ হাসিনার অভিজ্ঞ চোখকে ফাঁকি দেয়া সহজ নয়; ভেলু সামির প্রস্তাবটি বাংলাদেশ কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে যথেষ্ট ভদ্রতার সঙ্গেই প্রত্যাখ্যান করে। এখন যে “ঋণের ফাঁদ” নিয়ে চেঁচিয়ে বাজার গরম করা হচ্ছে, আসলে ভেলু সামির প্রস্তাবটিই ছিল একটি ফাঁদ- যেটি থেকে শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশ ভালভাবেই বেরিয়ে যেতে পেরেছে।
আগামী ২৫ই জুন ২০২২ এ পদ্মাসেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট রবার্ট জোয়েলিক তাঁর শেষ কর্মদিবসে, পদ্মসেতু প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য ঋণ প্রস্তাব বাতিল করে দেয় সম্ভাব্য দুর্নীতির অভিযোগ এনে; যদিও কানাডার আদালতে প্রমাণ হয় যে পদ্মাসেতু প্রকল্পে কোন ধরণের দুর্নীতি হয়নি। পদ্মাসেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্ব ব্যাংক সরে যাওয়ার পেছনে বাংলাদেশের স্বনামধন্য কয়েকজন ব্যাক্তির নাম আলোচিত হয় যার মধ্যে একজন নোবেলজয়ী ও দুই জন বহুল প্রচারিত দুটি পত্রিকার সম্পাদক! তাদের এই ষড়যন্ত্রের কারণে প্রকল্পের কাজ শুরু হতে অনেক বছর দেরি হয়ে যায়। প্রতিবছর নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির কারণে সেতুর নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যায়, যার বোঝা এসে পড়ে সাধারণ জনগণের উপর এবং এই ষড়যন্ত্রের সরাসরি ভুক্তভোগী হয় পদ্মাসেতুর মাধ্যমে এক হতে যাওয়া প্রায় ২১ জেলার জনসাধারণ৷ এর দায় কিন্ত সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে যেতে বিশ্ব ব্যাংককে প্রভাবিত করা এদেশীয় ব্যাক্তিবর্গ কোন ভাবেই অস্বীকার করতে পারে না!
হ্যাঁ, প্রাচ্যের দৃষ্টিভঙ্গিতে পদ্মাসেতুর নিচ দিয়ে নির্মাণাধীন রেললাইন প্রকল্পটি সত্যিকার অর্থেই সাদা হাতি। বৌদ্ধ ধর্মে সাদা হাতিকে সৌভাগ্যের প্রতীক বিবেচনা করা হয়৷ অর্থনীতির ভাষায় বর্তমানে আমরা যে ‘সাদা হাতি’ ব্যবহার করে থাকি তা এসেছে পশ্চিমা শব্দ ‘White Elephant’ থেকে যেটি পশ্চিমাদের ভাষা৷ আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে যেমনঃ মিয়ানমার সরকারের কাছে, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধমন্দিরে সাদা হাতি খুবই বিরল ও সৌভাগ্যের প্রতীক মনে করে শ্রদ্ধার সাথে রাখা হয়৷ আর তাই, পশ্চিমের চোখে যা খারাপ ও ক্ষতিকর তা প্রাচ্যের চোখে খারাপ নাও হতে পারে৷ ঢালাওভাবে কোন প্রকল্পকে ‘সাদা হাতি’ বললে জনগণের কাছে ভুল বার্তা যেতে পারে বা চিন্তায় গলদ হতে পারে৷ ‘ঋণের ফাঁদ’ অথবা ‘সাদা হাতি’ প্রকল্পের উপর দোষ না চাপিয়ে আলোচক ও সমালোচকদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করা প্রয়োজন বর্তমান শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির দিকে।
লেখক: সদস্য, শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক উপ-কমিটি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং পি.এইচ.ডি গবেষক
রেফারেন্সঃ
১. বাংলাদেশে দেখছি শ্রীলঙ্কার ছায়া – রুমিন ফারহানা
২. ‘সাদা হাতি’ প্রকল্পগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতিকেও ঝুঁকিতে ফেলতে পারে – ড. মইনুল ইসলাম
৩. বাংলাদেশ চীন বন্ধুত্বের প্রেক্ষাপট: বিজয়ের ৫০ বছরে ফিরে দেখা – ড. মোস্তাক আহমেদ গালিব
৪. Sri Lanka caught in a ‘strategic debt trap’, faces worst economic crisis
৫. Sri Lanka not caught in a China debt trap, says ambassador to Beijing, as turmoil persists at home
৬. Bangladesh 5th in world in Covid Recovery Index, top in South Asia
৭. List of Countries by external debt- Wikipedia
৯.পদ্মা সেতু জাগাবে পিছিয়ে পড়া ২১ জেলাকে
সারাবাংলা/এজেডএস